মৃদুল মধুর সন্তরণ
হেরোডোটাসের ‘ইতিহাস’, ইতিহাসের হেরোডোটাস
জীবন এত ছোট কেন? এই আক্ষেপ নেই, এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। অথচ জীবন উপভোগের উপকরণ কত বিপুল! জানার–বোঝার, দেখার–শোনার, পড়ার–সক্ষমতার অপরিসীম সীমাবদ্ধতা নিয়েই বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে জি এইচ হাবীব -এর নিয়মিত পাক্ষিক— মৃদুল মধুর সন্তরণ
‘ইতিহাসের জনক’ হিসেবে অনেকেই এই গ্রিক ভদ্রলোককে একনামে চেনেন। তবে তাঁর জন্ম কিন্তু গ্রিসে নয়। এশিয়া মাইনরের উপকূলব্যাপী বিস্তৃত বেশ কিছু গ্রিসীয় নগরের একটি, হেলিকারনেসাসে। নাম তাঁর হেরোডোটাস। জন্ম ৪৯০ থেকে ৪৮০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে কোনো এক সময়ে। এই দশ বছরের মধ্যে পারসিকরা গ্রিসের মূল ভূখণ্ডে প্রথম ও দ্বিতীয়বার আক্রমণ করে এবং এ বিষয় নিয়েই হেরোডোটাস রচনা করেন ‘ইতিহাস’ নামে তাঁর ভুবনবিখ্যাত বইখানা।
তাঁর জন্মের সময় হেলিকারনেসাস ছিল গ্রিসের বেশ কিছু উপনিবেশের একটি, আর সেটা ছিল পারসিকদের পদানত। স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার জন্য তারা যে নানাভাবে চেষ্টা চালিয়েছিল, সেটাই ছিল পারসিক সম্রাটের বিরুদ্ধে বড় বড় সব যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার প্রধান কারণ। ৪৮০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে, পারস্য সম্রাট দারিউসের বিশাল সৈন্যবাহিনীকে হঠিয়ে দেওয়ার ফলে গ্রিক নগরগুলো মুক্ত হয়ে গেলে বেশ খানিকটা সময়জুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা নেমে আসে এবং তরুণ হেরোডোটাসকে নির্বাসনে যেতে হয়। তাঁর পরিবার বেশ অবস্থাসম্পন্ন হওয়াতে, ভ্রমণের সংগতি হেরোডোটাসের যথেষ্টই ছিল। ফলে নির্বাসনের ‘সুবাদে’ তিনি কয়েক বছর ধরে মিসর, ফিলিস্তিনসহ ভূমধ্যসাগরীয় পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে, আর মেসোপটোমিয়া অবধি ঘুরে বেড়ান।
সম্ভবত এই সময়েই পারস্যের সঙ্গে সেই বিরাট যুদ্ধের ইতিহাস রচনা করার চিন্তা মাথায় আসে তাঁর। কিন্তু পরে তাঁর এই পরিকল্পনা আরও বিস্তৃত লাভ করে এবং তিনি দ্বিতীয়বারের মতো মিসর সফর করেন; দক্ষিণে আসোয়ান ও পশ্চিমে সাইরেনেইকা (লিবিয়ার পূর্বাঞ্চল) অবধি চলে যান। সেই সঙ্গে কৃষ্ণসাগর এলাকাতেও পা ফেলেন; সেখানের গ্রিক উপনিবেশগুলোর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ঘটে; পরিচয় ঘটে যাযাবর সিথীয়দের সঙ্গে। একাধিকবার এথেন্স ভ্রমণ করেন তিনি; সেখানে বিখ্যাত এথেনীয় রাজপুরুষ পেরিক্লিজের সঙ্গে পরিচিত হন। এথেন্সে, ৪৪৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তিনি তাঁর ‘ইতিহাস’ বইটি থেকে অংশবিশেষ জনসমক্ষে পাঠ করে শোনান এবং সে জন্য পুরস্কার হিসেবে সরকারি তোশাখানা থেকে দশ ট্যালেন্ট (বর্তমান বাজারে সোয়া তিন লাখ টাকার বেশি) লাভ করেন। পরবর্তীকালে তিনি দক্ষিণ ইতালিতে অবস্থিত গ্রিক উপনিবেশ থুরিতে থিতু হন। তবে তিনি কখনো রোম বা এট্রুসকান কোনো নগরে পা রেখেছিলেন বলে মনে হয় না। আর তাঁর বইয়ে ৪২৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের পরের কোনো ঘটনার উল্লেখ নেই। ধারণা করা হয়, এর চার–পাঁচ বছর পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বলা যেতে পারে, তাঁর জীবনের একটা বড় অংশই কেটেছে পথে পথে। আর এই পথচলার উদ্দেশ্য ছিল তাঁর ‘ইতিহাস’ গ্রন্থ রচনা করা।
আগেই বলা হয়েছে, গোড়াতে তিনি কেবল সেই মহাযুদ্ধ নিয়েই লিখতে চেয়েছেলেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এবং পরিচিত বিশ্বের নানা স্থানে ভ্রমণের ফলে তাঁর সিদ্ধান্ত বদলে যায়। তিনি ঠিক করেন, সেই মহা সংগ্রামে সংশ্লিষ্ট জাতিগুলোর ইতিহাস, ভূগোল, এথনোগ্রাফি, ধর্ম, সামাজিক রীতিনীতি, ইত্যাদি সম্পর্কে যত তথ্য তাঁর পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব হবে তাঁর সবই তিনি তাঁর গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করবেন। তার ফলে আমরা পেয়ে যাই প্রাচীনকালের অন্যতম এক অনবদ্য গ্রন্থ।
‘ইতিহাসের জনক’ তো বটেই, খুবই সংগত কারণে তাঁকে ‘ভূগোলের জনক’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা যায়। স্পষ্টতই তিনি ছিলেন অত্যন্ত অনুসন্ধানী মনের অধিকারী এবং প্রায় ৬০ বছরের জীবনে যেসব অভিজ্ঞতা তিনি অর্জন করেছেন, যা কিছু দেখেছেন বা শুনেছেন, তার প্রায় সবই নিজের গ্রন্থ রচনার মাল-মশলা হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বইটি গ্রিক ভাষায় লেখা, এশিয়া মাইনরের পশ্চিম তীরবর্তী গ্রিক উপনিবেশগুলোতে যে আয়োনীয় উপভাষা ব্যবহৃত হতো, সেই ভাষায়। শৈলীগত দিক দিয়ে ‘ইতিহাস’ অনাড়ম্বর, প্রাঞ্জল ও পরিশীলিত।
হেরোডোটাসের আগে কোনো গ্রিক ইতিহাসবিদ, ভৌগোলিক বর্ণনাকারী আর জনপ্রিয় গল্পগাথা বলা মানুষ যে ছিলেন না তা নয়, কিন্তু তাঁর কৃতিত্ব হচ্ছে তিনি তাঁর বর্ণনায় এই তিনটি উপাদানই যুক্ত করতে পরেছেন। এটা বিশেষ করে লক্ষ করা যায় তাঁর বইয়ের প্রথম খণ্ড বা পর্ব ‘ক্লিও, ইতিহাসের মিউজ’-এ।
বইটি শুরু হয় একটি ঘোষণা বা বিবৃতি দিয়ে। সেই ঘোষণা অনুযায়ী, বইটি হচ্ছে হেলিকারনেসাসের হেরোডোটাস যেসব বিষয় আবিষ্কার করতে পেরেছেন, তারই একটি প্রতিবেদন এবং গ্রিক ও বর্বরেরা (অর্থাৎ যারা গ্রিক নয়) যেসব বড় বড় ও আশ্চর্যজনক কাজ করেছে, সেগুলো যেন কেউ ভুলে না যায়, সে জন্যই এটি লেখা হয়েছে। এরপর লিডিয়াতে (মধ্য এশিয়া মাইনরে, বর্তমান তুরস্কের একটি লৌহ যুগের রাজ্যে) কীভাবে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলো তার এক দীর্ঘ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে; এরপর রয়েছে, পারসিক রাজা সাইরাসের হাতে সেই রাজতন্ত্রের উৎখাতের বিবরণ। এই ঐতিহাসিক অংশের বর্ণনায় আরও রয়েছে পারসিকদের হাতে আয়োনিয়ার গ্রিক উপনিবেশগুলোর পতন এবং কাস্পিয়ান সাগরের পার্শ্ববর্তী একটি অ-গ্রিক উপজাতি মাসাগেতেদের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে শেষ অবধি সাইরাসের মৃত্যুর কাহিনি।
এই ঐতিহাসিক (বা ঐতিহাসিক বলে দাবি করা) বিষয়ের মধ্যে বেশ কিছু গল্পগাথাও ঢুকে পড়েছে। কিন্তু আকর্ষণীয় হলেও এই গল্পগুলো ঠিক ততটা মূল্যবান নয়, যতটা সেই সব অনুচ্ছেদ যেখানে তিনি তাঁর আখ্যানে ঠাঁই পাওয়া অসংখ্য জাতির কোনো কোনোটির আচার-আচরণ ও রীতিনীতির বর্ণনা দিয়েছেন।
প্রথমেই রয়েছে লিডীয়রা। আমাদেরকে আশ্বস্ত করা হয়, তাদের রীতি-প্রথা অনেকেটাই গ্রিকদের মতো। তফাত শুধু, তারা তাদের কন্যাদের এমনভাবে লালন-পালন করে, যাতে তারা বড় হওয়ার পর দেহপসারিণী হিসেবে কাজ করে নিজের বিয়ের জন্য যথেষ্ট যৌতুক জোগাড় করতে পারে। এবং যথেষ্ট অর্থকড়ি সংগ্রহ হয়ে গেলে তারা নিজেদের বিয়ের যোগ্য বলে ঘোষণা করে। প্রথা প্রচলিত অভিজাত শ্রেণিতে জন্মগ্রহণ করা মেয়েদের জন্য। তারাই প্রথমে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা তৈরি করে এবং হেরোডোটাসের বক্তব্য অনুযায়ী তারাই ছিল প্রথম বণিক, যদিও দ্বিতীয় দাবিটি (সম্ভবত) ঠিক নয়। তাদের উদ্ভাবিত মুদ্রা ও খুচরা দোকানগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ধরনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছিল। খাদ্যশস্য আর পণ্য বিনিময় তখনো প্রচলিত ছিল বটে, কিন্তু ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে প্রমিতায়িত স্বর্ণ আর রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন ঘটিয়ে লিডীয়রা ব্যবসা-বাণিজ্য আরও কার্যক্রম ও সুগম করেছে। বিভিন্ন খেলা আবিষ্কার করেছিল তারা; সত্যি করে বললে একমাত্র ড্রাফটস ছাড়া সব খেলারই আবিষ্কর্তা তারা। এবং কাজটা তারা করেছিল তখন সেখানে দেখা দেওয়া এক দুর্ভিক্ষর কালে অবসর কাটাতে ও ক্ষুধার জ্বালা ভুলতে।
এরপর রয়েছে পারসিকরা। ‘আমার জানামতে, পারসিকরা নিম্নলিখিত রীতিনীতি অনুসরণ করে।’ গ্রিকদের মতো তারা দেবতাদের প্রতিচ্ছবি তৈরি করে না, তাদের উদ্দেশে বেদি ও মন্দির নির্মাণ করে না ঠিকই, তবে পাহাড়চূডায় তারা পরম দেবতার উদ্দেশে বলি দেয়। জন্মদিবসগুলো ভোজ উৎসবের মাধ্যমে পালিত হয়। তারা মিতাহারী, তবে প্রধান পদের বদলে মুখরোচক খাবারের প্রতি তাদের আকর্ষণ বেশি। সুরা পানে তাদের আগ্রহের শেষ নেই। অত্যন্ত বিচক্ষণ একটি নীতি মেনে চলে তারা এবং সেটা হলো পানপাত্র হাতে নিয়ে করা কোনো বন্দোবস্ত মেনে চলতে কেউ বাধ্য থাকবে না, যতক্ষণ অবধি না সে ফের অপ্রমত্ত অবস্থায় সেই বন্দোবস্তের কথা স্বীকার করছে। তারা যত ইচ্ছে তত স্ত্রী গ্রহণ করতে পারে এবং সেই সঙ্গে, সংগতি সাপেক্ষে ইচ্ছা অনুযায়ী রক্ষিতা রাখার ব্যাপারেও তাদের কোনো বাধা নেই। তারা তাদের বড় পরিবার নিয়ে গর্বিত এবং সন্তানদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য যথেষ্ট কষ্ট সহ্য করে। কাজেকর্মে তারা একদম সোজাসাপ্টা, কোনো লুকোচুরি বা ভানহীন এবং মিথ্যা বলাকে অত্যন্ত গর্হিত কাজ বলে মনে করে। হেরোডোটাসের জানা যেকোনো জাতির চেয়ে তারা অনুকরণযোগ্য যেকোনো ভিনদেশি প্রথা পরিগ্রহণ করতে উন্মুখ। হেরোডোটাস যেসব নগর ভ্রমণ করেছিলেন, সেগুলোর মধ্যে ব্যাবিলন ছিল সবচেয়ে অসামান্য, আর সেই নগরের বর্ণনা দেওয়ার ব্যাপারেই তিনি সবচেয়ে বেশি উৎসাহী। পল্লি অঞ্চলের উর্বরতা এমনই ছিল যে পাঠকেরা তাঁকে অবিশ্বাস করবেন এই আশঙ্কায় তিনি সে সম্পর্কে যা জানতেন, তা বলা থেকে বিরত থেকেছেন। সেখানের মানুষজন শণের বা সুতার তৈরি লম্বা হাতাকাটা বা ছোট হাতাওয়ালা বহির্বাস পরে, তার নিচে একটা উলের শার্ট থাকে; চুল ছোট করে ছাঁটা থাকে তাদের আর গায়ে তারা মিষ্টি ঘ্রাণের সুগন্ধি মাখে। প্রত্যেকেরই একটা ব্যক্তিগত সিলমোহর আছে এবং তারা একটা লাঠি বহন করে, সেটার ওপরের অংশটায় থাকে আপেল বা গোলাপ, বা ইগল বা সে রকম কিছু একটার প্রতিচ্ছবি। ব্যাবিলনীয়দের কেবল একটা বৈশিষ্ট্য হেরোডোটাসের কাছে লজ্জাজনক বলে মনে হয়েছিল, আর সেটা হচ্ছে স্বদেশি প্রতিটি নারীকে জীবনে একবার প্রেমের দেবী মিলিটার মন্দির মেরামত করতে যেতে হয় এবং নিজেকে দেহপসারিণী হিসেবে নিবেদন করতে হয়; যতক্ষণ অবধি না কোনো আগন্তুক এসে সেই নারীর কোলে একটা রৌপ্য মুদ্রা ফেলে তাকে অধিকার করে নিচ্ছে, তত দিন অবধি সে বাড়ি ফিরতে পারে না।
হেরোডোটাসের বইয়ের দ্বিতীয় পর্বের অনেকটা জুড়েই রয়েছে মিসরের বিশদ বর্ণনা। এই দেশটাকে তিনি খুব ভালো করে জানতেন। ‘অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে এই দেশে অনেক বেশি বিস্ময় ছড়িয়ে আছে, আর সে কারণেই দেশটির জন্য এতখানি জায়গা বরাদ্দ করতে হচ্ছে। দেশটার যে কেবল জলবায়ুই স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত তা নয়, তার চেয়ে ঢের বেশি বিশিষ্ট হচ্ছে নীল নদ; সেটার ওপরই দেশটির ও দেশটির মানুষজনের জীবন নির্ভরশীল। মিসরীয় পঞ্জিকার অসাধারণত্বের প্রতি তিনি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন এবং মিসরের মানুষজনের উদ্ভাবনী শক্তি ও প্রবণতার প্রশংসা করেছেন। ধর্মের প্রতি তাদের গভীর আগ্রহের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন তিনি এবং বলেছেন যে গ্রিকরা তাদের দেব–দেবীর নামের জন্য মিসরের কাছে ঋণী। তিনি তাদের বিস্ময়কর প্রাণী পূজার কথা বলেছেন এবং সেই সঙ্গে মমীকরণ প্রক্রিয়ার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন। মরুভূমির বালুর বুকে তারা কী করে পিরামিড দাঁড় করিয়েছে, সেই গল্প বলেছেন তিনি (এবং সে গল্প অত্যাশ্চর্যই বটে)। এরপর তিনি দেখাতে চেয়েছেন মিসরীয়রা কীভাবে বা কেন অন্য জাতিগুলোর চেয়ে আলাদা। এই যেমন, পুরুষেরা মাথায় ভার বহন করে, কিন্তু নারীরা কাঁধে; নারীরা ব্যবসা-বাণিজ্য দেখাশোনা করে, আর পুরুষেরা ঘরে বসে থেকে নানা ধরনের বোনাবুনির কাজ করে; আবার তারা ডান থেকে বাঁ দিকে লেখে এবং তাদের দুটি লিখনরীতি রয়েছে, একটা পবিত্র, অন্যটি আটপৌরে এবং তারা বিড়াল ও কুকুর খুব পছন্দ করে; সেগুলো মারা গেলে তারা সেগুলোর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বিধিমাফিক ব্যবস্থা করে; আর, পুরুষেরা দুটি বস্ত্র ব্যবহার করলেও সাধারণত শণের বা সুতির, নারীরা করে একটি।
আগেই বলা হয়েছে, হেরোডোটাস মিসরে বেশ কিছুদিন আনন্দঘন সময় কাটিয়েছেন; তাদের এই আনন্দদায়ক অন্তরঙ্গ বর্ণনার পরে তিনি পারসিক নেতা ক্যাম্বিসেসের হাতে দেশটির পতনের কথা বর্ণনা করেছেন। এরপর তাঁর পক্ষে ‘ইতিহাস’ গ্রন্থের মূল বিষয়বস্তুতে চলে আসা সহজ হয়েছে এবং সেটি হচ্ছে ক্যাম্বিসেসের পরে পারস্যের সিংহাসনে বসা দারিউসের আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী নীতি। তিনটি খণ্ড হেরোডোটাস ব্যয় করেছেন সিদীয়দের, লিবীয়দের আর আয়োনিয়ার গ্রিক নগরগুলোর বিরুদ্ধে দারিউসের অভিযানের ওপর। এরপর আমাদের বলা হয়েছে কীভাবে, একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ার পরে দারিউস সেটাকে হেলেসপয়েন্ট (বর্তমানে যা উত্তর–পশ্চিম তুরস্কের দার্দানেলিস বা গ্যালিপলি প্রণালি নামে পরিচিত) পার হয়ে ইউরোপে প্রবেশ করতে হুকুম করলেন। থ্রেস ও মেসিডোনিয়াকে পরাভূত করা হলো। এরপর আক্রমণ চালানো হলো গ্রিসের ওপর। তখন এথেন্স থেকে ৪০ কিলোমিটার উত্তর–পুবে, গ্রিসের একটি ঐতিহাসিক স্থান অ্যাটিকার ম্যারাথন ময়দানে সেনাপতি মিলতিদিয়াসের অধীনে ১০ হাজার এথিনীয় সৈন্য জড়ো হলো। তাদের সঙ্গে কাঁধ দিল মিত্র নগর প্লাতিয়ার আরও এক হাজার। সবাই মিলে মুখোমুখি হলো পারসিক হানাদার বাহিনীর এবং তাদের সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত করল। হেরোডোটাস বলছেন, ‘বিজয়ীরা পলায়নরত পারসিকদের পিছু ধাওয়া করে তাদের কচুকাটা করল এবং তীরে পৌঁছে তারা সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধজাহাজগুলোয় হামলা চালাল।’ এভাবেই ৪৯০ খ্রিষ্টাব্দে, ম্যারাথনের যুদ্ধ শেষ হলো এবং এই যুদ্ধের সূত্রে কী করে ২৬ মাইল ৩৮৫ গজ দূরত্বের ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগতিার প্রবর্তন ঘটে আমরা তা জানি। পৃথিবীর ইতিহাসে যেসব বিখ্যাত (নাকি কুখ্যাত?) যুদ্ধে চূড়ান্ত জয়-পরাজয় নিষ্পতি হয়েছে সেগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এই যুদ্ধ সম্পর্কে জন স্টুয়ার্ট মিল বলেছিলেন ‘ম্যারাথনের যুদ্ধ এমনকি ব্রিটেনের ইতিহাসের একটি ঘটনা হিসেবে ১০৬৬ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত হেসটিংসের যুদ্ধের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ।’ জর্জ গ্রোট (১৭৯৪-১৮৭১) রচিত ১২ খণ্ডের ‘গ্রিসের ইতিহাস’ (১৮৪৬-১৮৫৬) বইটি নিয়ে লিখিত একটি প্রবন্ধে জন স্টুয়ার্ট মিল মন্তব্যটি করেছিলেন। পাশ্চাত্য চিন্তাজগতের ওপর ধ্রুপদি গ্রিক সভ্যতা ও তার গণতান্ত্রিক আদর্শসমূহের গভীর ও স্থায়ী প্রভাবের গুরুত্বকে তুলে ধরা এই মন্তব্যে তিনি এই ইঙ্গিত করেছেন যে, ম্যারাথনের যুদ্ধে গ্রিসের জয় না হলে তা ব্রিটেনসহ গোটা জগতের ইতিহাসের গতিপথকে আমূল বদলে দিত। রাজনৈতিক গণতন্ত্র এবং বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা নিয়ে গ্রিস যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে, সেসব হয়তো তারা করতে পারত না যদি ম্যারাথনের যুদ্ধে পারসিকদের জয় হতো।
এদিকে এমন অপ্রত্যাশিত পরাজয়ে অগ্নিশর্মা হয়ে রাজা দারিউস গ্রিক নগর রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে আরও জোরোলো অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করলেন। তবে তার বরাত মন্দ। যুদ্ধ-প্রস্তুতি শেষ হওয়ার বেশ আগেই তিনি মারা গেলেন। তাঁর পুত্র জেরেক্সেস সশরীর সেই আক্রমণে নেতৃত্ব দেবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। দার্দানেলিস প্রণালিতে এক বিশাল বাহিনীর জড়ো হলো। হেরোডোটাস বলছেন কেবল স্থলবাহিনীতেই ১৭ লাখ সৈন্য ছিল! (সংখ্যাটি অবিশ্বাস্য মনে হয় না? পণ্ডিত মহলে এটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে) এবং তাদের ইউরোপের দিকে পাঠানোর আগে সম্রাট নিজে সেই বাহিনীটি পরিদর্শন করেছিলেন। হেরোডোটাস আমাদের বলছেন, এই বিশাল সৈন্যবাহিনীর কেউই আগামী এক শ বছর পরে জীবিত থাকবে না, এ কথা উপলব্ধি করে সম্রাট কেঁদে ফেলেছিলেন এবং একটা ঝড় এসে হেলেস পয়েন্টের পন্টুন ব্রিজ ধ্বংস করায় এবং জাহাজগুলোর নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলে দেওয়ায় মহা ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি তাঁর লোকজনকে আদেশ দিয়েছিলেন, যেন সমুদ্রকে ৩০০ বার চাবুক মারা হয়, পানিতে শিকল ফেলা হয় এবং উত্তপ্ত লোহার শলাকা দিয়ে সাগরের গায়ে ছ্যাঁকা দেওয়া হয়। এভাবে তিনি প্রতীকীভাবে প্রকৃতির ওপর নিজের চূড়ান্ত আধিপত্য জাহির করেছিলেন আর সমুদ্রের স্পর্ধার জন্য সেটাকে শাস্তি দিয়েছিলেন। এ ধরনের আপাত উদ্ভট কাজের মাধ্যমে তিনি এবং অন্যান্য পারসিক রাজারা প্রতীকীভাবে তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন করতেন, তবে সমুদ্রের কাছ থেকে আক্ষরিক অর্থেই বাধ্যতা দাবি করতেন না, বলা বাহুল্য।
সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার দিন উপস্থিত হলে, ‘সূর্য যখন প্রায় মধ্য গগনে, জেরেক্সেস একটি সোনার পেয়ালা থেকে তরল নৈবেদ্য সমুদ্রে ঢেলে সূর্যের কাছে প্রার্থনা করলেন ইউরোপের সুদূরতম স্থান অবধি জয়ে কোনো কিছু যেন তাঁর পথে বাধা হযে না দাঁড়ায়। প্রার্থনা শেষে পেয়ালাটি তিনি হেলেস পয়েন্টে ছুড়ে ফেললেন, সেই সঙ্গে একটি সোনালি পাত্র আর একটি পারসিক তরবারিও; কিন্তু কাজটা তিনি সমুদ্রের উদ্দেশে নৈবেদ্য দানের জন্য করলেন, নাকি সমুদ্রকে চাবুক পেটা করার প্রায়শ্চিত্ত করে ক্ষতিপূরণ হিসেবে উপহারগুলো দিলেন, সেটা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারব না।’ অতঃপর, প্রবল পরাক্রান্ত সেনাদল এশিয়া থেকে ইউরোপের দিকে এগোল। এই সেনাদল আর তাদের অস্ত্রশস্ত্র ও সাজ-সরঞ্জামের বর্ণনা পড়ে মনে হয় হেরোডোটাস নিশ্চয়ই প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন।
সেনামুখ বা সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্বদানকারী অংশে ছিল ১০ হাজার পারসিক পদাতিক—শিরস্ত্রাণ, বক্ষস্ত্রাণ আর ঢোলাঢালা ট্রাউজার পরে। দ্বিতীয় দিন বেরিয়ে এল পারসিক রাজ্যের সব জাতির ভেতর থেকে বেছে নেওয়া একটি পাঁচশোলী সেনাদল—মেদেসরা পারসিকদের মতো সাজপোশাকে, এসিরীয়রা পেতলের শিরস্ত্রাণ পরে, ব্যাকট্রীয়রা পাগড়ি মাথায়, সিদীয়রা চোখা টুপি আর ট্রাউজার পরে, ভারতীয়রা সুতির কাপড়চোপড় পরে, ক্যাসপীয়রা ছাগচর্মের আংরাখা চাপিয়ে, আরবরা কোমরবন্ধ লাগানো জোব্বা পরে, ইথিওপীয়রা সিংহের চামড়া গায়ে দিয়ে, কোঁকড়া চুলের লিবীয়রা চামড়ার আঁটসাঁট জামা গায়ে, সঙ্গে ফ্রিজীয়, থ্রেসীয় আর বিথিনীয়দের নিয়ে।…সাত দিন সাত রাত ধরে সেনাদলটি প্রণালিটি পার হলো, একবারের জন্যও না থেমে।
আক্রমণকারী বাহিনী এগিয়ে চলল, থ্রেস ও মেসিডোনিয়ার পতন ঘটাল; শেষ অবধি, খোদ গ্রিস অবধি পৌঁছে গেল। তারপর একদিন জেরেক্সেসের কাছে একটি বার্তা পৌঁছাল যে একদল স্পার্টান গ্রিক সৈন্য থার্মোপিলির গিরিপথটি অধিকার করে আছে। (থার্মোপিলি হচ্ছে বর্তমান গ্রিক শহর লামিয়ায় অবস্থিত একটি সংকীর্ণ গিরিপথ; থার্মোপিলি শব্দটা এসেছে সেখানের উষ্ণ গন্ধক সমৃদ্ধ প্রস্রবণ থেকে; আমরা জানি, থার্মো—মানে তাপসংক্রান্ত)। ‘তারা কতজন এবং কী করছে, তা দেখে আসতে যেরেক্সেস একজন অশ্বারোহী গুপ্তদূত (গুপ্তচর নয়) পাঠালেন। সেই গুপ্তদূত গ্রিক শিবিরের কাছে পৌঁছে দেখল স্পার্টানদের তখন দেয়ালের বাইরে মোতায়েন করা হয়েছে; দেখল, তাদের কেউ শারীরিক কসরত করছে, অন্যরা চুল আঁড়াচ্ছে।’ এ কথা শুনে যেরেক্সেস বিস্ময়াভিভূত হয়ে গেলেন; তিনি বুঝতে পারেননি যে স্পার্টানরা আসলে মৃত্যুর প্রতি একটি মহিমান্বিত অবজ্ঞা প্রদর্শন করছিল এবং শত্রুর বিপুল ক্ষতিসাধন না করে হার স্বীকার না করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সম্ভবত চার লাখ পারসিক সৈন্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল ছয় হাজার স্পার্টান, তবে তাদের নেতা ছিলেন লিওনাদিস এবং যুদ্ধ করতে করতেই প্রাণ দিয়েছিল তারা নিজের স্থান থেকে এক বিন্দু পিছু না হঠে।’
পারসিক যুদ্ধযন্ত্র আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছিল এবং গ্রিসের বেশির ভাগ স্থান তাদের করায়ত্ত হয়েছিল; পারসিকরা এসে পৌঁছুবার আগেই প্রায় সব এথেন্সবাসী ও সেটার রক্ষায় নিয়োজিত সবাই শহরটি ছেড়ে চলে যায়। বিজয়ীরা অ্যাক্রোপলিস দখল করে নিয়ে সেখানের অধিকাংশ বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। তবে গ্রিক নৌবহর অক্ষত ছিল এবং সালামিস ও গ্রিস মূল ভূখণ্ডের মধ্যখানের সংকীর্ণ জলপথে এক মহারণে থেমিস্তোক্লেসের নেতৃত্বে ৪৮০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে গ্রিকরা পারসিক হানাদারদের বিশাল নৌবাহিনীকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। ‘তারপর, যুদ্ধ শেষে, গ্রিকরা জাহাজগুলোর ধ্বংসাবশেষ, আর টুকরোটাকরা যা পাওয়া গেল তাই কুড়িয়ে বাড়িয়ে সালামিসের তীরে এনে জড়ো করল এবং নিজেদের নতুন আরেক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করল, এ কথা ভেবে যে পারসিক রাজা হয়তো রক্ষা পাওয়া জাহাজগুলো কাজে লাগাবেন। কিন্তু জেরেক্সেস…’ সংক্ষেপে বললে, তাঁর যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছিল, লড়াইয়ের ভার কিছু সেনাপতির হাতে দিয়ে তিনি তাঁর সেনাদলের একটা বড় অংশ সঙ্গে নিয়ে এশিয়ায় ফিরে গেলেন।
হেরোডোটাসের গ্রন্থের নবম ও দশম খণ্ড অনুযায়ী, কয়েক বছরের মধ্যে সেই সেনাপতিরাও একই ভাগ্য বরণ করলেন এবং তাঁদের সেই প্রবল শক্তিশালী সেনাদলের খুব অল্পসংখ্যক সদস্যেরই সৌভাগ্য হলো দার্দানেলিস প্রণালি পেরিয়ে এশিয়ায় নিজ বাসভূমে ফিরে যাওয়ার। বিজয়ী গ্রিক বাহিনী তাদের পিছু ধাওয়া করেছিল এবং হেরোডোটাস তাঁর ‘ইতিহাস’ গ্রন্থটির পরিসমাপ্তি টেনেছেন গ্রিকদের সেসতস নগর দখল করার ঘটনা দিয়ে। সেসতস ছিল ইউরোপের মাটিতে পারসিকদের শেষ শক্ত ঘাঁটি।
কাজেই যে ‘পারসিক যুদ্ধ’-র কথা হেরোডোটাহেরোডোটাস এমন প্রশান্ত গাম্ভীর্য, করুণ রস ও দেশাত্মবোধক আকুলতা নিয়ে রচনা করলেন, তার সমাপ্তি ঘটল এবং ইউরোপ পরিত্রাণ লাভ করল। কারণ, যদিও গ্রিক ও পারসিকদের মধ্যে সংগ্রাম দীর্ঘকাল ধরে চলেছিল, এর পর থেকে সে সংগ্রামে গ্রিকরাই ছিল হানাদার।
বড় বড় যুদ্ধগুলো ঐতিহাসিকদের ব্যতিক্রমী সব সুযোগ এনে দেয়। এবং হেরোডোটাস সম্পর্কে সম্ভবত এ কথা বলা যায়, তিনি যে তাঁর বিষয়বস্তুর পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করতে পেরেছেন, তার প্রমাণ তিনি রেখেছেন। সত্যিকারের মহৎ সমস্ত ঐতিহাসিকের মতো তিনি উপলব্ধি করেছেন যে তিনি কেবল জাতিতে জাতিতে দ্বন্দ্ব, সাম্রাজ্যে সাম্রাজ্যে সংঘর্ষ, বিরুদ্ধ পদ্ধতির নানা সরকার, ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে প্রতিযোগিতার কথা বলছেন না। তাঁর দুর্দান্ত বর্ণনা জুড়ে তিনি আমাদেরকে তাঁর এই দৃঢ় প্রতীতির কথা স্মরণ করিয়ে দেন যে এসব যুদ্ধবিগ্রহ, সংগ্রাম, ইত্যাদির ওপর ভর করে থাকে এক নেমেসিসের প্রাণসত্তা; থাকে ঐশী বিধান প্রযুক্ত এক নৈতিক কানুন, যার হাত থেকে যেরেক্সেসের মতো মহাপ্রতাপশালী ও আত্মম্ভরী নৃপতিরও নিস্তার মেলে না।
(সূত্র: জন ক্যানিংয়ের ‘হেরোডোটাসে’স “হিস্ট্রি”’)