শুধু ওষুধ ছিটিয়ে কি ডেঙ্গুর টেকসই সমাধান হবে

মশা মারতে শুধু ওষুধ ছিটালে টেকসই সমাধান আসবে না। ময়লা-আবর্জনা ও জমে থাকা পানি পরিষ্কার রাখলে মশার উৎপত্তি ঠেকানো যাবে। ডেঙ্গু মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞ, সুশীল সমাজ, সাধারণ মানুষের কথা শুনতে হবে। তাদের সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে সিলেটে এডিস মশার বিস্তার রোধে ফগার মেশিন দিয়ে ধোঁয়া দেওয়া হচ্ছে। গতকাল সিলেট জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এলাকায়
ছবি: আনিস মাহমুদ

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলামকে সম্প্রতি বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে মশা নিধনের নতুন একটি ওষুধ ছিটাতে দেখা গেছে। এই ওষুধের নাম বাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস (বিটিআই)।

নতুন এই ওষুধ ছিটানোর পর তিনিসহ তাঁর কর্মকর্তাদের দেখে এতটাই আশাবাদী মনে হচ্ছিল যে শেষমেশ তাঁরা ঢাকার মশা সমস্যার একটি কার্যকর সমাধান বের করে ফেলেছেন।

সদলবলে কর্মকর্তাদের নিয়ে মেয়র আতিক যখন লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে অতি উৎসাহে সেই ওষুধ ছিটানো দেখছিলেন তখন লক্ষ করছিলাম, তাঁর ঠিক পায়ের কাছে একগাদা আবর্জনার স্তূপ। কিন্তু সেদিকে কারও ভ্রুক্ষেপ আছে বলে মনে হলো না; বরং তাঁদের সবার চোখ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লেকের দিকে। ধন্বন্তরি সেই ওষুধের কার্যকারিতা দেখার অপেক্ষায় আছেন যেন তাঁরা।

আরও পড়ুন

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশবিদ্যা নামে একটি বিষয় প্রায় সবার জন্য বাধ্যতামূলক। বিষয়টি আমি পড়াই বহুদিন ধরে। কোর্সের শুরুর দিকেই ‘টেকসই উন্নয়ন’ তথা সমাধান বিষয়ে ধারণা দেওয়া হয়। এ পর্যায়ে একটি প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের আমি প্রায়ই করে থাকি। ঢাকা শহরে ডেঙ্গু আর এডিস মশার প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে। তোমার মতে টেকসই সমাধানগুলো কী কী—ক্রমানুসারে সাজাও।

শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যেসব উত্তর আসে সেগুলোর কয়েকটি এমন—ডেঙ্গুর জন্য ভালো মানের ওষুধ ও হাসপাতাল; ভালো মশার কয়েল ও মশারি; মশা মারার ভালো ওষুধ; ময়লা-আবর্জনা ও জমে থাকা পানি পরিষ্কার রাখা।

শিক্ষার্থীরা যেসব উত্তর দিয়েছে, সংগত কারণ চিন্তা করলে সেগুলোর সঠিক ক্রম হচ্ছে উল্টো। ময়লা-আবর্জনা ও জমে থাকা পানি পরিষ্কার রাখলে মশার উৎপত্তি হতে পারবে না—এটাই হচ্ছে সবচেয়ে টেকসই সমাধান। মশা যদি জন্মও নেয়, শুরুতেই মেরে ফেলতে পারাটাই হচ্ছে ভালো সমাধান। তা না হলে অন্তত মানুষের সংস্পর্শে যেন না আসে, সে জন্য মশারি বা কয়েল ব্যবহার করতে হবে। আর সবকিছু ব্যর্থ হলে মশার কামড় খেয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হতে হবে। আর সমাধান ওষুধ সেবন বা হাসপাতালে ভর্তি।

শুধু পরিবেশ কেন, সমাজ-অর্থনীতির সর্বক্ষেত্রেই এই টেকসই শব্দটি আজকাল বহুল ব্যবহৃত। রোজ রোজ তৈলাক্ত পোলাও-কোর্মা খেয়ে একদিন হঠাৎ হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মরতে হবে। বিষয়টি ভালোভাবে বুঝে-শুনে কম খেয়ে বেশি দিন বাঁচার চেষ্টা করাই তো উত্তম। কিংবা ইভ্যালি-যুবকের মতো ভুয়া প্রতিষ্ঠান বানিয়ে অতি লোভ করে দ্রুত বড়লোক হতে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ধরা খেয়ে জেলে পচবেন, নাকি সততার সঙ্গে গ্রাহকের আস্থা অর্জন করে বহুদিন ব্যবসা করবেন—বিষয়টি ভাবতে হবে। টেকসই ধারণা সর্বক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

আরও পড়ুন

এখন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা কী

কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এই টেকসই সমাধানের ধারণাটিকে মোটেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে না। সর্বত্রই সুপারফিসিয়াল তথা অগভীর সমাধানের চেষ্টা। আবার অনেক ক্ষেত্রে জনসাধারণের জন্য টেকসই সমাধান না খুঁজে সরকারি অফিসগুলো তাদের মেধা খরচ করে ঘুষ আর চুরির দীর্ঘস্থায়ী উপায় খুঁজতে ব্যস্ত থাকে।

যেমন কয়েক দিন ধরে দেখছি, খিলক্ষেতের কাছে জলজ্যান্ত সুস্থ-সবল রোড ডিভাইডার ভেঙে আইল্যান্ড বানানোর মহোৎসব চলছে। ঢাকা মহানগরে কি এই মুহূর্তে এটি বড় কোনো সমস্যা। নাকি আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা রয়েছে?

রাজধানীতে ডেঙ্গু অনেকটা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। ডেঙ্গুর মতো মারাত্মক এই সমস্যা থেকে উত্তরণের মতো কাজে জনগণের কষ্টার্জিত এই করের অর্থ ব্যয় করা উচিত ছিল। সেসব বাদ দিয়ে তাহলে কেন করছেন এসব! কংক্রিট রোড ডিভাইডারের তেমন রক্ষণাবেক্ষণ খরচ নেই। তার পরিবর্তে রোড আইল্যান্ডে সম্ভবত ছোট ছোট গাছ লাগানো হবে।

আর তা রক্ষণাবেক্ষণে বাঁধা মাসিক আয় তথা চুরির সুব্যবস্থা থাকবে। এর আগেও একই সড়কে অহেতুক দফায় দফায় ফুটপাত ভাঙা-গড়ার খেলা চলছিল। আর এই লুটপাট চলছে জনসমক্ষে, দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভিআইপি রোডে, যেখানে দেশের সবচেয়ে জ্ঞানী-গুণী আর ক্ষমতাধর লোকেরা প্রতিদিন চলাচল করেন।

আরও পড়ুন

এলোমেলো ওষুধ ছিটানো

কর্তৃপক্ষ মশা মারার যে নিত্যনতুন ওষুধ আনছে, তার কতভাগ সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সিটি করপোরেশনের মশককর্মীরা কখনোই আবর্জনার স্তূপ সরিয়ে বদ্ধ পানিতে কখনো ওষুধ ছিটান না। উত্তরায় খোদ মেয়রের বাড়ির পাশেই দেখলাম পিচঢালা রাস্তার ওপর দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে হেঁটে যাচ্ছেন এক মশককর্মী বাবুসাহেব। সংগত কারণে তাঁর নামোল্লেখ করা হলো না।

তিনি পাইপটা বাঁকা করে ড্রেনে যে ওষুধ ছিটাবেন, সেদিকে তাঁর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। মশককর্মীরা রাস্তা দিয়ে হাঁটেন অনেকটা ফেরিওয়ালার মতো। কেউ কেউ নিজের বাড়িতে ওষুধ ছিটাতে মশককর্মীর হাতে শ দুয়েক টাকা গুঁজে অনুনয়-বিনয় করে ডেকে আনেন।

কারণ, নইলে তাঁর বাড়িতে তো আর ওষুধ ছিটানো হবে না। চুরি সর্বত্র। ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার আর নালা পরিষ্কার করার জন্যও আছে কোটি কোটি টাকার বাজেট। কাগজে-কলমে সবই খরচ হয়, কিন্তু বাস্তবে কোনো কাজ হয় না।

বৃষ্টিবিধৌত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের একটি শহর হিসেবে রাজধানী ঢাকার পানিনিষ্কাশন-ব্যবস্থার উন্নয়নকে বরাবরই অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত ছিল। নগরের সব প্রাকৃতিক খাল বেদখল হয়ে আছে। হ্রদগুলোও প্রতিবছর নিয়মিত খনন করে ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির কোনো উদ্যোগ দেখি না। প্রতিবছর নিয়ম করে বরং এই কাজ করা উচিত ছিল। শহর রক্ষা বাঁধের কারণে পশ্চিমে পানি বের করার একমাত্র উপায় দুটি পাম্প স্টেশন।

আরও পড়ুন

ময়লা-আবর্জনায় পূর্ণ হয়ে সব নালা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বৃষ্টির পানি দ্রুত নেমে সেই পাম্প স্টেশনে যেতেও পারে না। এক ঘণ্টার বৃষ্টিতে তাই পুরো শহর সয়লাব হয়ে যায়। রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। আর এরই পরিণাম মহামারি রূপে ডেঙ্গু।

সর্বোপরি বলতে হয়, এই পুরো নগর অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে উঠছে। রাজধানীতে অনিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যা বৃদ্ধি সব সমস্যার কারণ বলে মনে করা হয়। সুতরাং জনসংখ্যার চাপ কমানোর জন্য সবচেয়ে ভালো তথা টেকসই সমাধান ছিল প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ। কাজটি করা গেলে রাজধানীর ওপর চাপ অনেকাংশে কমে আসত।

বহুবার, বহুরূপে এসব কথা বিশেষজ্ঞদের মুখ থেকে আসছে। কিন্তু কোনো সরকারের আমলেই এ নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পরিণামে পৃথিবীতে বসবাসের সবচেয়ে অযোগ্য নগর কিংবা সবচেয়ে বায়ুদূষণপ্রবণ শহরের তকমা জুটছে রাজধানী ঢাকার কপালে।

এবং এটি একবার নয়; বছরের পর বছর বায়ুদূষণের শীর্ষ কাতারে থাকছে এই শহর। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামতে নামতে রেকর্ড প্রায় ৫০০ ফুট নিচে নেমে গেছে। ডেঙ্গুও মনে হয় অতীতে কোনো সময় এতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেনি। এ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু সম্ভবত আরেকটি রেকর্ড।

আরও পড়ুন

টেকসই সমাধান কীভাবে

এই জায়গায় এসে ঢাকা উত্তর সিটির প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের কথা একটু বলতে হয়। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগে ঢাকার মেয়র যে জনগণের উপকারে কিছু করতে পারেন, তা কারও বিশ্বাসে ছিল না। তাঁর কর্মতৎপরতা দেখে মন হয়েছিল, তিনি সত্যিকার অর্থেই কিছু করার চেষ্টা করেছিলেন।

ঢাকা উত্তর সিটির বর্তমান মেয়র আতিকুল ইসলামকেও বেশ দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা যায়। কিন্তু বাস্তবে কার্যকর কিছু চোখে পড়ছে না। তবে কি তিনি সরকারি অফিসগুলো থেকে পর্যাপ্ত সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছেন না? নাকি তিনি কেবল লোকদেখানো দৌড়ঝাঁপ করেই দায়িত্ব শেষ করছেন?

আবারও সেই একই কথা বলতে হয়, মেয়রকে অবশ্যই সমস্যার মূল খুঁজতে হবে। নিজের ঘর ঠিক করেন। সিটি করপোরেশনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আগে জবাবদিহির আওতায় আনুন। প্রকৃত অর্থেই বিশেষজ্ঞ, দেশপ্রেমিক মানুষ, সুশীল সমাজ তথা আপামর জনসাধারণের কথা শুনুন এবং তাঁদের পরামর্শ নিন। ডেঙ্গু মোকাবিলায় তাঁদের সম্পৃক্ত করুন। তবেই ডেঙ্গুর মতো সমস্যার টেকসই সমাধান বেরিয়ে আসবে।

  • ড. মো. সিরাজুল ইসলাম; অধ্যাপক, সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ও পরিচালক, সেন্টার ফর ইনফ্রাস্ট্রাকচার রিসার্চ অ্যান্ড সার্ভিসেস, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়