নদীপারের মেয়ে আমি কিন্তু বইঠা হাতে নিয়েছি আজই প্রথম

সব মিলিয়ে ১২ দিনের অভিযাত্রা। এর মধ্যে যেতে-আসতেই ছয় দিন শেষ। অ্যান্টার্কটিকার সাগর-উপসাগরে ঘুরে ঘুরে কেটেছে বাকি ছয় দিন। কখনো কখনো জাহাজ থেকে নেমে ছোট নৌকায় ভেসে ভেসে দেখেছেন পেঙ্গুইনের কীর্তিকলাপ, কখনো বরফঢাকা অ্যান্টার্কটিকার ওপর করেছেন হাইকিং। অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রার সেই গল্প শোনাচ্ছেন মহুয়া রউফ। আজ পড়ুন পঞ্চদশ পর্ব

জেটিতে সাজিয়ে রাখা কায়াক নিয়েই নামতে হবে সাগরে
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

রাতের লাউঞ্জ জমে উঠেছে। জিমি পিয়ানো বাজানোর চেষ্টা করছে। কারও তাতে বিশেষ মনোযোগ দেখছি না। জাহাজে বন্ধু-পরিচিতজনদের নিয়ে এ কদিনে বেশ কিছু ছোট ছোট দল তৈরি হয়েছে। যার যার দলের সঙ্গে তার তার আড্ডা। আমি আমার তিন বান্ধবীকে পাশ কাটিয়ে পিয়ানোর কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। আজ বিকেলে যখন পিয়ানো শোনানোর আমন্ত্রণ জানাচ্ছিল, তাঁর চোখেমুখে আগ্রহের তীব্রতা ছিল সুস্পষ্ট। নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভেবেছি। বুঝতে পারছি না এখনো সে আগ্রহ অটুট কি না।

আমাকে দেখে জিমি হাসছেন। সে হাসিতে আমন্ত্রণের পূর্বাভাস। জিমি বাজানো শুরু করলেন, ‘মাই হার্ট উইল গো অন...’। জিমির নজর স্থির পিয়ানোর কি-বোর্ডে। আমার নজর স্থির তাঁর কোঁকড়া চুলে। খুব বেশিক্ষণ বাজাতে পারলেন না, মাত্র চার লাইনের পর থেমে গেলেন। আমার দিকে তাকালেন, সে দৃষ্টি অভিবাদন খোঁজে। এমন একটা ধ্রুপদি পরিবেশে একটা রবীন্দ্রসংগীত তো মনে আসা জরুরি। গুনগুন করে আমিও গাইতাম দুই লাইন। কিন্তু আমার মাথায় ঘুরে ঘুরে আসছে, ‘ছেলে তোর কোঁকড়া কোঁকড়া চুলে যেন সমুদ্র ঢেউ খেলে...!’....

আকাশে রংধনু উঠেছে। এখানেও রংধনু ওঠে। আকাশে আরেকটি কৃত্রিম যন্ত্র উড়ছে, ড্রোন। আকাশের নিচে সাগরে এক ঝাঁক নৌকা। শুরু হচ্ছে কায়াকিং। হরেক রকম কায়াক জড়ো হয়েছে নিকো পোতাশ্রয়ে। তাদের শরীরে লাল, সবুজ আর হলুদের ছড়াছড়ি। এদের আমি বলি আনন্দের রং। কায়াকগুলো এই কদিন জাহাজের পেছনে বাঁধা ছিল। আজ তাদের যথাযথ ব্যবহার শুরু হলো। পা থেকে কোমর অবধি শরীর কায়াকে প্রবেশ করিয়ে দিলাম। শরীর সাগরে মিশিয়ে দেওয়ার মতো অনুভূতি। পা প্রসারিত। হাতে নিয়েছি ডাবল ব্লেড প্যাডেল। আমি সাঁতার জানি না। তবু কায়াক চালানোর অভিজ্ঞতা নিতে চাই। এক কায়াকে দুজন বসতে পারে। এই অপারেশনে একজন গাইড তো থাকবেই। আমি মারিওকে বললাম আমার কায়াকেই যদি বসতেন গাইড, তবে আমি কিছুটা ভয়মুক্ত হতাম। মারিও আমার কথা রেখেছে। আমি সামনে, আমার পেছনে গাইড, এক বাহনে আমরা দুজন।

আরও পড়ুন
অ্যান্টার্কটিকার শান্ত সাগরে কায়াকিং
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

সারা জীবন পানিতে সাপের ভয় পেয়েছি। আজ এখানে তিমির ভয়। এ কটা দিনে ভয় কমেছে, সাগরকে জয় করার আকাঙ্ক্ষা বেড়েছে। তাই আমি ঠিক করেছি এক বেলা কায়াকিং করব। এই এক বেলা কায়াকিংয়ের জন্য আমাকে গুনতে হচ্ছে প্রায় ৪০০ ডলার। বুকের ভেতরটা একেবারে খচ করে ওঠে।

অ্যান্টার্কটিকা কায়াক সম্পর্কে নানা কথা চালু আছে। কেউ বলেন এখানে কায়াকিং করতে চাইলে অনেক বড় অ্যাথলেট হতে হবে। বাস্তবে আমার সে রকম মনে হয়নি। এই সাগরের ঢেউ উঁচু নয়। এখানে পানি মসৃণ। গ্লাসের পানি যেমন শান্ত হয় সাগরের এই অংশের পানিও তাই। আমার অভয় বাড়ে।

আমাদের কায়াক শোভাযাত্রা ভালোই চলছে। চার–পাঁচ হাত ব্যবধানে ১০টি কায়াক। হঠাৎ গাইড বললেন, ‘আমরা আর সামনে এগোব না।’

তিমির ভয় নিয়েই অভিযাত্রীদের বইঠা বাইতে হলো
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

অদূরে দেখি ঝরনার মতো পানি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বেড়াচ্ছে তিমি। গাইড আগেই জানিয়েছিলেন, এই পোতাশ্রয়ে তিমি আছে। এখন তিনি বললেন, ‘আমরা বাঁ দিকের পাহাড়ের কিনারায় আশ্রয় নেব, দ্রুত। তিমি ছুটে আসতে পারে আমাদের দিকে।’

আমাদের চীনা সহ–অভিযাত্রী যে–ই না বা দিকে বাঁক নেওয়ার চেষ্টা করেছে, অমনি তার কায়াক কাত। পানি ঢুকে গেল। সে সাগরের পানিতে ছিটকে পড়ে আর কি! কোনোমতে কায়াক জড়িয়ে ধরে আটকে রইল। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের গাইডের সব মনোযোগ এখন তার দিকে। গাইড দ্রুত আমাদের কায়াক চালিয়ে নিয়ে গেল বিপন্ন অভিযাত্রীর কাছে। তার কায়াকে উঠে গিয়ে আমাকে বলল দ্রুত কায়াক চালিয়ে অন্যদের সঙ্গে পাহাড়ের পাদদেশে ভিড়তে। আমি ঘাবড়ে গেলাম, আমার বুক ধড়ফড় করছে। আমার শরীর হিম হয়ে যাচ্ছে—কারণ, অদূরে তিমি।

নদীপারের মেয়ে আমি, কর্ণফুলীর তীরে জন্মেছি। কিন্তু বইঠা হাতে নিয়েছি আজই প্রথম। আমার সমস্ত নির্ভরতা আমার গাইড, তাকে ছাড়া আমি অসহায়। সাধ্যমতো বইঠা টানছি। অন্যরা বেশ আগেই পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছে গেছে। আমার ভয়, আমাকে অনুসরণ করে আসছে আরেকজন, সে কোনো মানুষ নয়, তিমি। তিমিটি যদি আমার কায়াকটা উল্টে দেয়! ভয় পেলেও আমার দুই হাত সচল, আমি দাঁড় টানছি। অন্যরা যখন শিষ বাজিয়ে আমাকে অভিবাদন জানাচ্ছে তখন আমি টের পেলাম আমি তীরে ভিড়েছি। আমি স্বাভাবিক শ্বাস নিতে শুরু করলাম।

গাইড আমাকে ছেড়ে দেওয়ার পর চীনা অভিযাত্রীকে নিয়ে ব্যস্ত। মিনিটের মধ্যেই একটি জোডিয়াক নিয়ে হাজির আমাদের এক্সপেডিশন লিডারও। অভিযাত্রীকে উদ্ধার করে ভেজা কাপড়েই জাহাজে নিয়ে ফিরে গেল।

একটি সিল শুয়ে আছে পাহাড়ের পাদদেশে। দেখে মনে হচ্ছে নেশাখোরের মতো ঘুমিয়ে আছে। দুই হাতে বইঠা, তাই ছবি তোলার সুযোগ নেই। অন্যরাও কেউ ছবি তুলে দিতে পারছে না। একটু মন খারাপ হলো। কায়াকিংয়ের কোনো স্মৃতি থাকবে না! প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার একটি সুন্দর উপায় কায়াকিং। জোডিয়াকে বসে পানি স্পর্শ করা যায় না, কায়াকে বসে অ্যান্টার্কটিকার পানি এবং বরফের স্পর্শ নেওয়া যায়। সিল আর তিমিকে কাছ থেকে দেখা যায়। মোদ্দাকথা, অ্যান্টার্কটিকাকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়।

আরও পড়ুন

১. অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রা কীভাবে শুরু হয়?

২. ৭২ জন ‘গোপাল ভাঁড়ের’ সঙ্গে অ্যান্টার্কটিকা যাত্রা

৩. ‘তোমরা আমাকে যেকোনো সময় হাগ করতে পারো’

৪. আকাশে এখনো কোনো অ্যালবাট্রস পাখির দেখা মেলেনি

৫. অ্যান্টার্কটিকার জাহাজে খেতে দিল রুটি আর বেগুন ভাজি

৬. অ্যান্টার্কটিকায় প্রথম সন্তান প্রসব করেছিলেন যে নারী

৭. সাগরের পানিকে কেন বলা হতো কালাপানি

৮. অ্যান্টার্কটিকায় গিয়ে জাহাজ থেকে অভিযাত্রীদের যেভাবে নামতে হয়

৯. অ্যান্টার্কটিকায় পৌঁছে অভিযাত্রীদের মধ্যে আমিই প্রথম জাহাজ থেকে নামলাম

১০. দ্বীপটিতে পেঙ্গুইন ছাড়া আর কিছু নেই

১১. তিনটি তিমি আমাদের ঘিরে ধরল

১২. অ্যান্টার্কটিকায় যেভাবে উদ্‌যাপিত হলো জন্মদিন

১৩. পৃথিবীর সবচেয়ে দূরের ডাকঘর থেকে দুই ছেলেকে চিঠি পাঠালাম

১৪. মাসে মাত্র ১০০ শব্দের বার্তা পাঠাতে পারতেন তাঁরা, এতেই হতো যোগাযোগ