দেশের সড়ক যোগাযোগের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে আজ। উদ্বোধন হচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু, যা দেশীয় অর্থায়নে বড় অবকাঠামো নির্মাণে বাংলাদেশের সক্ষমতাও প্রকাশ করবে।
আজ শনিবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করবেন। উদ্বোধনের পর শুধু প্রধানমন্ত্রী ও অতিথিদের গাড়ি সেতু পাড়ি দেবে। আগামীকাল রোববার ভোর থেকে টোল দিয়ে সাধারণ যানবাহন চলাচল শুরু করবে সেতু দিয়ে।
পদ্মা সেতু দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি জেলাকে সড়কপথে সরাসরি সংযুক্ত করেছে। কংক্রিট আর ইস্পাতের কাঠামোয় পদ্মা নদীর দুই প্রান্তের সামাজিক ও অর্থনৈতিক যোগাযোগের সেতুবন্ধ ঘটছে। তবে এই সেতু শুধু একটি বড় অবকাঠামো নয়, এটি বিদেশি অর্থায়ন ছাড়া প্রথমবারের মতো বাস্তবায়িত বাংলাদেশের একটি ‘মেগা’ প্রকল্প। এটি প্রমত্ত পদ্মার বুকে কারিগরি নানা জটিলতা কাটিয়ে নির্মাণ করা একটি সেতু। এটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর মানুষ ও ব্যবসায়ীদের দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি বা প্যানেল অব এক্সপার্টের প্রধান ছিলেন অধ্যাপক এম শামীম জেড বসুনিয়া। তিনি পদ্মা সেতুর দেশীয় ও বৈশ্বিক প্রভাব সম্পর্কে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইফেল টাওয়ার বলতে আমরা যেমন প্যারিসকে বুঝি, স্ট্যাচু অব লিবার্টি বলতে নিউইয়র্কের সেই স্ট্যাচুর কথা চোখে ভাসে, আমার মনে হয় আশপাশের সমস্ত দেশ মনে করবে পদ্মা সেতুর দেশ বাংলাদেশ। পদ্মা সেতু মানুষের সংকল্প, চেতনা ও পরিশ্রমের ফসল।’
১৯৯৯ সালে প্রাক্-সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষার মাধ্যমে পদ্মা সেতু প্রকল্পের সূত্রপাত। মূল কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের শেষের দিকে। শুরুর পর এক দিনের জন্যও কাজ থেমে থাকেনি।
নিজস্ব অর্থায়ন, নিজের সক্ষমতা
বাংলাদেশের বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বিভিন্ন দেশ ও উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণসহায়তা নিয়ে বাস্তবায়িত হয়েছে এবং হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম পদ্মা সেতু। এটির পুরো অর্থায়ন হয়েছে দেশের টাকায়। মানে হলো, কোনো দেশের কাছ থেকে এ সেতুর জন্য ঋণ নেওয়া হয়নি।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের নকশা চূড়ান্ত হওয়ার পর ২০১১ সালের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে এ প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাইকা ও ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) সঙ্গে ঋণ চুক্তি সই করে সরকার। কিন্তু নির্মাণকাজের তদারক করতে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনে বিশ্বব্যাংক। এরপর একে একে সব অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান প্রতিশ্রুত অর্থায়ন স্থগিত ঘোষণা করে।
বিশ্বব্যাংকসহ অন্যরা অর্থায়ন স্থগিত করার পর প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে আসে মালয়েশিয়ার সরকার। এ নিয়ে কিছুদিন আলোচনা চলার পর তা আর এগোয়নি। ২০১২ সালের ৯ জুলাই মন্ত্রিপরিষদের এক বৈঠকে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে পদ্মা সেতুর জন্য অর্থ না নেওয়ার কথা জানিয়ে দেয় সরকার।
এদিকে ২০১৪ সালে তদন্ত শেষে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জানিয়ে দেয়, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ২০১৭ সালে কানাডার টরন্টোর এক আদালতও জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের উপযুক্ত প্রমাণ পাননি তাঁরা।
বিশ্বব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগীরা পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে যাওয়ার পর সরকার যখন নিজস্ব অর্থায়নে সেতুটি নির্মাণের ঘোষণা দেয়, তখন দুটি উদ্বেগ সামনে এসেছিল—১. সেতু নির্মাণে বিদেশি ঠিকাদার আসবে কি না। কারণ মনে করা হয়, বিদেশি অর্থায়ন না থাকলে স্বল্পোন্নত দেশগুলো বৈদেশিক মুদ্রায় ঠিকাদারদের অর্থ পরিশোধ করতে পারে না। ২. বাংলাদেশ সরকার বাজেট থেকে পদ্মা সেতুর জন্য টাকা দিতে পারবে কি না। অবশ্য এই দুই সংশয় উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ সেতুটি নির্মাণে সক্ষম হয়েছে।
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর বাজেটে প্রতিবছর চাহিদা অনুযায়ী সরকার টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। আর এ টাকা দিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক থেকে বৈদেশিক মুদ্রা কিনে সময়মতো ঠিকাদারের পাওনা বুঝিয়ে দিয়েছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।
সেতুটি বাস্তবায়নকালে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে টান পড়েনি, বরং বেড়েছে। এখন মজুতের পরিমাণ ৪ হাজার ১০০ কোটি (৪১ বিলিয়ন) ডলারের বেশি, যা ২০১২-১৩ অর্থবছরে ছিল প্রায় ১ হাজার ৫৩২ কোটি (১৫ বিলিয়ন) ডলার। পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকার অন্য প্রকল্পে অর্থায়ন করতে পারেনি, বিষয়টি তা-ও নয়। বরং নতুন করে বড় বড় প্রকল্প নিয়েছে সরকার।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সওজের প্রকৌশলী হিসেবে চাকরি করার সময় রাজস্ব খাতের প্রকল্পে সময়মতো টাকা না পাওয়া, প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না থাকার অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। এ জন্য অনেক প্রকল্পের কাজও বন্ধ রাখতে হয়েছে। কিন্তু পদ্মা সেতুতে এক দিনের জন্য টাকার কথা চিন্তা করতে হয়নি। পাওনার জন্য ঠিকাদার কোনো দিন অভিযোগ করতে পারেনি। এই প্রকল্প আসলেই অনন্য, তাঁর দেখা সেরা।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে যা যা হয়েছে
পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। সেতুটি দ্বিতল, ইস্পাত ও কংক্রিটের যৌথ মিশ্রণে নির্মিত হয়েছে। এর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচলের পথ। নিচে বা ইস্পাতের কাঠামোর ভেতর দিয়ে রয়েছে রেলপথ। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য (নদীর অংশ) ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। দুই পারে ভায়াডাক্ট বা সেতুর বাইরের উড়ালপথ ৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে সেতুর দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার।
সেতুর সড়কপথটি চার লেনের। চওড়া ২২ মিটার। মাঝখানে আছে সড়ক বিভাজক। দুই দিক থেকে দুটি করে চারটি যানবাহন একসঙ্গে যাওয়া-আসা করার পরও জায়গা থাকবে। নদীর পানি থেকে সেতুর উচ্চতা ১৮ দশমিক ৩০ মিটার বা ৬০ ফুট। ফলে সেতুর নিচ দিয়ে অনায়াসে বড় নৌযান চলাচল করতে পারবে।
পদ্মা সেতুতে রেলপথ রয়েছে। সেতু দিয়ে গ্যাস, ফাইবার অপটিক কেব্ল ও টেলিফোনের তার নেওয়া হয়েছে। পদ্মার দুই পাড়ে নদীশাসন করা হয়েছে প্রায় ১৪ কিলোমিটার। চওড়া সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে ১২ কিলোমিটার।
চার রেকর্ড
পদ্মা সেতু নির্মাণে চারটি বিশ্ব রেকর্ড হয়েছে বলে জানিয়েছে সেতু বিভাগ। এগুলো হলো ১. প্রকল্পে ৩ মিটার ব্যাসের সর্বোচ্চ ১২৫ দশমিক ৫ মিটার দৈর্ঘ্যের ইস্পাতের পাইল মাটির গভীরে বসানো হয়েছে, যা আগে কখনো হয়নি। ২. সবচেয়ে লম্বা ইস্পাতের স্প্যান বসানো হয়েছে, যার দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। ৩. সেতুটি ভূমিকম্প সহনীয় করতে প্রায় এক লাখ কিলো টন কম্পনে টিকে থাকার ক্ষমতাসম্পন্ন ‘ডাবল কারভেচার ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং’ ব্যবহার করা হয়েছে। ৪. চতুর্থ রেকর্ডটি হলো নদীশাসনকাজের একক সর্ববৃহৎ দরপত্র। সেতুর সুরক্ষায় নদীশাসনে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, পৃথিবীতে আগে ব্যবহৃত হয়নি, এমন তিনটি উপকরণ ও প্রযুক্তির প্রয়োগ হয়েছে এই সেতুতে। পদ্মা সেতুর অন্তত সাতটি উপকরণ ও প্রযুক্তি বাংলাদেশে প্রথমবার ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন পদ্মা সেতুর ইস্পাত ও রডের পাইলের বাইরে দিয়ে এমন একটা ব্যবস্থা যুক্ত করা হয়, যা দিয়ে একধরনের অতি মিহি সিমেন্ট মাটির অভ্যন্তরে পাঠানো হয়।
এই সিমেন্ট ভেতরের নরম মাটিকে মজবুত করেছে। এটাকে বলা হয় ‘গ্রাউটিং’। সেতু বিভাগ বলছে, পাইলিংয়ে এ ধরনের প্রযুক্তি বিশ্বে প্রথম ব্যবহৃত হয়েছে। কংক্রিটের স্ল্যাবে এপোক্সি-গ্লু ব্যবস্থাও প্রথম।
সেতুটি উদ্বোধনের ক্ষণটি স্মরণীয় করে রাখতে দুই পাড় সাজানো হয়েছে। আলোকসজ্জিত করা হয়েছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও ভবন। সকালে সেতুর ফিতা কাটার দৃশ্য দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে দেশের মানুষ।