নিকোলাই গোগোলের নগরে

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

নভোদেভিচি সিমেট্রিতে এসেছি সকালবেলা। দুপুর হতে চলল, কিন্তু যাঁর সমাধি খুঁজছি, সেটি কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না। ২৬ হাজার সমাধির মধ্যে একজনকে খুঁজে পাওয়া যে কত মুশকিল, তা আগে বুঝতে পারিনি। সিমেট্রির রিসেপশনে আমাকে একটা ম্যাপ ধরিয়ে দিতে চাইল কিন্তু সেটি রুশ ভাষায় লেখা। রুশ ভাষার ম্যাপ আমার কোনো কাজে আসবে না। তাই ম্যাপ সঙ্গে না নিয়েই চলে এসেছি। এদিকে আকাশ থমথমে হয়ে আছে। আমি দিশাহারা পথিক। এক এক করে খুঁজতে গিয়ে দেখি দুই শর মতো সমাধি দেখেছি সকাল থেকে দুপুর অবধি। এভাবে হবে না বুঝতে পারছি আর মনে হচ্ছে বুঝেশুনেই বোকামি করছি। অবশ্য এক পাগল কবির সমাধি খুঁজতে গিয়ে বোকা বনে যাওয়াই যায়। কিন্তু বাদ সাধছে প্রকৃতি। ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল আর ঝরতেই থাকল। এই সিমেট্রিতে সারি সারি সুসজ্জিত সমাধি আছে, সমাধির ওপরে সমাধিফলক খুব যত্ন করে করা হয়েছে, কিন্তু বৃষ্টিতে ঠাঁই নেওয়ার জায়গা আশপাশে খুঁজে পেলাম না। অগত্যা ছাতামাথায় হাঁটতে হাঁটতে এই জনমানবহীন সিমেট্রিতে একজন বিশেষ মানুষকে খুঁজতে থাকি। ২৬ হাজার সমাধি, ৪২ বছর বয়সী এক ব্যক্তি আর আমি যেন সবার চেয়ে একা।

কিছুক্ষণ সমাধির সারির পাশ দিয়ে হাঁটার পর একজন মানুষের দেখা পেলাম। তিনি কি দেবদূত হয়ে আমার জন্য এসেছেন? আমি যাঁকে খুঁজছি তাঁর নাম বলতেই হাতের ইশারায় ডেকে দূরের এক গহিন জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে গেলেন। সেখানে সারি সারি সমাধিকে পাহারা দিচ্ছে উঁচু উঁচু গাছপালা। আর এর নিচে মানুষেরা শান্তিতে ঘুমাচ্ছেন শত শত বছর ধরে।

নিকোলাই গোগোলেরর সমাধি
ছবি: লেখক

দেবদূত ভদ্রলোকটি আসলে এই সিমেট্রির মালি। যাঁকে খুঁজছি, তাঁর সমাধির কাছে নিয়ে আমায় তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি অবাক চোখে চেয়ে থাকি কালো পাথরে আচ্ছাদিত সমাধির দিকে। এখানেই কি তিনি ঘুমাচ্ছেন, যিনি পাগলামির জন্য খ্যাত ছিলেন রাশিয়া আর ইউরোপে! যাঁর লেখায় বিভিন্নভাবে উঠে এসেছে সামাজিক অবক্ষয়ের কথা! এই সেই লেখক যিনি নিজের কবিতার সব কটি বই আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন, এমনকি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিও ছাপানোর আগেই পুড়িয়েছেন। তিনি আধুনিক রুশ সাহিত্যের ছোটগল্পের জনক নিকোলাই গোগোল।

নিকোলাই ভাসিলেভিচ গোগোল ১৮০৯ সালে ইউক্রেনের সোরোশিন্তসি শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন খানিক আলাভোলা। পড়ালেখায় মন ছিল না, তাই স্কুলে যেতে চাইতেন না। তাঁর বাবা ছিলেন কবি ও নাট্যকার। নিজের একটি থিয়েটার ছিল। সেই থিয়েটারে বাল্যকাল থেকেই গোগোল বিভিন্নভাবে সহায়তা করতেন। গোগোলের বয়স যখন ১৫, তখন তাঁর পিতার মৃত্যু ঘটে।

প্রথম দিকে তিনি ইউক্রেনের ভাষায় কবিতা, গল্প লিখতেন। তাঁকে চারুকলা পড়তে পাঠানো হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি না নিয়েই তিনি চলে এসেছিলেন। এক জায়গায় ভালো লাগত না বলে নিজ শহর ছেড়ে সেন্ট পিটার্সবার্গে চলে গিয়েছিলেন। খুবই খেয়ালি কবি ছিলেন। তাঁর প্রথম কবিতার বই ছাপা হওয়ার পর সে বই কয়েকজন সাহিত্যিককে পাঠান এবং তাঁরা সে কবিতার উপহাস করেন। রেগেমেগে গোগোল সব কটি কবিতার বই পুড়িয়ে ফেলেন। আর কবিতা লিখবেন না বলে ঠিক করেন।

সেন্ট পিটার্সবার্গে সাহিত্যিক আলেক্সান্দার পুশকিনের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। পুশকিনের মৃত্যু তাঁর মনে গভীর দাগ কাটে।

নিকোলাই ভাসিলেভিচ গোগোল ১৮০৯ সালে ইউক্রেনের সোরোশিন্তসি শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। খুবই খেয়ালি কবি ছিলেন। তাঁর প্রথম কবিতার বই ছাপা হওয়ার পর সে বই কয়েকজন সাহিত্যিককে পাঠান এবং তাঁরা সে কবিতার উপহাস করেন। রেগেমেগে গোগোল সব কটি কবিতার বই পুড়িয়ে ফেলেন।

ইতিমধ্যেই তাঁর লেখা ডেড সোলস, দা গভর্নমেন্ট ইন্সপেক্টর, ওভারকোট, তারাস বুলবা লেখাগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। কিন্তু মাথায় পাগলামি চাপলে তিনি নিজের লেখাকেই অস্বীকার করে বসতেন।

বিখ্যাত ফরাসি লেখক ইউজেন মেলকিওর দ্য ভগুয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা সবাই গোগোলের ওভারকোট থেকেই এসেছি।’ মানে গোগোলের ওভারকোট রচনাটি এতটাই জনপ্রিয় ও ভিন্নধারার ছিল যে তা এক মাইলফলক হয়ে আছে পরবর্তী লেখকদের কাছে।

গোগোলের সমাধির সামনে লেখক
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

ডেড সোলস বা মৃত আত্মা গোগোলের অন্যতম সৃষ্টির মধ্যে একটি। সে যুগের ঠগবাজি সম্পর্কে সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছিলেন এই গল্পের মাধ্যমে। আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম ডেড সোলস বইয়ে বিচিত্র ভাবে প্রতারণার চিত্র পড়ে। সে যুগে রাশিয়ার মতো দেশেও এসব হতো! এখনকার রাশিয়ার চালচিত্র দেখলে মনে হয়, এর চেয়ে নিষ্পাপ দেশ, দেশের মানুষ আর হয় না। ঠগবাজেরা যুগে যুগেই ছিল, কোথাও প্রকট আকারে, কোথাও গোপনে।

১৮৩৪ সালে যোগ্যতা না থাকলেও গোগোলকে সেন্ট পিটার্সবার্গ ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অবশ্য এর এক বছরের মাথায় অন্যদের আপত্তির মুখে তিনি সে পদ ছেড়ে দেন।

এর মধ্যে ১৮৩৬ থেকে ১৮৪৮ সালে তিনি ইউরোপ ভ্রমণ করেন ও ইউরোপের বিভিন্ন লেখকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। ইউরোপ ভ্রমণ শেষে তিনি জেরুজালেম ভ্রমণ করেন ও রাশিয়ায় ফিরে আসেন। জেরুজালেমে তীর্থস্থান ভ্রমণের পর তাঁর মনে হতে থাকে যে জীবনে ভোগবিলাস বৃথা এবং সংযমই জীবনযাপনের শ্রেষ্ঠ উপায়। আগে থেকেই খানিকটা খ্যাপাটে ছিলেন, এরপর আরও বেশি জাগতিক ভোগবিলাসে বিমুখ হয়ে পড়েন।

আরও পড়ুন

১৮৫২ সাল, গোগোলের বয়স তখন ৪২, ‘ডেড সোলস’-এর দ্বিতীয় খণ্ড লিখছিলেন। হঠাৎ মাথায় কী ভূত চাপল, তিনি পাণ্ডুলিপিটি জ্বালিয়ে দিলেন। অনেক দিন থেকেই বিষণ্নতায় ভুগছিলেন। এবার তা চরমে ওঠে। খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দেন এবং ৯ দিন পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তাঁকে মস্কোর দানিলোভ মনাস্টেরিতে সমাহিত করা হয়। ১৯৩১ সালে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে তাঁর কফিন সেখান থেকে তুলে নভোদেভিচি সিমেট্রিতে সমাহিত করা হয়।

কবিতা লিখলে নাকি পাগল হতে হয়। তাই বলে নিজেকে শেষ করে দেওয়া এক বিষণ্ন পাগল হতে হবে?

‘আয়নাকে দোষ দিয়ো না, যদি তোমার চেহারায় খুঁত থাকে।’
—নিকোলাই গোগোল

আমি বৃষ্টির মধ্যেই নিকোলাই গোগোলের সমাধির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। এই সিমেট্রির কোনো সমাধিতেই গ্রিল দিয়ে ঘেরা নেই গোগোল আর দু-একজন ছাড়া। কালো পাথরে বাঁধাই করা সমাধির মাথার কাছে সোনালি রঙের ক্রস রাখা।

বিখ্যাত ফরাসি লেখক ইউজেন মেলকিওর দ্য ভগুয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা সবাই গোগোলের ওভারকোট থেকেই এসেছি।’ মানে গোগোলের ওভারকোট রচনাটি এতটাই জনপ্রিয় ও ভিন্নধারার ছিল যে তা এক মাইলফলক হয়ে আছে পরবর্তী লেখকদের কাছে।

আমি বিমূঢ় হয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। এই ঘোর বরিষনে দেখি একদল ভক্ত এসেছে গোগোলকে শ্রদ্ধা জানাতে। সমাধিতে আগে থেকেই কয়েকটা ফুলের তোড়া রাখা ছিল। আমি বিরক্ত হয়েছিলাম বড় বড় লাল গোলাপের তোড়াগুলো দেখে, কারণ সেগুলো ছিল প্লাস্টিকের তৈরি। এত বেরহমও কেউ হয় যে তাজা ফুল না দিয়ে প্লাস্টিকের ফুল দিয়ে সৌন্দর্য বর্ধন করে! তবে গোগোল-ভক্তরা আমায় নিরাশ করেনি। তারা হাতে করে ফুল এনেছে, সমাধিতে তা রেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে চলে গেছে। এই তুমুল বাদলদিনে ভক্তদের শ্রদ্ধা নিবেদন দেখে অভিভূত হয়ে গেলাম। শুধু এরাই নয়, এরপর একা বা বন্ধুর সঙ্গে কয়েকজন ভক্ত এসেছেন তাঁকে দেখতে। একজন ভক্ত ইংরেজি জানেন। জিজ্ঞেস করলাম, তাঁরা গোগোলের লেখা পড়েছেন কিনা। আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, গোগোলের লেখা তাঁদের স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং এখনো তাঁরা গোগোলকে পড়েন। বুঝতে পারছি অনুরক্ত না হলে প্রিয় লেখকের কাছে এমন দুর্যোগ দিনে কেনই-বা ছুটে আসবেন!

গোগোল এক লেখায় বলেছিলেন, ‘তুমি যত বেশি সময় হাসির কোনো গল্পের দিকে মনোযোগ দেবে, তত বেশি সেই গল্পটি তোমার কাছে দুঃখের মনে হবে।’ গোগোল এমন একজন লেখক, যিনি সুখের চেয়ে দুঃখ নিয়ে বেশি তোলপাড় করেছেন, নিজেকে ওলটপালট করেছেন।

আরও পড়ুন

পরদিন আমি গেলাম গোগোল যে বাড়িতে জীবনের শেষ কয়েক বছর বসবাস করেছিলেন, সে বাড়িতে। মস্কোর মেট্রো পৃথিবীজুড়ে বিখ্যাত। আমি মেট্রোরেলে চড়ার চেয়ে মেট্রো স্টেশনগুলোর সৌন্দর্য দেখেই সময় পার করে দিই। এখন স্টেশন দেখলে হবে না, একজন খ্যাপা মানুষের বাড়ি খুঁজে বের করতে হবে। মৃত্যুর আগের চার বছর তিনি সে বাড়িতে বসবাস করেছিলেন।

মেট্রো স্টেশন থেকে বের হয়ে ম্যাপ দেখে কয়েক মিনিট হাঁটার পর একটা বিশাল হলুদ রঙের লম্বাটে ভবন চোখে পড়ল। ভবনের সামনে একটি ভাস্কর্য রাখা। কাছে গিয়ে খেয়াল করে দেখলাম এটি নিকোলাই গোগোলেরই ভাস্কর্য। ভাস্কর্যটি তাঁর লেখার মতোই সমাজকে হেঁয়ালি করছে যেন। একটা লম্বা কোট গায়ের ওপর ছড়িয়ে বাঁকা হয়ে চেয়ারে বসে আছেন। মুখটা অন্য দিকে ঘোরানো। মুখ দেখতে হলে ঘুরে চত্বরের আরেক পাশে যেতে হবে। এসব হেঁয়ালি ছাড়া আর কী-বা হতে পারে! যেমন তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যেমন, আমি তেমনই আর সেটাই আমি।’

গোগোলের ভাস্কর্য ও স্তম্ভের নিচে তাঁরই সৃষ্ট কয়েকটি চরিত্র খোদাই করা
ছবি: লেখক

ভাস্কর্যে গোগোল কী বলছেন, তা বোঝার সাধ্য আমার নেই। আমি ক্ষুদ্র মানুষ, সীমিত জ্ঞান আমার। মাঝেমধ্যে গোগোলের মতো এত বড় মাপের সাহিত্যিকের লেখার অনেক মর্ম উদ্ধার করতে পারি না, তবে সামাজিক অবক্ষয় তুলে ধরে যে সেই সমাজকেই উপহাস করছেন, তা বিলক্ষণ বুঝতে পারি৷

গোগোলের ভাস্কর্য স্তম্ভের নিচের দিকে তাঁরই উপন্যাসের কয়েকটি চরিত্র খোদাই করা আছে।

ভাস্কর্য থেকে গোগোলের বাড়ির দিকে এগোতে থাকি। এ ভবনের একটি ছোট অ্যাপার্টমেন্টের এক অংশে ভাড়া থাকতেন গোগোল। সেদিকের দেয়ালে গোগোলের ভাস্কর্য খোদাই করা আছে। আমি মূল ভবনের ভেতরের প্যাসেজ পার হলাম ধীরে ধীরে। মনে হচ্ছিল ডেড সোলসের দাসদের সেই মৃত আত্মারা আমার পায়ের আঘাতে যেন কষ্ট না পায়। ডেড সোলস-এর দ্বিতীয় পর্ব তো গোগোল লিখে শেষ করেননি। এ বাড়িতেই সেই আত্মারা ঘুরে বেড়াচ্ছে নিশ্চয়ই। অথবা ‘ওভারকোট’ গল্পের আকাকির আত্মাও এখানে এই বাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য ঘুরে বেড়াতে পারে। গোগোলের রচনা পড়লে সেখান থেকে সহজে বের হয়ে আসা সম্ভব নয়। সেই ঘোর কাটে না।

আমি মূল ভবনের ভেতরের প্যাসেজ পার হলাম ধীরে ধীরে। মনে হচ্ছিল ডেড সোলসের দাসদের সেই মৃত আত্মারা আমার পায়ের আঘাতে যেন কষ্ট না পায়। ডেড সোলস-এর দ্বিতীয় পর্ব তো গোগোল লিখে শেষ করেননি। এ বাড়িতেই সেই আত্মারা ঘুরে বেড়াচ্ছে নিশ্চয়ই।

গোগোল এই ভবনের নিচতলার দুটি কক্ষ ভাড়া করে থাকতেন। তাঁর অ্যাপার্টমেন্টের মালিক ছিলেন আনা। জীবনের শেষ চারটি বছর তিনি এখানেই কাটিয়েছেন। টিকিট ঘর থেকে জানাল এই ছোট অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে ইংরেজি গাইড বই বা ব্রোশিওর নেই। সব রুশ ভাষায় লেখা। অডিও গাইডও নেই। আমাকে হয় বুঝে নিতে হবে, নয় যদি কোনো দর্শনার্থী ইংরেজি জানেন তাহলে তাঁর কাছে জিজ্ঞেস করতে হবে।

গোগোলের লেখার, খাবার এবং বসার ঘর
ছবি: লেখক

অগত্যা আমি নিজের মতো করে গোগোলের কক্ষে প্রবেশ করলাম। যে কক্ষটিকে বসার ঘর ভেবেছি সেখানেই দেখি সব আসবাব রাখা। কক্ষের এক কোনায় একটা ছোট তিন সিটের সোফা রাখা। সোফাটির হাতল ও পায়া কাঠের। দেখতে অনেকটা গদি আঁটা কাঠের বেঞ্চের মতো। দেয়ালের আরেক পাশে আরও একটি একই রকম সোফা রাখা। সোফা দুটির সামনে চারকোনা একটা সেন্টার টেবিল, টেবিলটা একটু উঁচু। টেবিলে কাচের বাক্সে গোগোলের কয়েকটি বই খুলে রাখা আছে। টেবিলের আরেক পাশে একটি চেয়ার। আমার পাশে দাঁড়ানো দর্শনার্থীকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করতে তিনিও ফিসফিস করে বললেন, ‘এটা গোগোলের লেখার, খাবার এবং বসার ঘরের সেন্টার টেবিল ছিল। এই টেবিলে তিনি সব কাজই সারতেন।’ যেমন খ্যাপাটে লেখক তেমনি তাঁর টেবিল। জাগতিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে যে মনোযোগ ছিল না, তা এই কক্ষের অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়।

আরও পড়ুন

টেবিলের ডান পাশে একটা ফোল্ডিং পার্টিশন দিয়ে অন্য পাশে গোগোলের বিছানা রাখা। বিছানাটি সিঙ্গেল বেড বললে ভুল হবে। তার চেয়েও সরু বিছানা। পার্টিশনের জন্য বিছানার শুধু একাংশ দেখা যাচ্ছে।

গোগোলের সেন্টার টেবিলের একদম কোনায় আরেক পাশের দেয়ালের দিকে ফায়ার প্লেস। যা এখন কাচ দিয়ে আবৃত। এই সেই ফায়ার প্লেস, যার সামনে গোগোল ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন এবং এই ফায়ার প্লেসের আগুনেই ‘ডেড সোলস’ রচনাটির দ্বিতীয় খণ্ড পুড়িয়ে দিয়েছিলেন।

গোগোলের ব্যবহৃত আরেকটি কক্ষ এই কক্ষের পেছনের দিকে, কিন্তু সে কক্ষে যাওয়ার অনুমতি নেই। দূর থেকে দেখলাম সে কক্ষের শোকেসে গোগোলের ওভারকোট আর হ্যাট রাখা। এটাই কি সেই বিখ্যাত ওভারকোট, যার জন্য তাঁর লেখা ওভারকোট রচনাটি আধুনিক রুশ সাহিত্যের ছোটগল্পের প্রতীক হয়ে আছে!

গোগোলের ব্যবহৃত আরেকটি কক্ষ এই কক্ষের পেছনের দিকে, কিন্তু সে কক্ষে যাওয়ার অনুমতি নেই। দূর থেকে দেখলাম সে কক্ষের শোকেসে গোগোলের ওভারকোট আর হ্যাট রাখা। এটাই কি সেই বিখ্যাত ওভারকোট, যার জন্য তাঁর লেখা ওভারকোট রচনাটি আধুনিক রুশ সাহিত্যের ছোটগল্পের প্রতীক হয়ে আছে!

এই ভবনের পাশের কয়েকটি কক্ষ গোগোলের স্মরণে উৎসর্গ করা হয়েছে। প্রথম কক্ষে গোল একটি টেবিলের ওপর কাচের বাক্সে গোগোলের একটা বই রাখা। এটি গোগোলের লেখার আসল টেবিল। সবার লেখার টেবিল চারকোনা হয়। আর এই পাগলের লেখার টেবিল হলো গোল। তাঁর রচনার বিচিত্র চরিত্রের মতো তিনিও সম্ভবত বিচিত্র ধরনের মানুষ ছিলেন।

গোগোলের লেখার গোল টেবিল
ছবি: লেখক

কক্ষটির পর্দার রং লাল। দেয়ালেও লাল রং করা। দেয়ালে ঝুলছে গোগোলের কয়েকটি ছবি। বই রাখার একটা ছোট কাঠের আলমারি আর এক সিটের একটি সোফা ছাড়া অন্য কোনো আসবাব এ কক্ষে নেই।

পরের কক্ষে কয়েকটি কম্পিউটার স্ক্রিন সারি সারি সাজানো। কক্ষের রং ধূসর। একেকটা স্ক্রিনে গোগোলের একেক রচনা ডাউনলোড করা আছে। স্ক্রিনে টাচ করে প্লে করলেই ভেসে আসছে ওভারকোট, নেভেস্কি প্রসপেক্ট বা তারাস বুলবার বর্ণনা ও ভিডিও। রাশিয়ায় আমি বেশ কয়েকজন বিখ্যাত লেখকদের বাড়িতে গিয়েছি, কিন্তু লেখকের রচনাকে জীবন্ত করে রাখার মতো এত আয়োজন দেখিনি। গোগোলের ব্যবহৃত জিনিসপত্রের সংগ্রহ যেমন কম তেমনি এই বাড়িতে তাঁকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তাঁর গল্প, উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে বাড়িতে ছড়িয়ে দিয়ে তাদের মূর্ত করে রাখা হয়েছে আরও বেশি করে। এই কক্ষের ওয়ালপেপার ও দেয়ালে ঝোলানো ফ্রেমে তাঁর রচনার চরিত্ররা ঘুরে বেড়াচ্ছে।

গোগোলের বাড়ি দর্শন হয়ে গেলেও তাঁর গল্পের চরিত্রগুলো যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে আশপাশে এখন। ঘরে-বাইরে সব জায়গায়। পাগলাটে ছিলেন, তবু তিনি গেঁথে আছেন পাঠকের হৃদয়ে।