সহনশীলতা না থাকলে ইনসাফের বাংলাদেশ কী করে হবে

গত বৃহস্পতিবার রাতে সন্ত্রাসীরা রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ভাঙচুর–লুটপাট চালায়। পরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় কার্যালয়টি।ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশের সামাজিক ইতিহাস ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদী চর্চার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানেও বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গির অনন্য সহাবস্থান আমরা দেখেছি।

যে সৌন্দর্য আমরা এই বৈচিত্র্যের মধ্যে খুঁজে পেয়েছি, তাকে লালন করে আমরা জুলাই-পরবর্তী একটি সাম্যের এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ইনসাফের বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছি। কেননা, বৈচিত্র্যের উদ্‌যাপন সব সময়ই সুন্দর ও আকাঙ্ক্ষিত।

অথচ প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার-এর মতো স্বাধীন গণমাধ্যম ও ছায়ানট-এর মতো সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের ওপর সাম্প্রতিক সহিংস হামলা সহনশীলতার এই পরিসরের সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি করেছে।

কারণ এই পরিসর দীর্ঘদিন ধরে ভিন্নতা ও মতপ্রকাশের নিরাপদ ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করেছে।

আরও পড়ুন

সংবাদমাধ্যমের ওপর এ ধরনের সহিংসতা বিগত সময়ে আমরা না দেখলেও তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করার প্রক্রিয়া আমরা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী সময়ে থেকে থেকে দেখতে পাই, যার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ সাম্প্রতিক এই হামলা।

এর সঙ্গে রয়েছে কিছু কর্তাব্যক্তির এ ধরনের ‘মব’কে ‘প্রেসার গ্রুপ’ বলে আখ্যায়িত করে ধীরে ধীরে জনপরিসরে তাদের বৈধতা প্রদান করা যা এ ধরনের সমস্যাগুলোকে আরও বৃদ্ধি করার পেছনে ভূমিকা রেখেছে। এখানে সরকারের ব্যর্থতা ও দায় এড়ানোর কোনো উপায় নেই।

তাই এই ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্নভাবে দেখারও সুযোগ নেই এবং এগুলো আকস্মিক কোনো ঘটনাও নয়; বরং একে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও সংগঠিত চর্চা হিসেবে দেখতে হবে।

আরও পড়ুন

ভিন্নমত ও সমালোচনামূলক কণ্ঠকে ‘জাতীয় স্বার্থবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং সংস্কৃতি ও গণমাধ্যমকে ‘বিদেশি প্রভাবে প্রভাবিত’ বা বিজাতীয় বলে চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে এসব পরিসরের বৈধতাকে খর্ব করা হয়।

অপর দিকে এ ধরনের কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে সহিংসতার বৈধতার বয়ানও তৈরি করা হয়। এভাবে ধীরে ধীরে সহিংসতা ক্ষমতার একটি অবিচ্ছেদ্য ভাষা হয়ে ওঠে।

কে কী বলতে পারবে, কোন সংস্কৃতি গ্রহণযোগ্য আর কোনটি নয়—এই সীমারেখা টানার মধ্য দিয়েই ক্ষমতা নিজেকে প্রকাশ করে।

গণমাধ্যম বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা সেই সীমারেখা নতুন করে আঁকারই একটি প্রচেষ্টা।

আরও পড়ুন

এর মধ্য দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাকেও দুর্বল হিসেবে বৃহত্তর সামাজিক পরিসরে উপস্থাপন করা হয় এবং এর বিপরীতে একটি নতুন নৈতিকতা নির্মাণের প্রচেষ্টা নেওয়া হয়।

তখন গান, উৎসব বা লেখার মূল্যায়ন আর সাংস্কৃতিক বা নান্দনিক থাকে না; তা হয়ে ওঠে নৈতিক শুদ্ধতার প্রশ্ন।

একবার কোনো কিছুকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ ঘোষণা করা হলে, সেখানে ভিন্নমতের জায়গা খুব দ্রুত সংকুচিত হয়ে আসে। তাই এর বিরুদ্ধে সবাইকে দাঁড়াতে হবে। কারণ এর কোনো বিকল্প আমাদের সামনে নেই।

এটি না করা গেলে এই প্রক্রিয়া সমাজে একধরনের নৈতিক আতঙ্ক তৈরি করতে শুরু করবে।

এই আতঙ্কের রাজনীতির বারবার ফিরে আসাও আমরা অতীতে দেখেছি। ‘আমরাই প্রকৃত দেশপ্রেমী’—এ ধরনের বয়ানের বিপরীতে অন্যদের দাঁড় করানো হয়েছে সন্দেহের কাঠগড়ায়।

সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরের ক্রমাগত ছোট হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে এর ফল আমরা দেখেছি।

আরও পড়ুন

এ প্রসঙ্গে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয় হলো, এসব ঘটনার প্রভাব কেবল আক্রান্ত প্রতিষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ থাকে না।

উদ্বেগজনক দিক হলো, এর দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক প্রভাব। হামলার লক্ষ্যবস্তু কেবল নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান নয়; বরং পুরো সমাজেই এর প্রভাব পড়ে।

ভয় ও অনিশ্চয়তা আত্মসংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের সংস্কৃতি তৈরি করে, যেখানে মানুষ প্রশ্ন করা বা ভিন্নমত প্রকাশ থেকে বিরত থাকে। ধীরে ধীরে অসহিষ্ণুতা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে সামাজিক অভ্যাসের মাধ্যমে।

সাধারণ মানুষের মধ্যে এসব নানাবিধ প্রভাবের কারণে মানুষও ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে যা আমরা পতিত আওয়ামী সময়ে পদে পদে উপলব্ধি করেছি।

পরবর্তী সময়ে সেই ধরনের প্রচ্ছন্ন প্রভাব পড়তে থাকে আমাদের লেখালেখির মধ্যে। যেমন কেউ কিছু লেখার আগে দুবার ভাবে, কিংবা কেউ গান গাওয়ার আগে থেমে যায়—যাকে আমরা একাডেমিক ভাষায় ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ বলে থাকি।

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা ও আগুন দেওয়া এবং সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নূরুল কবীরকে হেনস্তার প্রতিবাদে মানববন্ধন। কারওয়ান বাজারে প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলের পাশে।
ছবি: প্রথম আলো

এই থেমে যাওয়াই সহনশীলতার সবচেয়ে বড় ক্ষতি। কারণ, ভয় একসময় অভ্যাসে পরিণত হয়।

এই যদি চলতে থাকে, তাহলে জুলাই-পরবর্তী সময়েও আমরা এই ভয়ের অভ্যাস বা সংস্কৃতি থেকে আর বের হতে পারলাম কোথায়।

তাই এটি কেবল একটি প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করার বিষয় নয়; বরং এটি আমাদের কাম্য সমাজকে রক্ষা করার সঙ্গে যুক্ত, যেখানে বৈচিত্র্য ও বহুচিন্তার সম্মিলন ঘটবে একটি সামাজিক ও সহনশীল প্রক্রিয়ায়।

যে সমাজ তার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও সংবাদমাধ্যমকে রক্ষা করতে পারে না, সেই সমাজ আদতে সংলাপ, ভিন্নমতের অন্তর্ভুক্তি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকেই অস্বীকার করে। এটি কোনোভাবেই আমাদের জন্য কাম্য নয়।

এখানে রাষ্ট্রের ভূমিকা এবং আমাদের সামাজিক প্রতিক্রিয়াও গুরুত্বপূর্ণ। সহিংস ঘটনার পর যদি প্রতিবাদ, বিচার ও স্পষ্ট জবাবদিহির চর্চা না থাকে, তাহলে নীরবতা একধরনের স্বীকৃতি হিসেবে কাজ করে।

ইতিহাস বলে, এই নীরবতার মূল্য সমাজকে দীর্ঘদিন ধরে দিতে হয়। আমরা তো এমন একটি বাংলাদেশ চাইনি, যেখানে গান গাওয়া, লেখা বা প্রশ্ন তোলা মানুষের জন্য ঝুঁকির বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।

সহনশীলতা কোনো বিমূর্ত আদর্শ নয়; এটি দৈনন্দিন চর্চা। এই চর্চা দুর্বল হলে রাষ্ট্র হয়তো টিকে থাকে, কিন্তু সমাজের অবক্ষয় অবধারিত।

সেই ক্ষয় নীরবে ঘটে—আর ঠিক সেই কারণেই তা সবচেয়ে বিপজ্জনক। এতে সমাজের সব স্তরে অসহিষ্ণুতার চর্চা দেখা যায়। আর ভিন্নমতের অবদমন থেকে শুরু করে সহিংসতার মৌলিক কারণগুলোর পেছনের কারণ হলো এই সহনশীলতার অভাব।

একটি বহুত্ববাদী সামাজিক ব্যবস্থা লালনের মধ্য দিয়ে এই বাংলাদেশ তখনই টিকে থাকবে, যখন তার সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরগুলো টিকে থাকবে। এই সত্য ভুলে যাওয়ার সুযোগ আমাদের নেই।

তাই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এমন অবস্থার দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।

সহনশীলতা একটি সমাজের বহুত্ববাদীর চর্চা। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সৌহার্দ্য এবং সম্প্রীতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই সহনশীলতা আমাদের সমাজে টিকিয়ে রাখতে কেবল কিছু তথাকথিত অঙ্গীকারই যথেষ্ট নয় বরং জনপরিসরে বহুত্ববাদী চর্চাগুলোকে ধারাবাহিকভাবে সুরক্ষা দিতে হবে।

সামনেই আমাদের নির্বাচন, এমন অবস্থায় ওসমান হাদির মতো একজন নির্ভীক তরুণ নেতাকে সহিংসভাবে হত্যা করা এবং তাঁর মৃত্যুকে পুঁজি করে এমন দুর্বৃত্তায়ন, কোনোভাবেই আমাদের জন্য কাম্য নয়।

ওসমান হাদির মৃত্যুর জন্য দোষীদের যেমন খুঁজে বের করতে হবে, তেমনি সাম্প্রতিক হামলার পেছনের কুশীলবদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

আমাদের মনে রাখতে  হবে, এ ধরনের কর্মকাণ্ড আমাদের একটি গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথকে যদি আরও সংকটময় করে তোলে, তাহলে এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় আর কিছু হতে পারে না।

তাই সব রাষ্ট্রযন্ত্র, সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধি ও সমাজের সবাইকে এ বিষয়ে সোচ্চার কণ্ঠে এগিয়ে আসতে হবে।

আমাদের একটি সাম্যের ও মানবিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য সেই বিশ্বাস আমাদের হৃদয়ে রাখতে হবে। কিছু দুষ্কৃতকারীর জন্য আমরা যেন সেই লক্ষ্য থেকে পিছু না হঠি, সেদিকে আমাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে।

সহনশীলতা একটি সমাজের বহুত্ববাদীর চর্চা। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সৌহার্দ্য এবং সম্প্রীতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

তাই সহনশীলতা আমাদের সমাজে টিকিয়ে রাখতে কেবল কিছু তথাকথিত অঙ্গীকারই যথেষ্ট নয় বরং জনপরিসরে বহুত্ববাদী চর্চাগুলোকে ধারাবাহিকভাবে সুরক্ষা দিতে হবে।

আর এটি করতে হবে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উভয় প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে। কেননা, এই জনপরিসরগুলোর টিকে থাকার ওপরই নির্ভর করছে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক ভবিষ্যৎ।

  • বুলবুল সিদ্দিকী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়