নববধূর জন্য কেনা প্রথম শাড়িটা আর নিজ হাতে দেওয়া হলো না

মুক্তিযুদ্ধের অজানা ইতিহাস জানতে ঠাকুরগাঁওয়ের গ্রামে গ্রামে ছুটে বেড়াচ্ছেন ফারজানা হক। বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার আর প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করছেন টুকরো টুকরো ইতিহাস। কাজটা করতে গিয়ে শহীদ পরিবারের কাছ থেকে অমূল্য ১৭টি স্মারকও পেয়েছেন। ‘১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ জাদুঘর’ কর্তৃপক্ষের কাছে সেগুলো তুলেও দিয়েছেন। এখানে স্মৃতিময় ৪টি স্মারকের গল্প শুনিয়েছেন তরুণ মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও কলেজশিক্ষক ফারজানা হক

শহীদ সহর আলীর গামছাটা এখন প্রদর্শিত হচ্ছে গণহত্যা জাদুঘরে
ছবি: সংগৃহীত

গামছাটা পাঠিয়ে দিলেন সহর আলী

১৫ এপ্রিল ১৯৭১। ঠাকুরগাঁও শহরে প্রবেশ করেছে পাকিস্তানি হানাদাররা। তাদের অগ্রযাত্রা প্রতিরোধ করতে তৎপর মুক্তিযোদ্ধারা। ঠাকুরগাঁও শহরের দুটি লঙ্গরখানা থেকে এসব যোদ্ধার খাবার সরবরাহ করা হয়, যার একটিতে সাহায্য করেন ব্যবসায়ী সহর আলী। তাঁর বড় ছেলে মহিউদ্দিনও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। স্বভাবতই পরিবারটির ওপর রাজাকারদের নজর পড়ে। সেটা বুঝতেও পারেন সহর আলী। পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে সবাইকে নিয়ে ফাড়াবাড়ি হাট এলাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি।

১৫ মে ১৯৭১। দুপুর। ফাড়াবাড়ি হাট এলাকায়ও ঢুকে পড়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা। সহর আলী আক্রমণের খবর পেয়ে বড় ছেলেকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। তবে পরিবারের নারী সদস্যদের কথা ভেবে নিজে বাসায় থেকে যান।

সবে জোহরের নামাজ পড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন সহর আলী, এমন সময় তাঁর আত্মীয়ের বাসায় ঢুকে পড়ে পাকিস্তানি সেনারা। সহর আলীকে বাইরে নিয়ে যায়। আশপাশের অন্যান্য বাড়ি থেকেও অনেক পুরুষকে ধরে নিয়ে আসে। চারদিকে বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। আটক মানুষদের গাড়িতে তোলা হয়। পথে এক প্রতিবেশীকে তড়িঘড়ি মাথার গামছা আর তসবিটা দিয়ে দেন সহর আলী। আর বলেন, এগুলো যেন তাঁর পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।

সহর আলীর পরিবার গামছা আর তসবি পেয়ে বুঝতে পারে, তাঁকে নিয়ে গেছে পাকিস্তানি বাহিনী। তাঁকে নানাভাবে ছাড়িয়ে আনার চেষ্টাও করে পরিবার। কিন্তু সেদিনই ঠাকুরগাঁও শহর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে মাহালিয়াপাড়ায় আরও ৩৪ জনের সঙ্গে হত্যা করা হয় সহর আলীকে।

মানুষটা নেই, সহর আলীর শেষ স্মৃতি গামছাটা এত দিন পরিবারের কাছেই ছিল, এখন প্রদর্শিত হচ্ছে গণহত্যা জাদুঘরে।

আরও পড়ুন
এই কাঁসার থালায় ভাত খেতেন শহীদ আবদুর রহমান
ছবি: সংগৃহীত

থালাটা ডাক্তার সাহেবের

রানীশংকৈল উপজেলার বাজারটার নাম নেকমরদ। এই বাজারেই আবদুর রহমানের ওষুধের দোকান ছিল। চিকিৎসাসেবা দিতেন বলে এলাকায় যেমন ‘ডাক্তার’ হিসেবে পরিচিতি ছিল, তেমনি রাজনৈতিকভাবেও প্রভাবশালী মানুষ ছিলেন। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছিলেন।

১৯৭১ সালের ২ কি ৩ ডিসেম্বর। আবদুর রহমানের দোকানে আসে পাকিস্তানি সৈন্যরা। তিনি আর তাঁর ভাই আবদুস সোবহানকে ধরে নিয়ে যায়। রানীশংকৈল থানায় আরও অনেকের সঙ্গে তাঁদের ওপরও চলে অমানবিক নির্যাতন। বিজয়ের ঠিক দুদিন আগে খুনিয়াদিঘিতে নিয়ে দুই ভাইকে গুলি করে হত্যা করে হানাদাররা।

কাঁসার থালায় ভাত খেতেন আবদুর রহমান। তাঁর থালাটা সযত্ন রেখেছিল পরিবারের সদস্যরা।

আরও পড়ুন
সুজাউদ্দিনের ব্যবহৃত চিকিৎসা–সরঞ্জাম, উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি আর চিঠি
ছবি: সংগৃহীত

অপ্রকাশিত উপন্যাস আর একটি চিঠি

১৯৪৮ সালে এলএমএফ পাস করেন সুজাউদ্দিন। গ্রামে ফিরে মানুষকে সেবা দিতে শুরু করেন। রাজনীতিসচেতন মানুষ ছিলেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ৬৬ সালের ছয় দফা, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানসহ অধিকার আদায়ের আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে নিজ এলাকা পীরগঞ্জে রাজনৈতিক কর্মসূচির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

১৭ এপ্রিল ১৯৭১। চেম্বার থেকে এই পল্লিচিকিৎসককে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। পীরগঞ্জের ভাতারমারি আখ খামারে নির্মম নির্যাতনের পর গুলি করে তাঁকে হত্যা করে।

সুজাউদ্দিনের ব্যবহৃত চিকিৎসা–সরঞ্জাম, তাঁর লেখা একটি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি এবং ছেলের কাছে লেখা একটা চিঠি এত দিন আগলে রেখেছিল তাঁর পরিবার। চিঠিটি এখন গণহত্যা জাদুঘরের কাছে হস্তান্তর করেছে তাঁর পরিবার। মুক্তিযুদ্ধের আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া সন্তানের কাছে চিঠিটি লিখেছিলেন তিনি।

আরও পড়ুন
নববধূর জন্য শাড়িটি কিনেছিলেন শহীদ আবদুর রশিদ
ছবি: সংগৃহীত

মানুষটা নেই, শাড়িটা আছে

১৯৭১ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ। হঠাৎ করেই শাহানা বেগমের সঙ্গে আবদুর রশিদের বিয়ে হয়ে যায়। যুদ্ধ চলছে, তাই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় আড়ম্বর ছিল না। নববধূকে কিছু দিতে পারেননি বলে আবদুর রশিদের মনে একটা চাপা কষ্ট ছিল। ঠাকুরগাঁওয়ে পাকিস্তান বাহিনী এলে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে সপরিবার ভারতে চলে যান তিনি। আশ্রয়শিবিরে পরিবারের সদস্যদের রেখে মে মাসের মাঝামাঝি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন আবদুর রশিদ। যুদ্ধের ভেতরই স্ত্রীর জন্য একটা শাড়ি কেনেন। সেই শাড়ি নিয়েই সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন এই বীর যোদ্ধা। আগস্টের শেষ সপ্তাহে এমন একটা সম্মুখসমরে শহীদ হন আবদুর রশিদ। শাড়িটা আর স্ত্রীর হাতে তুলে দিতে পারেননি। স্বাধীনতার পর শাহানা বেগমের হাতে শাড়িটা পৌঁছে দেন আবদুর রশিদের এক সহযোদ্ধা। জীবনের অনেক টানাপোড়েনের মধ্যেও এত দিন শাড়িটা আগলে রেখেছিলেন শাহানা বেগম। সেই শাড়ি গণহত্যা জাদুঘরের কাছে হস্তান্তর করেছেন তিনি।