ধীরে চলা

>কথা ছিল, আমরা কেবল কুন্ডেরার ‘স্লোনেস’ উপন্যাসটি অনুবাদ করব না, এর গঠনশৈলী নিয়ে কথা বলব। মিলান কুন্ডেরা আমাদের সময়ের একজন প্রধান ঔপন্যাসিক। প্রতিবার নোবেল পুরস্কার ঘোষণার সময় আমরা আগ্রহের সঙ্গে কান খাড়া করে থাকি যে সাহিত্যে কুন্ডেরা নোবেল পুরস্কার পান কি পান না। চেক এই লেখক ‘জোক’ বা ‘ঠাট্টা’ উপন্যাস লিখে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। ‘ঠাট্টা’ ছিল সমাজতান্ত্রিক চেকোস্লোভাকিয়ার শ্বাসরোধী ব্যবস্থার সমালোচনা করে লেখা এক দুঃখের কাহিনি। এরপর আমরা তাঁর অনেক উপন্যাস পড়েছি, গল্প পড়েছি। আমার নিজের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে তাঁর প্রবন্ধের বই, ‘দ্য আর্ট অব দ্য নভেল’। সাহিত্য ও দর্শন নিয়ে তিনি আরও কয়েকটা নন-ফিকশন বই প্রকাশ করেছেন। যা-ই হোক, ‘স্লোনেস’ও তাঁর বিখ্যাত একটা উপন্যাস। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকায় বইটির ইতিবাচক আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে। এখন আমরা যা খেয়াল করছি, এই উপন্যাসে এখন পর্যন্ত নিজের কোনো গল্প নেই। নায়ক-নায়িকা গাড়ি করে প্যারিস ছেড়ে হোটেলে থাকবে বলে বেরিয়েছিল, তারা একটা হোটেলে উঠেওছে, কিন্তু আমরা আলোচনা করছি সাহিত্য নিয়ে, দর্শন নিয়ে। এর মধ্যে কিসিঞ্জারের প্রেমে পড়া এক নারী সাংবাদিকের লেখা এ-সম্পর্কিত বই নিয়েও আমরা আলোচনা করে ফেলেছি। দেখা যাক, কুন্ডেরা ১৬ নম্বর অধ্যায়ে এসে কী নিয়ে আলোচনা করেন

 ১৬
রুমটি ধীরে ধীরে পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। ফরাসি পতঙ্গবিদেরা আছেন। বিদেশিরাও এসেছেন। একজন চেক এসেছেন। কমিউনিজমের পতনের পর নতুন শাসনামল চলছে যে দেশটিতে, সেই দেশের কোনো মন্ত্রী হবেন হয়তো তিনি। বা বিজ্ঞান একাডেমির প্রধান বা কমপক্ষে সদস্য হতে পারেন। যা-ই হোক না, এই বিজ্ঞানী সমাবেশে তিনিই সবচেয়ে আগ্রহোদ্দীপক ব্যক্তি। কারণ, তিনি এসেছেন এক নতুন ইতিহাসের প্রতিনিধি হিসেবে। সময়ের কুয়াশা কমিউনিজমকে সরিয়ে দিয়েছে। গুঞ্জনরত ভিড়ের মধ্যে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, একা, লম্বা। লোকেরা তার কাছে যাচ্ছে, হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে, নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছে। কিন্তু তাদের কথা খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাচ্ছে, চারটা মাত্র বাক্য হয়ে গেলেই মনে হচ্ছে আর কোনো কথা নেই। তাঁরা বুঝতে পারছেন না আর কী বলা যায়। কারণ, তাদের কোনো অভিন্ন আলোচ্য বিষয় নেই। ফরাসিরা তাড়াতাড়ি তাদের নিজের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তিনি ফরাসিদের কথা খেয়াল করেন, তারপর বলা শুরু করেন, ‘অন্যদিকে আমাদের দেশে ঘটনা ঘটে এ রকম’...কিন্তু কেউই তার দেশ নিয়ে ভাবিত নয়। কারও আগ্রহ নেই এ কথা শুনতে যে, ‘অন্যদিকে আমাদের দেশে ঘটনা ঘটে এ রকম’...তিনি সরে যান, তার মুখটা বিষাদে ঢেকে যায়, কিন্তু তিনি ঠিক অসুখীও নন, তার মনের ভাবটা হলো, আচ্ছা ঠিক আছে, এদের আচরণে যুক্তি আছে, আমি না হয় একটু এদের পিঠ চাপড়েই দিলাম। 

সবাই যখন কথা বলতে বলতে লবিতে যাচ্ছে, বারে দাঁড়াচ্ছে, এই চেক ভদ্রলোক তখন একটা ফাঁকা ঘরে ঢুকলেন, এখানেই কনফারেন্সটা হবে, চারটা টেবিল চারদিকে বিছিয়ে একটা বর্গক্ষেত্র বানানো হয়েছে। দরজার পাশে একটা টেবিল। টেবিলে অংশগ্রহণকারীদের নামের তালিকা। তারপাশে তারই মতো একজন একলা পড়ে যাওয়া তরুণী। বিজ্ঞানী মেয়েটির কাছে যান। নিজের নাম বলেন। মেয়েটি নামের উচ্চারণ বুঝতে পারে না। আবার নাম বলতে হয়। মেয়েটি এবারও বুঝতে না পেরে তালিকার ওপরে চোখ বুলাতে থাকে, নিশ্চয়ই একটা নাম পাওয়া যাবে, যা এই ভদ্রলোকের নামের মতো উচ্চারণের হবে। তৃতীয়বার কাউকে নাম জিগ্যেস করা যায় নাকি!
পিতৃসুলভ সদিচ্ছা নিয়ে বিজ্ঞানী টেবিলে ঝুঁকে কাগজে চোখ বুলিয়ে নিজের নামের ওপরে আঙুল রেখে বললেন, ‘এই যে আমার নাম।’
‘আহ, মঁসিয়ে শেচোরিপি?’ তরুণীটি বলে।
‘এটার উচ্চারণ চেখোজিপস্কি।’
‘ওহ। এটা বেশ কঠিন একটা নাম।’
‘ঘটনাচক্রে নামটা ঠিকভাবে লেখাও হয়নি।’ বিজ্ঞানী কলম তুলে নেন, তার নামের দুটো অক্ষর সি আর আরের মধ্যে ওপরে একটা ছোট্ট টান দেন, যা দেখতে একটা ঊর্ধ্বকমার মতো।
সেক্রেটারি মেয়েটা একবার সেই দাগটার দিকে একবার বিজ্ঞানীটির দিকে তাকায়, ‘বলে, আহ, বেশ কঠিন আছে।’
‘একদম না। খুব সোজা।’
‘সোজা?’
‘তুমি নিশ্চয়ই জ্যান হাসকে চেনো?’
মেয়েটি আবার কাগজে তালিকার নামের দিকে তাকায়। চেক বিজ্ঞানী তাড়াতাড়ি করে বলতে থাকেন, ‘তুমি জানো, চতুর্দশ শতাব্দীতে তিনি ছিলেন একজন বিশাল সংস্কারক, চার্চের সংস্কারক, লুথারের পূর্বসূরি, লুথারকে চেনো তো, চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, পবিত্র রোমক সাম্রাজ্যের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সেটা, তুমি জানো। কিন্তু যা তুমি জানো জ্যান হাস ছিলেন একজন বিশাল বানানতত্ত্ববিদ। তিনি বানানকে সহজ করে দিয়েছেন। তোমাদের ভাষায় দরকার হয় তিনটা অক্ষর tch, জার্মান ভাষায় লাগে চারটা অক্ষর, t, s, c, h; কিন্তু জ্যান হাস কী করলেন, মাত্র একটা অক্ষর ব্যবহার করলেন, c আর ওপরে একটা ছোট্ট রেফের মতো বসিয়ে দিলেন। ব্যস হয়ে গেল।’
বিজ্ঞানীটি আবারও টেবিলের ওপরে উপুড় হলেন, কাগজ-কলম নিলেন, তালিকার নিচে তিনি একটা C লিখলেন বিশাল বড় করে, তার ওপরে একটা ছোট্ট ভি-এর মতো চিহ্ন বসিয়ে দিয়ে বললেন, হয়ে গেল ‘Tch!’
সেক্রেটারিটা বিজ্ঞানীর চোখে তাকাল, বলল, ‘Tch!’
‘হ্যাঁ। একদম ঠিক!’
‘এটা তো খুব কাজের। খুব খারাপ, তোমার দেশের বাইরে কেউ লুথারের এই সুন্দর সংস্কারের কথা জানেই না!’
‘লুথার নয়। জ্যান হাস। তবে আর কোনো দেশে এটা জানে না, তা কিন্তু নয়। আমাদের দেশের বাইরে একটা দেশে এটা ব্যবহৃত হয়। তুমি জানো সেটা কোন দেশ?’
‘না। জানি না।’
‘লিথুয়ানিয়া।’
‘লিথুয়ানিয়া!’ সেক্রেটারিটি বিড়বিড় করে। পৃথিবীর কোন প্রান্তে এই দেশ, সে জানেই না।
‘এবং লাটভিয়াতেও এটা আছে। তাহলে তুমি দেখো কেন আমরা চেক নাগরিকেরা এই ছোট্ট একটা দাগ নিয়ে এত গর্বিত। আমরা সব ছাড়তে রাজি আছি, কিন্তু এই ছোট্ট একটা দাগ আমরা ছাড়ব না, শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও এই একটা ছোট্ট দাগকে আমরা রক্ষা করে যাব।’
তিনি সেক্রেটারি মেয়েটার সামনে মাথাটা একটু নোয়ালেন, তারপর চললেন চারদিকে চারকোনা করে বসানো টেবিলের দিকে। টেবিলে অংশগ্রহণকারীদের নামের ফলক বসানো। তিনি নিজের নাম খুঁজে বের করলেন। তারপর সেটার দিকে তাকালেন দুঃখী চোখে। কিন্তু এটাই তো হওয়ার কথা। নামের ফলকটা তুলে নিয়ে সে চলল সেক্রেটারির কাছে।
এরই মধ্যে আরেকজন বিজ্ঞানী এই অভ্যর্থনা টেবিলে চলে এসেছেন। তিনি তাঁর নাম খুঁজছেন। চেক বিজ্ঞানীকে আসতে দেখে সেক্রেটারি মেয়েটি বলল, ‘একটা মিনিট, মসিয়েঁ চিপিকি!’
চেক বিজ্ঞানী এমন ভাব দেখালেন যে তিনি ব্যাপারটা বুঝছেন! ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমার তো কোনো তাড়া নেই, মিস!’ তিনি ধৈর্য ধরে টেবিলের ধারে দাঁড়িয়ে রইলেন। তবে ভদ্রতার সীমা তিনি অতিক্রম করলেন না। এরই মধ্যে আরও দুজন পতঙ্গবিদ মেয়েটির টেবিলে এসে নিজেদের নাম খুঁজে নিলেন। অবশেষে সেক্রেটারি যখন নিস্তার পেল, চেক বিজ্ঞানী তার নামের ফলকটি এগিয়ে দিলেন। বললেন, ‘দেখেন, মজাটা! আমি যেমনটা বলছিলাম!’
মেয়েটি বুঝতে পারল না ভদ্রলোক ঠিক কী বলতে চান, বলল, ‘মসিয়েঁ চেনিপিকি, আমি তো দেখছি আপনার নামের উচ্চারণমতোই আপনার নাম এখানে লেখা!’
‘হ্যাঁ। কিন্তু যেটা বলছিলাম। ওই যে একটা ঊর্ধ্বকমার মতো চিহ্ন, স্বরবর্ণের ওপরে বসবে ইংরেজি ভি-এর মতো। সেটা যেখানে দিতে হবে, সেখানে দিতে ঠিকই এরা ভুলে গেছে। আর দিয়েছে ভুল জায়গায়।’
‘আপনি ঠিকই ধরেছেন।’ মেয়েটি যেন রেগে গেছে, এই রকমভাবে বলল।
‘কেন লোকে সব সময় এটা ভুলে যায়।’ চেক বিজ্ঞানী বিষণ্ন কণ্ঠে বললেন—‘এই চিহ্নটা এতটাই কাব্যিক, তুমি কি তা মনে করো না? ডানা মেলা পাখির মতো, শান্তির পায়রার মতো।’ কণ্ঠস্বরে আরও আদুরে ভঙ্গি ফুটিয়ে তিনি বললেন, ‘এই চিহ্নটা প্রজাপতির মতো।’
তিনি আবারও টেবিলে ঝুঁকলেন, কলম তুলে নিলেন হাতে, তার নামফলকের ওপরে কলম চালিয়ে ঠিক জায়গায় ঠিক চিহ্নটা বসিয়ে নিলেন। এমন বিনয়ের সঙ্গে তিনি তা করলেন যেন তিনি ক্ষমা চাইছেন। তারপর আর কিছু না বলে তিনি ফিরে গেলেন।
সেক্রেটারি মেয়েটি লোকটার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। লম্বা একটা লোক, বেঢপ আকার, মেয়েটির মনে মাতৃত্বের স্নেহের প্রাবল্য দেখা দিল। সে দেখতে পেল, একটা চিহ্ন, প্রজাপতির মতো পাখা দাপাচ্ছে, উড়ছে, শেষে তা গিয়ে বসল লোকটার নামফলকের ওপরে।
বিজ্ঞানী যখন তার আসনের দিকে যাচ্ছেন, ফিরে তাকালেন সেক্রেটারির দিকে, দেখতে পেলেন, মেয়েটা স্নেহপূর্ণ হাসি ধরে আছে তার মুখে। তিনিও উত্তরে হাসলেন। তিনি নিজের আসনে যাওয়ার পথে মোট তিন দফা হাসি উপহার পাঠালেন মেয়েটিকে। এই হাসি বিষাদমাখা, কিন্তু তাতে গর্বও আছে। বিষণ্ন গৌরব: একজন চেক বিজ্ঞানীকে বর্ণনা করার জন্য এই দুটো শব্দই উপযুক্ত।
[আপনাদের অনুবাদক আনিসুল হক বলছি। মিলান কুন্ডেরা নিজে চেক। এই উপন্যাস যখন তিনি লেখেন, তখন তিনি ফ্রান্সে থাকেন। এই উপন্যাসটিও ফরাসি ভাষায় লেখা। কিন্তু তার বেশির ভাগ গল্প-উপন্যাসের প্রেক্ষাপট চেক, চেকোস্লোভাকিয়া, সমাজতন্ত্রের আমলের প্রাগ। এই জন্য আমি প্রস্তুতি নিচ্ছি, এরপর কুন্ডেরা সমাজতন্ত্র আর চেকোস্লোভাকিয়া নিয়ে কিছু লিখবেন। দেখা যাক! তাতে সোভিয়েত আগ্রাসনের নিন্দা থাকবে। আপনারা যারা আমার লেখা গদ্যকার্টুন পড়েন, তাদের মনে থাকবে, স্টালিনের পুত্র জ্যাকব কেন মারা গিয়েছিল, এই নিয়ে আমি কুন্ডেরার বই থেকে একটা অংশ অনুবাদ করে দিয়েছিলাম। ঘটনা ছিল এ রকম:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জ্যাকব ছিলেন মিত্রবাহিনীতে। তিনি টয়লেটে গিয়ে দেখেন, টয়লেট নোংরা। তিনি তাঁর অফিসারকে অভিযোগ করেন, আমি স্টালিনের ছেলে, এই নোংরা টয়লেটে বর্জ্য ত্যাগ করতে পারব না। অফিসার তাঁকে বলেন, নিজেই পরিষ্কার করে নাও। জ্যাকব সেটা করতে অস্বীকৃতি জানান। অফিসার তাঁকে শাস্তি দেন। রাগে-দুঃখে জ্যাকব ঝাঁপিয়ে পড়েন কাঁটাতারের বেড়ায়। সেটা ছিল বিদ্যুতায়িত। জ্যাকব মারা যান। লেখক মিলান কুন্ডেরা বলেছেন, জ্যাকব মারা গেছেন গুয়ের জন্য। হি ডায়েড ফর শিট।
কুন্ডেরা বলেন, যে সোভিয়েত সৈন্যরা পূর্ব ইউরোপ দখল করার জন্য নিজেদের জীবন দিয়েছিল, তারাও মারা গিয়েছিল গুয়ের জন্য]

আরও পড়ুন: