বিশ্লেষণ
বাংলাদেশে যেভাবে জনপরিসর দখলের রাজনীতি হচ্ছে
সহিংসতা ও সহিংসতার সমর্থনে বানানো বয়ানের স্পষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও আছে। বাস্তবতা হলো এগুলো নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর ‘গভর্নমেন্টালিটি’ প্রকল্পের অংশ।
তারা সামাজিক স্তরবিন্যাস বদলে নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে চায় এবং ঠিক করতে চায় কে ‘গ্রহণযোগ্য মুসলিম’, কার নাগরিকত্ব স্বীকৃত হবে আর কে সেই অধিকার থেকে বাদ পড়বে।
গত এক বছরে বাংলাদেশে অনেকগুলো সুফি মাজারে হামলা হয়েছে। বিশ্ব সুফি সংস্থার মুখপাত্র আফতাব আলম জিলানী জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, এ পর্যন্ত ১৮৫টি মাজার ও খানকায় হামলা বা অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে এবং হুমকিও অব্যাহত আছে। রিপোর্টটি প্রকাশিত হয় ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫।
এর আগে ১৮ জানুয়ারি ২০২৫ এক ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস শাখা পুলিশি তথ্য উদ্ধৃত করে জানায়, ৪ আগস্ট থেকে পরের সাড়ে পাঁচ মাসে ‘নিশ্চিত’ হামলা হয়েছে ৪০টি। সরকারি হিসাব প্রকাশের পরও নতুন হামলা হয়েছে। আক্রান্তের তালিকায় নতুন নাম যুক্ত হয়েছে। যদিও নিশ্চিত নয় যে ২০২৪-এর আগস্টের পর ঠিক কতগুলো মাজার ও দরগাহ আক্রমণের শিকার হয়েছে, তবে এই সংখ্যা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক।
ময়মনসিংহের ভালুকায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে হিন্দু যুবক দীপু চন্দ্র দাসকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়, পরে তাঁর লাশেও আগুন দেওয়া হয়। মানিকগঞ্জে বাউলশিল্পী আবুল সরকার মহারাজকে পুলিশ আটক করতে বাধ্য হয়। কারণ, স্থানীয় তৌহিদি জনতা তাঁর প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছিল। রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে নিজেকে সুফি দাবি করা নুরুল হক মোল্লা ওরফে নুরাল পাগলার কবর নিয়ে দীর্ঘদিনের উত্তেজনার পর প্রথমে তাঁর বাড়ি ভাঙচুর–অগ্নিসংযোগ, পরে কবর থেকে মরদেহ তুলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
‘তৌহিদি জনতা’ বা ‘বিক্ষুব্ধ মুসল্লি’দের চাপেই দিনাজপুর ও জয়পুরহাটে নারীদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধ হয়ে যায়, খেলা ঘিরে সংঘর্ষও হয়। ঢাকায় একই ধরনের চাপে চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাসের একটি অনুষ্ঠান তাঁকে ছাড়াই অনুষ্ঠিত হয়। আগেও তৌহিদি জনতার নামে সহিংসতা ছিল, কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর এসব আক্রমণের বিস্তার স্পষ্টভাবে বেড়ে গেছে।
২.
প্রশ্ন শুধু কতগুলো মাজার বা অনুষ্ঠান আক্রমণের শিকার হলো, তা নয়; প্রশ্ন হচ্ছে, কারা এসব ঘটাচ্ছে এবং কেন? বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা যায়, হামলাকারীদের বড় একটি অংশ ধর্মীয় রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত, অথবা সেই রাজনীতির সমর্থক। দিনাজপুর–জয়পুরহাটে নারীদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধের ঘটনায় কারা জড়িত জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বিবিসিকে বলেন, ‘এরা সম্ভবত মাদ্রাসার ছাত্র ও মুসল্লি।’
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার–এর ওপর হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া অনেকেই সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। মোটের ওপর নির্দিষ্ট গোষ্ঠীগুলোই এই সহিংসতার মূল চালক; তারা নিজেরাই নিজেদের পরিচয় দেয় ‘তৌহিদি জনতা’ হিসেবে। সেই বিবেচনায় এই লেখায় তাদের স্বঘোষিত পরিচয়ই ব্যবহার করা হয়েছে, এটি কোনো বাইরের আরোপিত লেবেল নয়।
এদের দুটি ধারা। এক ধারা বলে তারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভেতরে থেকে কাজ করতে চায়, আরেক ধারা সরাসরি গণতন্ত্র ও আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে শরিয়াহভিত্তিক রাষ্ট্র গড়তে চায়। কিন্তু দুই পক্ষের লক্ষ্যই এক—নিজেদের ব্যাখ্যা করা ধর্মীয় বয়ানকে সবার ওপর চাপিয়ে দেওয়া এবং রাষ্ট্রের একক নিয়ন্ত্রণ নেওয়া।
প্রথম ধারাটি রাজনৈতিক দল ও তাদের ছাত্র–যুব শাখার মাধ্যমে কাজ করে; নিজেদের প্রচারমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী ও প্রোপাগান্ডা নেটওয়ার্কজুড়ে শত্রু চিহ্নিত করছে, আর সেই শত্রুর বিরুদ্ধে শক্তি ব্যবহারকে ‘ন্যায়সংগত’ বলে জনমত বানাচ্ছে। সাম্প্রতিক প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, উদীচী ও ছায়ানটে হামলার আগে–পরে আমরা দেখেছি এই দলগুলোর ছাত্রনেতারা প্রকাশ্যে হামলার আহ্বান জানিয়েছেন; পরে আবার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন শিবির এক বিবৃতিতে বলেছে, যেসব নেতার নামে উসকানির অভিযোগ উঠেছে, তা নাকি তাদের ব্যক্তিগত দায়, সংগঠনের নয়।
দ্বিতীয় ধারাটি আরও কট্টর। তারা বিভিন্ন সামাজিক ও আদর্শিক গ্রুপের নামে কাজ করে এবং অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি ভাঙচুর–হামলার নেতৃত্ব দেয়, কখনো ‘তৌহিদি জনতা’, কখনো ‘জাগ্রত মুসলিম জনতা’ হয়ে। সুফিকেন্দ্র আক্রমণ, নারীদের খেলা বন্ধ করে দেওয়া, মাজার ধ্বংস বা সংঘাত উসকে দেওয়ার মাধ্যমে তারা শুধু শক্তি প্রদর্শনই করে না, বরং স্পষ্ট বার্তা দিতে চায়; ‘আমরা যে সমাজ চাই, সেটি এমনই হবে।’
এ ধরনের সহিংসতা ও সহিংসতার সমর্থনে বানানো বয়ানের স্পষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও আছে। বাস্তবতা হলো, এগুলো সেই নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর ‘গভর্নমেন্টালিটি’ (শাসন বা নিয়ন্ত্রণপদ্ধতি) প্রকল্পের অংশ; এর মাধ্যমে তারা দেখায় যে যদি তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় যায়, তাহলে এমন এক শাসন কায়েম করবে, যা তাদের মতের বাইরে অন্য কোনো বিশ্বাস বা সাংস্কৃতিক চর্চা বরদাশত করবে না। তাই এ ধরনের সহিংসতা কোনো সংঘাতের ‘পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া’ বা দুর্ভাগ্যজনক ‘কোলাটেরাল ড্যামেজ’ নয়। তারা এর মাধ্যমে ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও গণমাধ্যমকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে নিজেদের রাজনৈতিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায়। এ প্রকল্পের কেন্দ্রে আছে এই ইসলামপন্থী রাজনৈতিক ও কট্টরপন্থীদের নির্দিষ্ট ‘ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি’ থেকে তৈরি হওয়া সাম্প্রদায়িক কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি।
৩.
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রথম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য–বিষয়ক মামলা আমাদের বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কট্টরপন্থীদের রাজনীতি বুঝতে সাহায্য করবে। এ মামলার কেন্দ্রীয় যুক্তি ছিল, মাজার, গ্রন্থাগার ও ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংস করা শুধু ভাঙচুর নয়, এটিও শাসনের এক পদ্ধতি।
২০১২ সালে আনসার দ্বীন ও তাদের মিত্রগোষ্ঠীগুলো যখন মালির উত্তরে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন আহমাদ আল ফাকি আল মাহদি তিমবাকতুর ১০টি ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক স্থাপনার ওপর হামলা করে। এর মধ্যে ৯টি ছিল ইউনেসকোর বিশ্ব–ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর আল মাহদিকে সাংস্কৃতিক সম্পত্তির ওপর ইচ্ছাকৃত হামলা পরিচালনার জন্য যুদ্ধাপরাধে দোষী সাব্যস্ত করেন। আদালত ২০১৭ সালে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ২ দশমিক ৭ মিলিয়ন ইউরো ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেন।
এই রায় ও আদালতের বিতর্কটি দুই দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এ রায়টি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধ্বংসকেন্দ্রিক প্রথম রায় এবং প্রথমবারের মতো কোনো জিহাদিকে আইসিসিতে বিচার করা হয়। আমি মূলত রায় ও রায়–সম্পর্কিত বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে হওয়া হামলার সঙ্গে ক্ষমতা ও রাজনীতির যে চিত্র সামনে আসছে, তা আলোচনায় আগ্রহী।
বাংলাদেশে ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের সহিংসতাকে অপরাধের তালিকা ধরে দেখলে ভুল হবে। কয়েকজনকে গ্রেপ্তার বা সাজা দিলেই এর সমাধান হবে না। এটি মূলত রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল ও রাষ্ট্রের চরিত্র বদলে দেওয়ার প্রকল্প। যেখানে হামলা হচ্ছে, তা আমাদের নাগরিক জনপরিসরের অংশ; হামলাকারীরা সেই জনপরিসর ভেঙে নিজেদের মতের মানুষের জন্য নতুন জনপরিসর বানাতে চায়, যাতে সেটি শাসনের অস্ত্রে পরিণত হয়। তাদের কাছে এসব কাজ অপরাধ নয়, বরং ‘প্রতিরোধ’ বা ‘বিপ্লব’।
আইসিসির মামলার কাগজপত্রের একটা বিষয় স্পষ্ট করে যে এই ধ্বংসগুলো কেবল বিদেশিদের চমকে দেওয়ার জন্য করা কাজ নয়। এগুলো ছিল ‘গভর্নমেন্টালিটি’ প্রকল্পের অংশ, অর্থাৎ সমাজব্যবস্থাকে নতুন করে বানানোর কৌশল। এর মাধ্যমে আক্রমণকারীরা নতুন বাস্তবতা তৈরি করতে চেয়েছিল, যা নির্ধারণ করবে জনপরিসরে কে বা কারা বা কোন বিষয়গুলো সম্মান পাবে।
এ আলোচনায় যাওয়ার আগে ফরাসি চিন্তাবিদ মিশেল ফুকোর ‘গভর্নমেন্টালিটি’ শব্দটি ব্যাখ্যা করে নেওয়া ভালো। সহজ করে বললে, ফুকো দেখান যে শাসন কেবল আইন, পুলিশ বা বলপ্রয়োগের ভেতর সীমাবদ্ধ থাকে না। শাসন মানুষের দৈনন্দিন অভ্যাস, বিশ্বাস, স্মৃতি, ভয়, আকাঙ্ক্ষা, এমনকি ‘কী স্বাভাবিক’ আর ‘কী অস্বাভাবিক’ সেই বোধও গড়ে তোলে। রাষ্ট্র বা ক্ষমতাধর গোষ্ঠী এই কাজটা করে নানা প্রতিষ্ঠান, ভাষা, ‘সত্য’ তৈরির কৌশল এবং নিরাপত্তার যুক্তি ব্যবহার করে।
ফুকোর ‘গভর্নমেন্টালিটি’ কনসেপ্টের পরিপ্রেক্ষিতে তিমবাকতুর ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক স্থাপনার ওপর হামলার ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। এ হামলার মাধ্যমে হামলাকারীরা একসঙ্গে তিনটি কাজ করেছে। প্রথমত, তিমবাকতুর নাগরিক জীবনে দীর্ঘদিন ধরে গ্রহণযোগ্য যে স্থানীয় সুফিধারার নৈতিক কর্তৃত্ব ছিল, তা মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। দ্বিতীয়ত, একটি নতুন শাসনপদ্ধতি ঘোষণা করছে, যেখানে স্মৃতিসৌধ, উপাসনা ও দৈনন্দিন আচরণকে সংকীর্ণ ধর্মীয় আক্ষরিকতাবাদের নিয়মে নিয়ন্ত্রিত করা হবে।
তৃতীয়ত, এসব স্থানের প্রতীকী ও বস্তুগত ‘অর্থনীতি’ আছে। যেমন তীর্থযাত্রীদের সেখানে যাওয়া, ওই স্থানের ঐতিহাসিক স্থানীয় মর্যাদা এবং এর মাধ্যমে সমাজ যেসব গল্পে নিজেদের অতীত বলে। আক্রমণকারীরা সেই অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণে নিতে চেয়েছে। সেই অর্থে আমরা বলতে পারি, তিমবাকতুর ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক স্থাপনার ওপর হামলার যে ছবি ইউনেসকোকে পাঠানো হয়েছে, তা মূলত মালির ভেতরে এক কর্তৃত্ববাদী শাসনের নকশা উপস্থাপনমাত্র।
আদালতে ও দণ্ড–পরবর্তী ইউনেসকো কুরিয়ারে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আল মাহদি এই যুক্তি দেয়, সে আসলে অভিযানটিকে ‘বিকৃত চর্চার সংশোধন’ হিসেবে দেখেছে। সে ও তার দল এ ঘটনাকে ফ্রেম করেছিল ‘বিকৃত চর্চার সংশোধন’ হিসেবে। এর উদ্দেশ্য ছিল মালির রাস্তাঘাটের পাশাপাশি জনগণের আত্মা ও বিশ্বাসের ওপরও নিজেদের মতাদর্শের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।
আইসিসি এসব যুক্তিকে কোনোভাবেই বৈধতা দেননি। তাঁরা একে সহিংসতার ঘটনার স্বীকারোক্তি হিসেবে নিয়েছেন, অজুহাত হিসেবে নয়। আসলে যারা এ ধরনের হামলা করে, তারা কেবল স্থাপনা ভাঙে না বরং তারা সমাজের বহুত্ববাদের চিহ্নগুলো উপড়ে ফেলে মানুষকে স্বৈরাচারী শাসনের উপযুক্ত হিসেবে গড়ে নিতে চায়।
৪.
একই ধরনের যুক্তি আমরা অন্য জায়গায়ও দেখি। ২০০১ সালের মার্চে আফগানিস্তানে তালেবান ষষ্ঠ শতকের বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। ২০১৫ সালে ‘ইসলামিক স্টেট’ সিরিয়ার পালমিরায় বেল মন্দির, বালশামিন মন্দির এবং আর্চ অব ট্রায়াম্ফের অংশ উড়িয়ে দেয়। হামলাকারীরা প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক মতামতের নৈতিক কর্তৃত্ব মুছে দিয়ে জনস্মৃতি পুনর্নির্মাণ করতে চেয়েছে। তাদের এই কাজগুলো মূলত সাধারণ মানুষ ও সমাজের ওপর নতুন কট্টরপন্থী নৈতিকতা বসিয়ে এক কর্তৃত্ববাদী শাসন চাপিয়ে দেওয়ার সচেতন রাজনৈতিক কৌশল।
ওপরের উদাহরণগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে মাজার আক্রমণ, বাউলের ওপর আক্রমণ, নারীদের ওপর আক্রমণ, সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ, পত্রিকা ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের ওপর আক্রমণের ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ‘তৌহিদি জনতা’ যখন বাংলাদেশে ঐতিহাসিক স্থাপনা কিংবা মাজার ভেঙে ফেলতে চায় কিংবা দরগাহ আক্রমণ করে, এর উদ্দেশ্য শুধু নিজেদের উপস্থিতি জানান দেওয়া না। এটি আসলে তাদের শাসনের একটি কৌশল। এর লক্ষ্য হলো স্থানীয় পরিচয়কে নিয়ন্ত্রণ করা, ধর্মীয় বৈধতার ওপর নিজেদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা এবং তীর্থ, পর্যটন ও সাংস্কৃতিক পুঁজির প্রতীকী স্থানীয় ‘অর্থনীতি’ দখল করা।
সরকারকে বুঝতে হবে, তারা যদি সত্যিই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চায়, তবে ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান, মাজার–দরগাহ, সুফিকেন্দ্র, শিল্প–সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চার স্থান, সংবাদমাধ্যমকে সুরক্ষা দিতে হবে। এটা কোনো বিলাসী বাড়তি কাজ নয়, নাগরিক সুরক্ষারই অংশ। তৌহিদি জনতা বা কোনো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের কর্মীরা যখন মাজার গুঁড়িয়ে দেয়, নারীদের খেলা বন্ধ করে, ঐতিহাসিক স্থাপনা ভাঙে, পত্রিকা পোড়ায়, গানের স্কুলে আক্রমণ করে, তারা শুধু বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে না; তারা নতুন এক রাজনৈতিক সম্প্রদায় বানাতে চায়, যেখানে বহুত্ববাদী জনপরিসর ধ্বংস হয়ে একক নিয়ন্ত্রণের জনপরিসরে পরিণত হয়। এভাবেই তারা সামাজিক স্তরবিন্যাস বদলে নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে চায় এবং ঠিক করতে চায় কে ‘গ্রহণযোগ্য মুসলিম’, কার নাগরিকত্ব স্বীকৃত হবে আর কে সেই অধিকার থেকে বাদ পড়বে।
বাংলাদেশে ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের সহিংসতাকে অপরাধের তালিকা ধরে দেখলে ভুল হবে। কয়েকজনকে গ্রেপ্তার বা সাজা দিলেই এর সমাধান হবে না। এটি মূলত রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল ও রাষ্ট্রের চরিত্র বদলে দেওয়ার প্রকল্প। যেখানে হামলা হচ্ছে, তা আমাদের নাগরিক জনপরিসরের অংশ; হামলাকারীরা সেই জনপরিসর ভেঙে নিজেদের মতের মানুষের জন্য নতুন জনপরিসর বানাতে চায়, যাতে সেটি শাসনের অস্ত্রে পরিণত হয়। তাদের কাছে এসব কাজ অপরাধ নয়, বরং ‘প্রতিরোধ’ বা ‘বিপ্লব’। ফলে বহুত্ববাদী জনপরিসর ও নাগরিকের সুরক্ষা এখন শুধু আইনশৃঙ্খলার প্রশ্ন নয়; গণতন্ত্র, সহাবস্থান ও ভবিষ্যৎ নাগরিক অধিকার রক্ষার প্রশ্ন।
আসিফ বিন আলী বর্তমানে কাজ করছেন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। তিনি পেশায় শিক্ষক, গবেষক ও স্বাধীন সাংবাদিক।
ই–মেইল: [email protected]
*মতামত লেখকের নিজস্ব
