আমি আর নিম্মি

ফাইনাল পরীক্ষা নির্বিঘ্নে শেষ করতে পারি আমি। পরীক্ষার সময় নাহিদের সঙ্গে যেতে চেয়েছিলাম। সে প্রথমে রাজি হয়েছিল। তারপর যখন বুঝতে পারল, ভয়ে বলছি এটা, রেগে গেল। মনে হলো যেন তাকে অপমান করা হলো কথাটা বলে। ফাইনাল পরীক্ষার কয়েক দিন আগে হলের মধ্যেই হলের সেক্রেটারি গ্রুপ আর প্রেসিডেন্ট গ্রুপের মধ্যে ঝগড়া হয় ছোটখাটো। হলের একটা সিটে ছাত্র ওঠানো নিয়ে হয় গন্ডগোলটা। নাহিদ নাকি সেখানে প্রেসিডেন্ট গ্রুপের সিনিয়র একটা ছেলেকে চড় মেরেছিল।

সেটা কোনো সমস্যা না। তবে চড় মারার পরপর তার মধ্যে ‘যে কাউকে চড় মারতে পারি’ ধরনের ভাব এসেছে। পিস্তলটা আর আমার জিম্মায় না রেখে প্রায় সারাক্ষণ নিজের কাছে রাখে। আমার একটু ভয়ই লাগে এখন ওর হাবভাব দেখলে।

তবে পরীক্ষা নিয়ে সে আমার ওপর খুব খুশি থাকে। আমি অনেক বুদ্ধি করে কী কী প্রশ্ন আসতে পারে, তার লিস্ট করেছিলাম তার জন্য। প্রতিটা পরীক্ষার শুরুতে প্রথম দেখতাম, আমার তালিকা থেকে প্রশ্ন এসেছে কি না। প্রতিবারই প্রশ্ন দেখার পর একটা করে পাথর নেমে যেত আমার বুক থেকে। মনে হতো, ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’ টাইপের প্রতিযোগিতায় জিতে যাচ্ছি একটার পর একটা রাউন্ড। এত নিখুঁত হয় আমার তালিকা যে নিজেই মুগ্ধ হয়ে যাই।

ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলে পুরো ক্যাম্পাসে মোটরসাইকেলের মহড়া দিই আমরা। শীতের দিন, হু হু করে বাতাস এসে রোদের আবরণ কেটে শরীরে কাঁপন তোলে—এমন ছিল সেদিন। জ্যাকেট আর কপাল ঢাকা টুপি পরি, চোখে সানগ্লাস। মোবাইলে একটা সেলফি তুলি। নিজের মার মার কাট কাট ছবিটা দেখে মিথিলাকে তা পাঠানোর কথা ভাবি। পরক্ষণেই ভাবি, এ ছবির মূল্য আসলে বুঝবে নিম্মি।

মহড়া চলাকালে আব্বাসদের হলের সামনের রাস্তা দিয়ে যাই বহুদিন পর। আমার পেছনে পকেটে পিস্তল নিয়ে হাঁটুতে হাতের ভর দিয়ে বসে আছে নাহিদ। এটা মনে হতেই খামাখা কয়েকটা ফলস স্টার্ট দিই। আব্বাসদের হলের প্রতিটা ছেলের শুনতে পাওয়ার কথা আমার এ কর্কশ হুংকার।

মহড়া শেষ হলে নাহিদ আমাকে মোটরসাইকেলটা রাখতে বলে। চাবিটাও বুঝিয়ে দেয়। জানায় যে সে নতুন একটা মোটরসাইকেল ডেলিভারি পাবে। এখন থেকে পুরোনোটা আমার কাছেই থাকবে। আমার বিশ্বাস হয় না, কিন্তু অবিশ্বাসই-বা করি কী করে?

আনোয়ার চাচার বাসায় যাই মোটরসাইকেলে করে। আমাকে দেখে রাতে থাকতে পারি, কেউ এমন ভয় পাওয়ার আগেই চাচিকে বলি, ‘এমনি এসেছি। এ পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম, তাই আরকি।’ তিনি আমার হাবভাব দেখে কৌতূহলী হন। জিজ্ঞেস করেন, চাকরি করছি নাকি এখন আমি।

আমি এমনভাবে মাথা নাড়ি, যাতে মনে হয় হ্যাঁ-না দুটোই হতে পারে। তাঁর উৎসাহ আরও বেড়ে যায়। জিজ্ঞেস করেন, ‘কত টাকা বেতন?’

কী বলি আমি? চাচির কথা শুনে মনে হচ্ছে, ‘হতে পারে জামাতা’ সম্পর্কে ঘটকের কাছে খোঁজ নিচ্ছেন। এখন ওনাকে আমি সত্যি কথাটা বলি কীভাবে?

বলি, ‘চাচি, এখনো ফিক্সড হয়নি। তবে ভালোই দেবে মনে হচ্ছে, বড় কোম্পানি।’

চাচি আমার জন্য খাবার আনতে চলে যান। একটু পরই ভ্রু কুঁচকে নিম্মি ঢোকে। আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার দৃষ্টি বোলায়। বলে, ‘ও মাই গড! আপনার নাকি চাকরি হয়েছে? হঠাৎ এত কিছু!’

পাতলা কাপড়ের সালোয়ার-কামিজ পরে আছে নিম্মি। ভেতরে লাল রঙের ব্রা। মুখের দুপাশ ঢেকে আছে চুলের বন্যায়। তার চোখে অতি জীবন্ত, অতি বুদ্ধিদীপ্ত ও অতি ধারালো একটা দৃষ্টি আছে। কখনো সেখানে বেশিক্ষণ তাকানোর মতো মনের জোর হয়নি আমার। আজ স্থির চোখে সেখানে তাকিয়ে হাসি। আবার সে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। তবে এই তাকানোটা অন্য রকম। মনে হয়, তার অতি জীবন্ত চোখ বলে উঠল, ‘ওরে বাবা, এত সাহস হয়েছে আপনার এখন!’

যেন সে আমার সাহস পরীক্ষা করার জন্যই বলে, ‘ট্রিট দেন একটা। কবে দেবেন?’

এক সেকেন্ড আমার মাথা খালি হয়ে যায়। ট্রিট দেওয়া মানেটা কী, ঠিক বুঝতে পারি না। শুধু বলি, ‘অবশ্যই। কবে দেব বলো!’

‘আজকেই!’

কথাটা এমনভাবে বলে, যেন আমাকে চ্যালেঞ্জ করছে সে। ঠিক তখনই আমি বুঝতে পারি যে ট্রিট দেওয়া মানে খাওয়ানো।

আমার সঙ্গে খেতে যেতে চাইছে নিম্মি! হঠাৎ আমার বুক ধকধক করতে থাকে। তার সরু হাত, লম্বা লম্বা আঙুল, গোলাপি রঙের নেইল পলিশের দিকে চোখ আটকে যায়।

নিম্মি হাসে, ‘টাকা নাই?’

এই প্রশ্নে আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে আমার। আমার কাছে টাকা থাকে এখন। নাহিদ তার টাকা রাখে আমার কাছে মাঝে মাঝে। শুনি, এসব টাকা হলের কন্ট্রাক্টররা দেয়, দোকানের মালিকেরা দেয়। নাহিদকে দেয়, আরও কাউকে কাউকে দেয়। নাহিদরা বিনিময়ে নিরাপত্তা দেয় ওদের। তা ছাড়া ওদের হাতে রাখে বলে কন্ট্রাক্টর কাজও পায় বেশি দর দিয়ে। জটিল জটিল অঙ্ক আছে এখানে। এত বোঝার চেষ্টা করি না। নাহিদ আমার কাছে টাকা জমা রাখে কেন, তা-ও জানতে চাই না। হয়তো বোঝে, বেইমানি করার সাহস আমার হবে না। সেখান থেকে অল্প কিছু টাকা খরচ হলে সেটা ঠিক বেইমানি হবে না। সে একবার আমাকে বলেছিল, লাগলে খরচ করতে।

নিম্মি মোটরসাইকেলে বসে আমার থেকে দূরত্ব রেখে। রাস্তার একটা জায়গায় কংক্রিট ফেটে আছে দেখে মোটরসাইকেলে ব্রেক করি। সে আমার পিঠে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আমি সরি বলার সঙ্গে সঙ্গে সে আমার কাঁধে জোরে জোরে দুটো থাপ্পড় মারে। বলে, ‘চালাকি করো?’

মুখ ঘুরিয়ে দেখি, হাসছে সে। তার মানে হচ্ছে, চালাকি আমি করতে পারি তার সঙ্গে। একবার করিও। জোরে ব্রেক করার পর সে আমাকে জাপটে ধরে জোরে। তারপর কানের কাছে মুখ এনে বলে, ‘লাভ নাই কোনো। আমার প্রেম আছে!’

উপন্যাস

ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনযাপন, রাজনীতি, প্রেম—সব মিলিয়ে আসিফ নজরুল লিখেছেন আমি আবু বকর উপন্যাসটি। এতে আছে এক দহনকালের উপাখ্যান। উপন্যাস থেকে অংশবিশেষ।

আমি আবু বকর

আসিফ নজরুল

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা

প্রচ্ছদ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

দাম: ৩৫০ টাকা।

এখানে একটা আইসক্রিমের দোকান আছে। গরিব থাকার সময় দূর থেকে দেখতাম। আজ সেখানে ঢুকি বুক ফুলিয়ে। সে ঘুরে ঘুরে দোকানটা দেখে। আমার সামনে বসে ফোনে কথা বলে কারও সঙ্গে। কান খাড়া রাখি। কথাবার্তার ধরনে মনে হয় না যে লম্বা চুলওয়ালার সঙ্গে কথা বলছে সে।

টেবিলের ওপর আইসক্রিম দেওয়া হয়েছে। তারটা স্ট্রবেরি, আমার চকলেট। সে তার লালচে, ভেজা ও চঞ্চল ঠোঁট দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে স্ট্রবেরি আইসক্রিমটার স্বাদ পরীক্ষা করে। আমি বলি, ‘প্রেম সত্যিই আছে?’

আমার মনে হয়েছিল প্রশ্নটা শোনেনি সে বা বোঝেনি হঠাৎ। আসলে সেটা ঠিক না। আমি প্রশ্নটা করার পর অনেকটা আইসক্রিম একসঙ্গে মুখের ভেতর নিয়ে সে চোখ বন্ধ করে রাখে। তার চেহারা দেখে মনে হয়, এর চেয়ে মজার জিনিস কোনো দিন খায়নি সে। প্রশ্নটা আবার করব কি না ভাবছি, এমন সময় সে চোখ খুলে আমার দিকে তাকায়। বলে, ‘ইরেশের সঙ্গে আছি, ইরেশ।’ সে দুহাত পেছনে চুলের কাছে ধরে লম্বা চুলের ভাব করে। তারপর বলে, ‘কিন্তু সে একটা শয়তান। আরেকটা মেয়ের সঙ্গে তার রিলেশন। বলে, আমাদের দুজনকেই নাকি সে ভালোবাসে।’

নিম্মি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বলে, ‘ইরেশকে বলেছি, তুমি কী করো না করো আমার জানার দরকার নেই। কিন্তু নেক্সট টাইম যদি জানি, রিলেশন শেষ। আর বলেছি, আমি কী করি, সেটাও তুমি আর জানবে না এখন থেকে।’

অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি তার পরের কথাগুলো শোনার জন্য। কিন্তু সে আর কিছু বলে না বরং আইসক্রিম পারলারের কাচের দেয়াল দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাইরে কর্মব্যস্ত শহর, আটকে থাকা অনেক বাস। তার ফাঁকে ফাঁকে রিকশা, সিএনজি, গাড়ি। তাদের মাথার ওপর দানবের রাস্তার মতো উড়ালসড়কের ব্লক। এত ওপরে, তারপরও সেখানটা ছেয়ে আছে বড় বড় মাথার ছবির নানা রঙের পোস্টারে। ওপরে পানসে রোদের আকাশ, ফানুসের মতো কিছু একটা স্থির হয়ে আছে উড়ালসড়কের পেছনে, আকাশের মাঝামাঝি জায়গায়।

নিম্মির হাতের ওপর হাত বোলাই। সে মুখ নিচু করে সেদিকে তাকায়। তারপর বলে, ‘তুমি কি চিট টাইপের?’

চট করে বলি, ‘না তো!’

‘সাধু তুমি না!’ হাসে নিম্মি, ‘আসলেও চিট না?’

এবার আর কিছু বলি না। এমনভাবে মাথা নাড়ি, নিজেই অর্থ বুঝতে পারি না।

‘কারও সঙ্গে চিট করেছ? নাকি এখনো করছ?’

সে এমনভাবে বলছে, যেন চিট করাটা বেশ পুরুষালি কোনো বিষয়। এবার তাই বিনা দ্বিধায় বলি, ‘আগে করেছি। মিথিলা নামের একটা মেয়ের সঙ্গে।’

এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়, তার নাম বলা ঠিক হয়নি আমার। কেন ঠিক হয়নি, তা অবশ্য চিন্তা করে ঠিকমতো বুঝতে পারি না।

নিম্মি নামটা খেয়াল করেছে। বলে, ‘মিথিলা! নায়িকা মিথিলা নাকি!’ নিম্মি হাসে, ‘আমার সঙ্গে চিট করবে?’

‘তুমি দেবে করতে?’

কৃত্রিম বিস্ময়ে হাঁ হয়ে যায় তার মুখ। ‘ওরে বাবা, স্মার্ট হয়ে যাচ্ছ তো তুমি!’

সে এবার তার আরেকটা হাত আমার হাতের ওপর রাখে। তার দুহাতের মাঝখানে এখন আমার হাত। টেবিলের ওপর মুখ নামিয়ে তার হাতে চুমু দিই।

মুখ তুলে দেখি, সে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। হাসে, ‘চিট! দুনিয়ায় সবাই চিট, বুঝছ?’

মাথা নাড়ি। বুঝেছি।

নিম্মি আসলে ঠিকই বলেছে। আমিও চিট, মিথিলার সঙ্গে যা করেছি, সেটা তো চিটিংই। ভাবতে চাই না, তবু তার মুখ ভেসে ওঠে নিম্মির মুখের ওপর।

আমাদের আর কথা এগোয় না। মনে হয় অমীমাংসিত একটা রাস্তায় কিছুদূর হেঁটে হঠাৎ আমরা দেখি সামনে আর এগোনোর নেই কিছু। এমনি এমনি ব্যস্ত থাকার জন্যই হয়তো নিম্মি স্ট্রবেরি আইসক্রিম শেষ করে একটা সবুজ রঙের আইসক্রিম নেয়। মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে সেটায় একটু গুঁতোগুঁতি করে। তারপর বলে, ‘চলো, বাসায় দিয়ে আসো।’

‘আরেকটু থাকো না। মনটা ভালো নেই তোমার।’

‘মন ভালো আমার।’ নিম্মি ব্যাগটা কাঁধে ফেলে উঠে দাঁড়ায়। হালকা গলায় বলে, ‘আর শোনো, বেশি চান্স নিয়ো না, ঠিক আছে? ইরেশ তোমার চেয়ে অনেক স্মার্ট!’

দাঁড়াতে দাঁড়তে বলি, ‘ও তো চিট!’

‘তুমিও তো চিট। তুমি বলেছ।’

‘তোমার সঙ্গে চিট করব না।’

‘এগুলো সবাই বলে। চলো এখন।’

ফেরার পথে মোটরসাইকেল আর ব্রেক করি না। বুঝতে পারি, পেছনে বসে থাকলেও সে আর নেই আমার সঙ্গে। বিদায় নেওয়ার সময় ‘লম্বা চুলওয়ালাকে কবে পেটাতে হবে,’ এ ধরনের কিছু বলতে গিয়ে থেমে যাই। বিদায়কালে যে রকম কথা বললে মনে হয় আমাদের একটা সম্পর্ক হচ্ছে, সে রকম কিছু বলে না সে। এমনকি একবারও পেছন ফিরে চায় না।

এরপরও মাঝে মাঝে ফোন করি তাকে। সে একদিন কথা বললে দুদিন কেটে দেয়। তাকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম। সেটা সে অ্যাকসেপ্ট করার পর মনে মনে তাকে নিয়ে নানা কিছু কল্পনা করার চেষ্টা করি। কিন্তু জমে না সেটা। একদম ভিত্তিহীনভাবে কল্পনা করার মতো সৃজনশীলতা নেই আমার। বুঝতে পারি, মিথিলার মতো সহজ হবে না তাকে পাওয়াটা। না বাস্তবে, না আমার কল্পনায়।

উপনিবেশবাদ ও বাঙালির সংস্কৃতি