চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি আসলেই বিশ্বের সেরা

ফাইল ছবি

প্রযুক্তি বিশ্বে তাক লাগানো চীনের জন্য নতুন কিছু নয়। প্রথমবারের মতো দেশটির একটি হিউম্যানয়েড রোবট পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হয়েছে। রোবটটিকে দেওয়া হবে নাট্যকলা, চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা। সুয়ে বা–০১ নামের রোবটটিকে সাংহাই থিয়েটার একাডেমিতে নাট্যকলা বিষয়ে পিএইচডি প্রোগ্রামের শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি করানো হয়েছে।

এটি একটি মাত্র খবর। এমন অনেক কিছু করে দেশটি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অর্জন নিয়ে প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট একটি প্রতিবেদন ছাপিয়েছে। ‘আর চায়না’জ ইউনিভার্সিটিজ রিয়েলি দ্য বেস্ট ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’ শিরোনামে এই প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে সায়েন্স ও টেকনোলজির ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্য নামকরা উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোকে কীভাবে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে কমিউনিস্ট–শাসিত দেশটি।

আন্তর্জাতিক অনেক শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার জন্য অন্যতম জনপ্রিয় দেশ চীন। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে। বেশি বৃত্তি, বৃত্তি ছাড়াও কম খরচে উচ্চমানের শিক্ষার সুযোগ, লেখাপড়ার পাশাপাশি চাকরির সুযোগ, চায়নিজ বা ইংরেজি ভাষায় পড়ার সুযোগসহ নানা কারণে দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি বৈশ্বিক শিক্ষার্থীদের আগ্রহ চরমে।

সায়েন্স ও টেকনোলজিতে ২০২০ সালে চীনের সিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় শীর্ষ ১০–এ ঢোকে। ২০২২ সাল নাগাদ অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ এই তালিকা থেকে বাদ পড়ে

যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানবিষয়ক খ্যাতনামা সাময়িকী নেচার বছর দশেক আগে ১৪৫টি বিখ্যাত জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষকদের অবদানের হিসাব রাখা শুরু করে। ২০১৬ সালে যখন প্রথম নেচার ইনডেক্স প্রকাশ করা হয়, তখন চায়নিজ একাডেমি অব সায়েন্সেস (সিএএস) প্রথম স্থানে থাকলেও শীর্ষ ১০–এ মার্কিন ও ইউরোপীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোরই আধিপত্য ছিল। এ তালিকায় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ছিল দ্বিতীয়, আর স্ট্যানফোর্ড ও এমআইটি ছিল পঞ্চম ও ষষ্ঠ স্থানে। তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে ছিল ফরাসি ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চ (সিএনআরএস) ও জার্মানির ম্যাক্স প্লাঙ্ক সোসাইটি। সপ্তম ও অষ্টম স্থানে ছিল জার্মানির হেলমহোলৎজ অ্যাসোসিয়েশন অব জার্মান রিসার্চ সেন্টারস ও টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়। আর তালিকার নবম ও দশম স্থানে অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়।

কিন্তু এই চিত্র ধীরে ধীরে পাল্টাতে থাকে। ২০২০ সালে চীনের বেইজিংয়ের সিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় শীর্ষ ১০–এ ঢুকে পড়ে। ২০২২ সাল নাগাদ অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ এই তালিকা থেকে ছিটকে পড়ে যায়। এই জায়গায় চলে আসে দুটি চীনা প্রতিষ্ঠান। ২০২৪ সালে এসে শীর্ষ ১০–এ টিকে থাকে মাত্র তিনটি পশ্চিমা প্রতিষ্ঠান—হার্ভার্ড, সিএনআরএস ও ম্যাক্স প্লাঙ্ক সোসাইটি। এ বছর হার্ভার্ড দ্বিতীয় ও ম্যাক্স প্লাঙ্ক নবম স্থানে আছে। শীর্ষ ১০–এর আটটি প্রতিষ্ঠানই এখন চীনের।

আরও পড়ুন
২০২৫ সালের সূচক অনুযায়ী চতুর্থ স্থানে আছে ঝেজিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী চীনের অত্যাধুনিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) কোম্পানি ডিপসিক–এর প্রতিষ্ঠাতা লিয়াং ওয়েনফেং।

এই পরিবর্তন চীনের গবেষণা সক্ষমতার বাস্তব ও দ্রুত উন্নতির ফল। গত দশকে গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যয় প্রকৃত অর্থে বছরে প্রায় ৯ শতাংশ করে বাড়িয়েছে চীন। ২০২৩ সালে ক্রয়ক্ষমতার নিরিখে সরকারি ও উচ্চশিক্ষা খাতে সম্মিলিত গবেষণা ও উন্নয়ন ব্যয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন উভয়কেই ছাড়িয়ে গেছে সি চিন পিং–এর দেশটি। বিদেশে কর্মরত অনেক চীনা গবেষককেও ফিরিয়ে আনা হয়েছে দেশে।

গবেষকদের ফেরানোর সুফলও পেয়েছে দেশটি। চীন এখন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের চেয়ে বেশি প্রভাবশালী গবেষণাপত্র (সবচেয়ে বেশি উদ্ধৃত হওয়া গবেষণাপত্রগুলোর ১ শতাংশ) প্রকাশ করে। রসায়ন, প্রকৌশল ও ম্যাটেরিয়াল সায়েন্সের মতো ক্ষেত্রে এখন বিশ্বসেরা বিবেচনা করা হয় চীনকে। ব্যাপক হারে উচ্চমানের কম্পিউটার সায়েন্সে গবেষণাও চলছে সেখানে। ২০২৫ সালের সূচক অনুযায়ী চতুর্থ স্থানে আছে ঝেজিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী চীনের অত্যাধুনিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) কোম্পানি ডিপসিক–এর প্রতিষ্ঠাতা লিয়াং ওয়েনফেং।

ফাইল ছবি
আরও পড়ুন

এই র‌্যাঙ্কিংয়ের পদ্ধতিতে চীনের শক্তির নানা দিকগুলোকেই বেশি তুলে ধরা হচ্ছে। সূচকে অন্তর্ভুক্ত জার্নালগুলো প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের শীর্ষ স্তরের গবেষণার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য বেছে নেওয়া হয়। ক্ষেত্রের বর্তমান অবস্থা প্রতিফলিত করতে এর গঠনও নিয়মিত বদলানো হয়। রসায়ন ও ভৌতবিজ্ঞানের জার্নালগুলোয় প্রকাশনার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০২৫ সালের সূচকে ব্যবহৃত জার্নালের অর্ধেকের বেশি এখন এই দুটি ক্ষেত্রের। অন্যদিকে স্বাস্থ্য ও জীববিজ্ঞান, যা এখনো পশ্চিমা বিশ্বের আধিপত্যের ক্ষেত্র। সেসব বিষয়ের জার্নাল থেকে আসা গবেষণাপত্রগুলো সূচকের মাত্র ২০ শতাংশ। আবার যখন বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বিবেচিত দুটি জার্নাল শুধু ‘নেচার’ ও ‘সায়েন্স’–এ প্রকাশিত গবেষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়, তখন চীনের গবেষণাকেন্দ্রগুলোর র‌্যাঙ্কিং বেশ নিচে চলে যায়। সেই তালিকায় চতুর্থ স্থানে থাকে শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয়।

নেচার ইনডেক্স কোনো প্রতিষ্ঠান বা দেশের বৈজ্ঞানিক সক্ষমতা পরিমাপে কার্যকর উপায় হলেও এর মূল্যায়ন কিন্তু অনিবার্যভাবেই কিছুৃটা অসম্পূর্ণ। অনেক মূল্যবান গবেষণা তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ জার্নালেও প্রকাশিত হয়। আবার বিশ্ব বদলে দেওয়া উদ্ভাবন সব সময় শীর্ষস্থানে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আসে না। তবে এ কথা বলতেই হবে যে, চীনের ঝেজিয়াং, পিকিং ও সিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের সেরাদের মধ্যে নিজেদের স্থান অর্জন করে নিয়েছে, এটি বলতে আর কোনো দ্বিধা নেই।

আরও পড়ুন