এই শিশু দুটির ছবি দেখার পরও বিবেক জাগবে না?

ডেঙ্গুতে এক সপ্তাহের মধ্যে মারা যাওয়া দুই শিশুর ছবি। আরাফাত হোসেন রাউফ ও ইসনাত জাহান রাইদা। দুই ভাই-বোন।

দুর্ঘটনায়-অপঘাতে কারও অকালমৃত্যুর খবর শুনলে আগে মনে হতো, মৃত মানুষটা তো আমিও হতে পারতাম! এই তো সেদিন, গাজীপুরের এক পোশাক কারখানার কর্মীরা ছুটি নিয়ে বেড়াতে বের হলেন সিলেটের দিকে, পথে ট্রাকের ধাক্কায় মাইক্রোবাস দুমড়েমুচড়ে শেষ, মারা গেলেন সাতজন। এই খবর পড়েও মনে হয়েছে, এই লাশগুলোর একটা হতে পারত আমারও। কত জায়গাতেই তো আমরা গেছি মাইক্রোবাস নিয়ে, বেড়াতে, কাজে।

শিল্পী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা খালিদ মাহমুদ মিঠু মারা গিয়েছিলেন (২০১৬) বড় অদ্ভুতভাবে, ধানমন্ডিতে রিকশায় যাচ্ছিলেন, একটা গাছ ভেঙে পড়ে ঠিক তাঁর ওপরেই। এ ধরনের খবর পড়লেও মনে হয়, আমিও তো কত গেছি ধানমন্ডির ওই পথটা দিয়ে, এই গাছটা তো আমার মাথার ওপরেও ভেঙে পড়তে পারত। বেঁচে যে আছি, এই বাংলাদেশে, এই ৫৮ বছর বয়স পর্যন্ত, সেটাই একটা আশ্চর্য ঘটনা।

আরও পড়ুন

কিন্তু এই ছবির দিকে আরও একবার তাকান। ডেঙ্গুতে এক সপ্তাহের মধ্যে মারা যাওয়া দুই শিশুর ছবি। আরাফাত হোসেন রাউফ ও ইসনাত জাহান রাইদা। দুই ভাই-বোন। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এক সপ্তাহের ব্যবধানে মারা গেছে ফুলের মতো এই দুই শিশু। ১৮ আগস্ট আরাফাত এবং ২৫ আগস্ট ২০২৩ রাইদা মারা গেছে। আরাফাতের বয়স ছিল ৯ বছর। আর রাইদার সাড়ে ৬। মধ্য পাইকপাড়ার বাসার কাছে আইকন একাডেমি নামের একটি স্কুলে আরাফাত হোসেন কেজি আর রাইদা নার্সারিতে পড়ত। তাদের বাবা মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও মা রাবেয়া আক্তার। ইব্রাহিম সাহেব রেন্ট–এ–কারের ব্যবসা করতেন।

প্রথম আলো অনলাইনে ৩০ আগস্ট ২০২৩-এর খবরে আরাফাতের হাতের লেখা ছাপা হয়েছে। মুক্তার মতো ঝকঝকে সেই হস্তাক্ষর। প্রথমে গেল আরাফাত। তারপর রাইদা। আরাফাতকে ডেঙ্গুতে হারানোর পর মা-বাবা রাইদার চিকিৎসার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, কোনো ত্রুটি রাখেননি।

ছেলে–মেয়ের খেলনা আর বই–খাতা সামনে শোকার্ত বাবা–মা। দুই সন্তানকে হারানো এই দম্পতি বেশিক্ষণ নিজেদের ঘরে টিকতে পারছেন না।
ছবি: মানসুরা হোসাইন
আরও পড়ুন

ইব্রাহিম সাহেব বলেছেন, ‘ছেলেটা চিকিৎসা করানোর কোনো সুযোগই দিল না। ছেলেটা মারা যাওয়ার পর আমি আর আমার স্ত্রী ভেবেছি, হয়তো আমরা তার চিকিৎসায় কিছুটা হলেও অবহেলা করেছি। তাই মেয়ের ডেঙ্গু পজিটিভ হলে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করিনি। কিন্তু হাসপাতালে শয্যা নেই, শিশুদের পিআইসিইউ নেই, পাগলের মতো কত জায়গায় ঘুরলাম। ছেলে মারা যাওয়ার খবর পাওয়ার পরও কোনো কোনো হাসপাতাল আমাদের জিম্মি করে রাখল। চিকিৎসকেরা যখন যা লাগবে বলেছেন, তা-ই করেছি, কিন্তু মেয়েকেও ফেরাতে পারলাম না।’ [ডেঙ্গুতে এক সপ্তাহের মধ্যে দুই ছেলে-মেয়েকেই হারালেন এই বাবা-মা, মানসুরা হোসাইন, প্রথম আলো অনলাইন, ৩০ আগস্ট, ২০২৩]

এই বাচ্চা দুটোর ছবির দিকে আরেকবার তাকান। তাদের শোকার্ত মা-বাবার মনের ওপর দিয়ে কী ঝড়টা বয়ে যাচ্ছে, সেটা কি আমরা কল্পনাও করতে পারব?

আরও পড়ুন

বলছিলাম, কিছু দুর্ঘটনার খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়, এটা তো আমার বেলায়ও হতে পারত। উদ্বেগ এসে ভর করে। কিন্তু খবরটা পড়ে মনে হচ্ছে, বেঁচে আছি কেন! আল্লাহ তাআলা বরং আমাদের মতো বুড়ো মানুষগুলোকে নেয় না কেন?

ডেঙ্গু পরিস্থিতি যে ভয়াবহ, আমরা কি তা বুঝতে পারছি! আমরা কি তা স্বীকার করে নিয়েছি! সরকার কি দেশে রেড অ্যালার্ট ঘোষণা করেছে? প্রতিরোধ থেকে চিকিৎসার পেছনে সবাই মিলে কি আমরা একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েছি!

দুর্যোগকে কিছু মানুষ সব সময় অন্যদের প্রতারণা করা এবং নিজেদের ভাগ্য একদিনে ফেরানোর সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে। আলবেয়ার কামুর লেখা প্লেগ উপন্যাসেও আমরা তা দেখেছি। করোনার সময় দেখেছি, কী করে পরীক্ষা না করেই কোভিড টেস্টের রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। দেখেছি, কী করে ১০ টাকার জিনিস হাজার টাকায় গছানোর চেষ্টা হয়েছে। ডেঙ্গুর মধ্যেও প্রতারকের দল, ঠগবাজের দল, দুর্নীতিবাজ মুনাফাখোরের দল তৎপর হবে, তাতে আর আশ্চর্য কী!

সারা ঘরে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে দুই ভাই–বোনের বই–খাতাসহ নানা জিনিস, কিন্তু তারা আর কখনো ফিরবে না
ছবি: মানসুরা হোসাইন
আরও পড়ুন

কিন্তু সবাই মিলে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে একটা চূড়ান্ত যুদ্ধে নামার ডাক কেন দেওয়া হচ্ছে না? ডেঙ্গুতে ডাক্তার মারা যাচ্ছেন, পুলিশ মারা যাচ্ছেন, শিশুরা তো মারা যাচ্ছেই, তারপরও এই মূঢ় জাতির চৈতন্যোদয় হচ্ছে না কেন? আমরা মশার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পারব না, হেরে যাব? পরিষ্কার পানি জমতে দেব না, এই স্লোগান বাস্তবায়িত করতে পারব না? একযোগে মশা মেরে সাফ করে ডেঙ্গুমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে পারব না? কীটবিশেষজ্ঞ, মশাবিশেষজ্ঞ, জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক, সমাজকর্মী, সমাজের সর্বস্তরের মানুষ, সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সামাজিক শক্তি, ছাত্র, যুবা—সবাই মিলে একটা সর্বাত্মক অভিযানে আমরা নামতে পারি না?

ডেঙ্গুতে শিশুদের মৃত্যুতে পুরো জগৎ রিক্ত, নিঃস্ব, শূন্য মনে হচ্ছে! পাশাপাশি এ-ও বলি, মশা কিন্তু আমির-ফকির আলাদা করবে না। আপনার ৫ কোটি টাকার গাড়িতে একটা ডেঙ্গুর ভাইরাসবাহী এডিস মশা যে বসে নেই, আপনি কি নিশ্চিত?

আরও পড়ুন

একজন মন্ত্রী প্রকাশ্য সভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে সব কথা ভুলে গিয়েছিলেন একটা মশা দেখে। ওই মন্ত্রীর ওই ভয়টা মোটেও অমূলক নয়। মশা সাপের চেয়ে কম ভয়ংকর নয়! সন্তানহারা মায়ের কান্না দেখে বিচলিত হয়ে নয়, নিজেকে বাঁচানোর জন্য হলেও মশা মারুন। ডেঙ্গুর চিকিৎসায় সর্বশক্তি নিয়োগ দিন।

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক