যেমন ছিলেন আবদুর রশীদ

ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন লেখক–অনুবাদক–সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুর রশীদ। তিনি ছিলেন কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহিরের সহপাঠি এবং তাঁর রচনাবলির সম্পাদক। এ বছরের ২ ফেব্রুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যু হলেও সেই মৃত্যুর কথা সাহিত্যাঙ্গনের সেভাবে কেউ জানতেও পারেনি। মোহাম্মদ আবদুর রশীদের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর নিভৃতচারী এই মানুষকে নিয়ে লিখেছেন শহীদুল জহিরের লেখার ইংরেজি অনুবাদক ভি রামস্বামী।

শহীদুল জহিরের অনুবাদক ভি রামস্বামীর সঙ্গে মোহাম্মদ আবদুর রশীদ
ছবি: সংগৃহীত

অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুর রশীদের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। আমি ঢাকায় এসেছি। আমার অজান্তে, এক অর্থে ওনার কারণেই আমি বাংলাদেশে এসেছি। এরপর প্রতিবছরই বাংলাদেশে গেছি, প্রাক্-কোভিড এবং কোভিড-পরবর্তী সময়কালে। ভারতের পশ্চিম বাংলায়, কলকাতায়, ৫৯ বছর কাটানোর পর, এভাবে শুরু হয় আমার বাংলাদেশযাত্রা। গত মাস, সাড়ে তিন বছরের মধ্যে পঞ্চম পরিদর্শনের পর, কলকাতায় ফিরে, একদিন আমার হঠাৎ মনে হলো যে আমার চেতনায় একটি পরিবর্তন ঘটছে। এককথায়, আমার জগৎ এখন দুই বাংলা। আবদুর রশীদের এটাই বড় অবদান আমার কাছে।

আমার এক প্রবীণ সহযোগী ও বন্ধু, কলকাতার একজন ভদ্রলোকের সম্বন্ধে বলেছিলেন যে উনি ‘বিনয়ের অবতার’। মোহাম্মদ আবদুর রশীদ ছিলেন ঠিক তা–ই।

২০০৫ সালে, এক বন্ধুর মুখে সুবিমল মিশ্রর নাম শুনে, আমি ওনার ছোটগল্প বা অ্যান্টিগল্প, অনুবাদ করার কাজ শুরু করলাম। বাংলাদেশে প্রথমবার আসার আগে, সুবিমল মিশ্রর তিনটে অনূদিত বই বের করতে পেরেছিলাম। আমার বাংলাদেশে আসা ছিল লেখক শহীদুল জহিরসম্পর্কিত। ২০১৯ সালে কানাডাবাসী চট্টগ্রামের মানুষ বন্ধু ইকবাল হাসনু, যিনি দ্বিভাষী ‘বাংলা জার্নাল’ পত্রিকা চালান, আমাকে লেখেন। বলেন, শহীদুল জহিরের লেখা তোমার অনুবাদ করা উচিত। ওনার কথা অনুঘটকের মতো কাজ করল আমার মগজে। প্রায় ১৪ বছর বাংলা সাহিত্য অনুবাদ করার পর, মনে হলো যে এবার আমাকে বাংলাদেশ নিয়ে ভাবতে হবে। আমি শহীদুল জহিরের গল্প, উপন্যাস পড়লাম, পাগলের মতো মুগ্ধ হলাম এবং ওনার লেখা অনুবাদ করব বলে ঠিক করলাম।

আসলে শহীদুল জহিরের পরিবারের লোকেদের অনুমতির পেছনে রশীদ ভাই–ই ছিলেন। উনিই আমার নাম সুপারিশ করেছিলেন তাঁদের কাছে। ওনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু শহীদুল জহিরের লেখার অনুবাদ হোক, তা ছিল ওনার কাছে একটি মিশন।

অনুবাদ করতে চাইলেই তো তা হয় না! লেখকের অনুমতি দরকার, কিন্তু লেখক ২০০৮ সালে হঠাৎ মারা যান, মাত্র ৫৪ বছর বয়সে। ভাগ্যক্রমে, ইকবাল ভাই এ ব্যাপারে ইচ্ছেপূরণ করতে চলে এলেন। একে–ওকে ই–মেইল করে, লেখকের ভাই, জাহিদুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন এবং আমার অনুমতির অনুরোধ ওনার কাছে পাঠান। জাহিদুল হক আমাকে ই–মেইলে অনুমতি জানান। আমিও ঠিক করলাম, চলো, বাংলাদেশে যাই।

আরও পড়ুন

আসলে শহীদুল জহিরের পরিবারের লোকেদের অনুমতির পেছনে রশীদ ভাই–ই ছিলেন। উনিই আমার নাম সুপারিশ করেছিলেন তাঁদের কাছে। ওনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু শহীদুল জহিরের লেখার অনুবাদ হোক, তা ছিল ওনার কাছে একটি মিশন।

ঢাকায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে, আমাকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান হয়, যেখানে অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুর রশীদ উপস্থিত ছিলেন। ওখানেই ওনার সঙ্গে প্রথম দেখা। উনি ওনার তরফ থেকে সব রকম সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। এরপর আমি শাহরোজা নাহরীনকে শহীদুল জহিরের উপন্যাস ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’, অনুবাদে আমার সঙ্গে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিই, ও রাজি হয়। তো ২০২০ সালে, ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় যাই, শাহরোজার সঙ্গে বসে অনুবাদটা আরম্ভ করতে। এভাবে আরম্ভ হলো আমার শহীদুল জহির অধ্যায়। ২০২১ সালে আবার ঢাকায় গেলাম, প্রধানত জহিরের ভাই জাহিদুল হকের সঙ্গে প্রকাশনা চুক্তিসংক্রান্ত আলোচনার উদ্দেশ্যে। এ বছর জানুয়ারি মাসে, বাংলা ট্রান্সলেশন ফাউন্ডেশন ঘোষণা করল যে শাহরোজা আর আমার অনুবাদ করা বইটি ‘বর্ষসেরা অনূদিত বই’ হিসেবে নির্বাচিত হলো।

শহীদুল জহিরের অভিন্নহৃদয় বন্ধু মোহাম্মদ আবদুর রশীদ
ছবি: সংগৃহীত

রশীদ ভাই পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারলেন না। আমাকে মেসেজ দিয়েছিলেন যে অসুস্থতার কারণে উনি আসতে পারেননি। তার কয়েক ঘণ্টা পর, উনি মারা যান। আমি জানতে পাই পরদিন। আমি হতবাক, বাকরুদ্ধ। দুঃখের মেঘ আমার বাংলাদেশে বাকি সময় পিছু ছাড়ল না।

২০২২ সালের মে মাসে আমি ঢাকায় এসেছিলাম। প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, রশীদ ভাইয়ের সঙ্গে বসে শহীদুল জহিরের উপন্যাস ‘মুখের দিকে দেখি’ অনুবাদের কাজ শেষ করা। উপন্যাসে ব্যবহৃত সাতকানিয়ার ভাষা নিয়ে ওনার সাহায্য নেব। তো একটা সারা দিন একসঙ্গে কাটালাম। আমি অধৈর্য এবং উত্ত্যক্ত ছিলাম, যেন আমি একজন হাতে বেতওয়ালা মাস্টারমশায় এবং উনি শ্লথ ছাত্র। আমার বন্ধু ও সঙ্গী ইজতেহাদও ছিল ওখানে। ও সাক্ষী। কাজের শেষে আমি আমার ব্যবহার, আমার মানসিকতা নিয়ে রশীদ ভাইকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। বললাম যে অনুবাদ হচ্ছে ব্রেনের কাজ, ব্রেনের জন্য এটি ভীষণ কঠিন কাজ। বন্ধুদের ঠাট্টা করে বলেছি, একটি বিশেষ রকম দূরবীণ দিয়ে দেখলে লক্ষ করতে পারবে যে কঠিন অনুবাদ করার বেলায় কান দিয়ে ধোঁয়া বের হয়! ওই রকম অবস্থায়, ওই ব্রেনের অ্যালজেবরা প্রবলেম সমাধান করার জন্যে ব্রেন যেসব জিনিস চাইছে, সাতকানিয়া ভাষায় শব্দের অর্থ; তার জন্যে অধৈর্য। আমি ক্ষমা চাইলাম। উনি আমার কথা কেটে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।

ওই দিনই, ওনার নিজের সম্বন্ধে, ওনার ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে, কিছু জানতে পারলাম ওনার কাছে। আসলে উনি ভীষণভাবে বিষণ্নতা এবং একাকিত্বে ভুগছিলেন।

টোকন ঠাকুর, গতকাল ফেসবুকে পোস্ট করলেন, যে উনি এই মাত্র জানতে পারলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুর রশীদর আর নেই। রশীদ ভাই-ই টোকনকে আমার জহির অনুবাদ প্রকল্পের সম্পর্কে জানিয়েছিলেন। আজ সকালে ওটা পড়ে, টোকনের সঙ্গে চ্যাট করলাম কিছুক্ষুণ। ও-ই লেখার আইডিয়া দিলো, স্মৃতিকথায় রশীদ ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা। মনে পড়ছে, ২০১০ সালে আমার প্রথম অনুদিত সুবিমল মিশ্রের বই বেরোনোর পর আমার মনে হয়েছিল যে এই বইয়ের মাধ্যমে আমি তাহলে বোধহয় সাহিত্য জগতে পা দিলাম। আমার চেতনায় তখন, 'সাহিত্য' মানে, ইংরেজি ভাষায়।

রশীদ ভাইকে নিয়ে লিখতে গিয়ে আজ আমার মনে হলো যে আমি বাংলাদেশের বুকে বসে নিজেকে বাংলা সাহিত্য জগতের একজন সদস্য ও অংশগ্রহণকারী হিসেবে দেখতে পারি। এই বিশ্বাস রশিদ ভাই ওনার মৃত্যুযোগে আমাকে উপহার আকারে দিয়ে গেছেন।