রক্ষক হয়ে যদি ভক্ষক হয়, তখন তো মুশকিল: প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে তাসলিমা বেগম

দিনাজপুর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চলমান এসএসসি পরীক্ষার ছয়টি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। এ কারণে চারটি বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত করতে হয়েছে। এখন নতুন তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। আর প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া বাকি দুই বিষয়ের পরীক্ষাও নতুন প্রশ্নপত্র ছাপিয়ে নির্ধারিত সময়েই নেওয়া হবে। আর এই প্রশ্নপত্র ফাঁসে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিনি একজন কেন্দ্রসচিব, যাঁর দায়িত্ব হলো নিরাপদে প্রশ্নপত্র পরীক্ষাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া। এ অবস্থায় পুরো নিরাপত্তার পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এসব বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক তাসলিমা বেগম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিবেদক মোশতাক আহমেদ।

তাসলিমা বেগম

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়ে, ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্যে এসএসসি পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। এ রকম নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্যেই দিনাজপুর বোর্ডের ছয়টি বিষয়ের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হলো এবং চার বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত হলো। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই?

তাসলিমা বেগম: প্রথমে বলব, এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। একই সঙ্গে উদ্বেগেরও। কারণ, এই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন থেকে শুরু করে পরীক্ষা নেওয়া পর্যন্ত কাজটি হয়ে থাকে কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। যেমন যাঁরা প্রশ্ন প্রণয়ন করেন, তাঁরা সিলগালা অবস্থায় তা পাঠান শিক্ষা বোর্ডে। সেই সিলগালা করা প্রশ্নগুলো আবার মডারেটররা অত্যন্ত গোপনীয়তা ও নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্যে মডারেশন করেন। মডারেশন করে করে তাঁরাই আবার সেগুলো সিলগালা করে বোর্ড কর্তৃপক্ষের হাতে দেন। বোর্ড কর্তৃপক্ষ সেখান থেকে নির্ধারিত প্রশ্নপত্র সেট সরকারি মুদ্রণালয়ে (বিজি প্রেস) নিয়ে যান। এরপর বিজি প্রেসে প্রশ্নপত্র ছাপার কাজটি হয়। সেখানেও কাজটি হয় অত্যন্ত নিরাপত্তার মধ্যে। ছাপার পর বোর্ডের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে তা প্যাকেট করে বাক্সবন্দী করে নিরাপত্তাব্যবস্থায় রাখা হয়। এরপর ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে সেগুলো জেলা-উপজেলা পর্যায়ে নেওয়া হয়। উপজেলায় সাধারণত থানার লকারে রাখা হয়। আর জেলা সদরের প্রশ্নপত্রগুলো জেলার ট্রেজারিতে রাখা হয়। বিষয় কোড উল্লেখপূবর্ক দুই সেট করে প্রশ্নপত্র পাঠানো হয়। সেগুলো পরীক্ষার রুটিন অনুযায়ী সাজানো থাকে। সুতরাং সেগুলো খোলার কোনো প্রয়োজন নেই। আর এখন প্রশ্নপত্রগুলো থাকে নিরাপত্তাসংক্রান্ত ফয়েল কাগজে মোড়া। এগুলো খোলার পর বন্ধের সুযোগ থাকে না। এরপর সেখান থেকে নির্ধারিত কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে যেদিন যে বিষয়ের পরীক্ষা হয়, তা কেন্দ্রে পাঠানো হয়। এ রকম একটি ব্যবস্থায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা সত্যিই উদ্বেগের।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনি নিরাপত্তাব্যবস্থায় প্রশ্নপত্র প্রণয়ন থেকে শুরু করে কেন্দ্রে পাঠানোর কথা বললেন, কিন্তু দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের অধীন কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে দেখা গেল, কেন্দ্রসচিবই প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত। অর্থাৎ যে কয়েকজনের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র থানা থেকে কেন্দ্রে নেওয়া হয়, তাঁদের একজনের মাধ্যমেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হলো। তাহলে কী বলবেন?

তাসলিমা বেগম: যেদিন যে বিষয়ের পরীক্ষা, সেদিনই থানা থেকে সেই বিষয়ের প্রশ্নপত্র আনতে হয়। সেখানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্ধারণ করা একজন কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্যের উপস্থিতিতে কেন্দ্রসচিব দুই সেট প্রশ্নপত্র পুলিশি প্রহরায় কেন্দ্রে নিয়ে যান। এটি একটি যৌথ দায়িত্ব। একা কারও খোলার সুযোগ নেই। কেন্দ্রে নেওয়ার পর পরীক্ষা শুরুর ২৫ মিনিট আগে কোন সেট প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হবে, তার নির্দেশনা দেওয়া হয়। তখনো দায়িত্বশীলদের উপস্থিতিতে তা খোলা হয়। এখানে মনে হয়, থানাতেই কিছু একটা হয়ে থাকতে পারে। এ জন্য কেন্দ্রসচিব অবশ্যই দায়ী হবেন। কারণ, ঘটনাটি তিনি ঘটিয়েছেন। তবে এ ক্ষেত্রে কেবল কেন্দ্রসচিবকে একা দায়ী করলেই হবে না। অন্য যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদেরও অবহেলা আছে। নিশ্চয়ই এটি দায়িত্বের অবহেলা বলে মনে করি।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: দিনাজপুরের ঘটনায় যেটি বেরিয়ে এল, সেটি হলো যাঁরা প্রশ্নপত্র আনার দায়িত্বে, তাঁরাই প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবও হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমরা কার ওপর দায়িত্ব রাখব?’ অর্থাৎ যাঁরা দায়িত্বে, তাঁরাই প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দিচ্ছেন। এ বিষয়ে কী বলবেন?

তাসলিমা বেগম: রক্ষক হয়ে যদি ভক্ষক হয়, তখন তো মুশকিল হয়ে যায়।

আরও পড়ুন

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: এমনিতেই করোনা ও বন্যার কারণে এ বছরের এসএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে শুরু করা হয়েছে। এখন প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে তা স্থগিত হয়ে আবারও পিছিয়ে গেল। তা–ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো ঘটনার কারণে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন?

তাসলিমা বেগম: আসলে এটি খুবই দুঃখজনক একটি ঘটনা। কারণ, করোনা ও বন্যার কারণে এমনিতেই অনেক ক্ষতি হয়েছে। এখন আবার নতুন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হওয়ায় শিক্ষার্থীদের জন্য বাড়তি চাপ পড়বে। এতে অভিভাবকেরাও উদ্বিগ্ন। এটি অত্যন্ত অমানবিক বিষয়। এর ফলে আমাদের শিক্ষার্থীরা একটি কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হয়ে গেল। এটা হওয়া কোনোভাবেই কাম্য ছিল না।

আরও পড়ুন

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: তাহলে ভবিষ্যতে এ রকম ঘটনা, অর্থাৎ প্রশ্নপত্র ফাঁস যাতে না হয়, সে জন্য আপনার কী পরামর্শ?

তাসলিমা বেগম: আমি মনে করি, সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে প্রযুক্তির আশ্রয় নেওয়া উচিত। ‘এ’ লেবেল ও ‘ও’ লেবেল পরীক্ষা কিন্তু প্রযুক্তিনির্ভর হয়েছে। যদিও তাদের পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কম, আমাদের অনেক বেশি পরীক্ষার্থী। আমার পরামর্শ হলো, প্রতিটি কেন্দ্রে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করে প্রযুক্তির আশ্রয় নিয়ে পরীক্ষার আগে আগে কেন্দ্রেই দ্রুতগতির ফটোকপি মেশিনের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফটোকপি করে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে পরীক্ষা শুরুর আধা ঘণ্টা আগে প্রযুক্তির মাধ্যমেই প্রশ্নপত্র পাঠানো হবে। তখন নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে দায়িত্বরত ব্যক্তিরা ফটোকপি করে তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করবেন। এই প্রক্রিয়ায় পরীক্ষার্থীরা ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের সুযোগ নিতে পারবে না।

আরও পড়ুন