মাদাগাস্কারে সাইকেলে ভ্রমণের শেষটা সাগরেই হলো

মাদাগাস্কারে গিয়েছিলেন বাংলাদেশি চার সাইক্লিস্ট। আফ্রিকার দ্বীপরাষ্ট্রটিতে সাইকেলে ঘুরে দারুণ দারুণ সব অভিজ্ঞতা তাঁদের হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতাই সবার সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছেন মুনতাসির মামুন। আজ পড়ুন ত্রয়োদশ ও শেষ পর্ব

পরিচিত রাস্তা দ্রুত ফুরায়, ফিরতি পথ আরও দ্রুত—এটা ভ্রমণের সূত্র
ছবি: লেখক

কাকডাকা ভোরে উঠে যাওয়া হলো নিত্যকার মতো। অভ্যাসটা যে কবে ঠিক হবে। যেমন আজ আমাদের এত ভোরে না উঠলেও চলত। এখান থেকে রিটোর বাড়ি ৭০ কিলোমিটারের কাছাকাছি। রাস্তার যে অবস্থা, ধীরেসুস্থে গেলেও দুপুরের মধ্যে পৌঁছানো যাবে। চেনা পথ। পড়ে থাকা সাদা আর রক্তজবা কুড়াতে দেখলাম হোটেলকর্মীকে। এই ভোরে ব্যাপারটা অনিন্দ্য এক আবহ তৈরি করল।

আজ আর ওটমিল দিয়ে প্রাতরাশ নয়। পেটপুরে খেয়ে বের হব। এতে কিছু বাড়তি সময় এখানে থাকা যাবে। আমাদের অভ্যাস হলো উঠে রেডি হয়ে রাস্তা ধরা। কিন্তু আজ অন্য রকম। চেয়ার পেতে বসে সমুদ্র দেখাই কাজ। জেলেরা জাল নিয়ে হাঁটা ধরেছেন নৌকার দিকে। এই নৌকাগুলো খুব ছোট। ডিঙির মতো কিন্তু এক পাশে পানির ওপর ভাসমান একটা পাটাতন থাকে, যাতে নৌকা বড় ঢেউ সামলাতে পারে। এক নৌকায় দুজনের বেশি ওঠা যাবে না। এই দিয়ে মাছ ধরা। সবকিছু ধীর। সবকিছু শুধুই প্রয়োজনে। চাহিদার বাহাদুরি কম। এ অবশ্য দূর থেকে দেখে আমার মনে হচ্ছে। আসল ঘটনা কী, মানুষগুলোর সঙ্গে না মিশলে বলা দুরূহ।

পাউরুটি, অমলেট, জ্যাম, জুস দিয়ে প্রাতরাশ সেরে রাস্তায় উঠে আসতে সাড়ে আটটা বেজে গেল। আকাশ পরিষ্কার আছে। রাস্তা সমতল। চিন্তার মধ্যে একটাই, সাইকেলের যেন কিছু না হয়। দুপুরের খাবার রিটোর সঙ্গে যে রেস্টুরেন্টে দেখা হয়েছিল, সেখানে খাব, পরিকল্পনা এটাই। এর আগে একটু সময় থামা হবে। কিন্তু যত দ্রুত চালিয়ে যাওয়া যায়, তার চেষ্টা থাকবে।

পরিচিত রাস্তা দ্রুত ফুরায়, ফিরতি পথ আরও দ্রুত—এটা ভ্রমণের সূত্র। যত গাঢ় হবে ‘যেতে নাহি চাহি’ মন, পথ শেষ হয়ে যাবে তত দ্রুত। এটা যে কেন হয়! মান্দা বিচ হোটেলের সাইন অতিক্রম করা হলো ১০টার দিকে। মানে দুই ঘণ্টার কম সময়ে। আচ্ছা, শেষ যখন হয়ে যাচ্ছে, তো যত জলদি করা যায়, ততই ভালো। রিটোর সঙ্গে আড্ডা দেওয়া যাবে বেশি। আর ৪০ কিলোমিটার রাস্তা সারা দিনে।

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হলো। যাক, তা–ও আজ পথে নামার বেশ খানিকটা দেরিতে বৃষ্টি এল। বৃষ্টিতে গতি ধীর হবে। এটা একটা ভালো দিক। আজ আর কারও ক্লান্তি নেই। সকাল থেকেই চঞ্চলরা সাইকেল নিয়ে একেবারে কাছাকাছি থেকে চালাচ্ছে। বৃষ্টির তোড় বেড়ে যাওয়ায় থামতে হলো। রোদচশমার প্রয়োজন নেই, তবে রাস্তার ধুলা আর ছোট ছোট একধরনের পোকার জন্য চশমা জরুরি। চারজনের মধ্যে শুধু আমার চশমা পরতে হয় না। বাকিরা এই বৃষ্টি কিংবা রোদ না থাকলে রোদচশমা খুলে ব্যবহারিক চশমা পরে চালায় কিন্তু আমার কোনো উপায় থাকে না। তাই সন্ধ্যায়ও আমার চোখে রকস্টারদের মতো ডার্ক গ্লাসেস। অসুবিধা হয়, তবে পোকা থেকে বাঁচার জন্য করতেই হয়। নিরুপায়। এখন তা-ই হচ্ছিল। বৃষ্টির জন্য আমি সামনে দেখতে পারছিলাম না। চশমা এত ঘোলা যে রীতিমতো খুলে চালাতে হচ্ছে। কিন্তু খুলে নিলে চোখে লাগে ঝাপটা। কত নাজুক আমরা। অথচ একজন রিকশাচালক সারা জীবন খালি চোখে চালিয়ে যান রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে। তাঁদের কিছুই লাগে না।

ঝুপড়ির মতো একটা দোকানে থামলাম। শণের চালা অনেক নিচে নুয়ে আছে। আমাদেরও নিচু হয়ে ঢুকতে হলো। বৃষ্টির জন্যই এমন হবে, যাতে ভেতরে ঝাপটা না যায়। সেই একই গল্প। অতি সাধারণ দোকান। গুটি কয়েক সদাইপাতি নিয়ে জবুথবু হয়ে বসে আছেন এক নারী। আমাদের দেখেও নির্বিকার। বরং তাঁর দিবানিদ্রায় ব্যাঘাত হলো বলে মনে হচ্ছে। সাইকেল দুটো বৃষ্টিতে। প্রয়োজন না থাকলেও বিস্কুট নেওয়া হলো, সঙ্গে চা। সময় কাটানোর জন্য। আধঘণ্টায় বৃষ্টি কমার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। নাহ, আর নয়। বেরিয়ে এলাম ঝমঝমে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। যা হয় হোক, চালিয়ে যাব।

বেরিয়েছি বেশি হলে পাঁচ মিনিট। আমাদের সাইকেলের পেছনের চাকা ফেঁসে গেল। যাহ! একে বৃষ্টি, তার মধ্যে পেছনের চাকা। সামনের চাকা খুব দ্রুত সারিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু পেছনের চাকা সারাতে হলে সাইকেল থেকে সবকিছু নামিয়ে রাখতে হয়। সাইকেল উল্টো করে পেছনের চেইন থেকে চাকা খুলে তারপর সারতে হয়। সব মিলিয়ে ১০ মিনিট। এই বৃষ্টি ব্যাপারটা কঠিন করে দিল। রাস্তার দুই পাশে জুতাডোবা পানি। ভেজার আর ভয় নেই। অবশ্য ভেজার মতো বাকি কিছু নেই। কিন্তু তারপরও প্যাঁচপ্যাঁচে কাদাজলে পা দিতে চাইছিলাম না। কিন্তু রাস্তার ওপরও কাজ করাটা মারাত্মক বিপদের হবে। এই বৃষ্টিতে দূর থেকে গাড়ি আমাদের দেখতে পাবে না। কেউ আশাও করবে না এই বৃষ্টিতে কেউ রাস্তায় সাইকেল সারাতে বসবে। প্যানিয়ারগুলো রাস্তার কিনারে রেখে কাদাজলে নেমে সাইকেল সারাতে হলো। এখন আর সময় দ্রুত চলছে না। মনে হচ্ছে করেই যাচ্ছি, করেই যাচ্ছি। একটা টিউব পাল্টাতে জীবন চলে যাচ্ছে!

শেষ টিউবটা লাগানো হলো। এরপর যদি কিছু হয় তো তালিপট্টি দিতে হবে। প্যাচিং বলি আমরা। এখন খোদার নাম জপা ছাড়া আর রক্ষা নেই। এই বৃষ্টিতে আর যা–ই হোক, প্যাচিং সম্ভব নয়। চোখ-কান বুজে চালাতে হবে। যত দ্রুত রিটোর বাড়িতে পৌঁছানো যায়।

আসার পথে যে রেস্টুরেন্টে থেমেছিলাম, তাতে পৌঁছানোর আগে রাস্তার এক পাশে সমুদ্র খুব কাছে চলে আসে। যাওয়ার সময় দেখেছিলাম, একচিলতে ঘাসের জমিনে এসে মিশে গেছে ভারত মহাসাগর। ওখানে একটা ছোট বিরতি দেব। এরপর কক্সবাজার ছাড়া সাগর এত কাছে পাওয়া যাবে না। তা–ও তো সেটা ভারত মহাসাগর নয়! বিদায়ের উপহার হিসেবে বৃষ্টিও ধরে এল। আমরা সেই ঘাসের জমিনে এসে থামলাম। ঘটা করে ছবি নেওয়া হলো। আর ১০ মিনিটের রাস্তা বাকি হবে। যবনিকাটা সাগরের সঙ্গেই হলো। সুন্দর ইতি। এরপরও চালাতে হবে কাল তমাসিনার বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত। কিন্তু সেটা বাড়ি থেকে বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ার মতোই হবে। তাই এখানের এই বিরতি আদতে আমাদের মাদাগাস্কারের সাইকেল ভ্রমণের শেষ।

আবার শহর। আবার আকাঙ্ক্ষা, সামর্থ্য আর সামাজিকতার জালে জড়িয়ে যাওয়া। এই কটা দিন আলাদা। গতানুগতিক জীবন থেকে আলাদা একেবারেই। এরই নাম মনে হয় বেঁচে থাকা! (শেষ)