ঘটনাগুলো ৩১ জানুয়ারি থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ঘটেছে। কোনোটি চট্টগ্রামে, কোনোটি রাজশাহী বা সিলেটে আবার কোনোটি ঘটেছে ঢাকায় বা কুষ্টিয়ায়। হামলা, ভাঙচুর, মারধর, ছিনতাই, নির্যাতন-নিপীড়নসহ ক্ষমতার দম্ভ প্রদর্শনের ঘটনা এসব। সবকটি ঘটনায় ছাত্রলীগের নাম এসেছে এবং সংগঠনের নেতা-কর্মীরাই এসব ঘটিয়েছেন। মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধানে দেশের বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসব ঘটেছে।
ওপরে যে কয়েকটি ঘটনার কথা বলা হলো, সেসব ঘটনায় প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোর শিরোনাম পড়ে নিন।
১. চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: সাবেক ছাত্রলীগ নেতার নিয়োগ হয়নি, উপাচার্যের দপ্তরে ভাঙচুর।
২. রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়: দুই শিক্ষার্থীর আসন ‘দখলে’ নিল ছাত্রলীগ।
৩. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: কাভার্ড ভ্যান আটকে ‘ছিনতাই’, ছাত্রলীগ কর্মীসহ গ্রেপ্তার ৩।
৪. শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়: ছাত্রলীগ নেতাকে আরেক নেতার সমর্থকদের মারধর।
৫. চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ: ছাত্রলীগের ‘নির্যাতনের শিকার’ দুই ছাত্র আইসিইউতে।
৬. ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ছাত্রীকে সাড়ে ৪ ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন: নেতৃত্বে ছাত্রলীগ নেত্রীরা।
বলে রাখা ভালো, ৩১ জানুয়ারি থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শুধু যে এই ছয়টি ঘটনা ঘটেছে তা নয়। ছয়টি ঘটনার কথা বলা হলো একটি সামগ্রিক চিত্র বোঝাতে। ঢাকা হোক আর কুষ্টিয়া হোক কিংবা চট্টগ্রাম বা রাজশাহী হোক—উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোর চিত্র মোটামুটি একই রকমের, সেটি হচ্ছে ক্ষমতার দম্ভ ও দাপটে বেপরোয়া হয়ে উঠছেন ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী। অবশ্য সাংগঠনিকভাবে ছাত্রলীগ এবং প্রশাসনিকভাবে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিছু ব্যবস্থাও নিচ্ছে। কিন্তু এসব ব্যবস্থা পরিস্থিতি পাল্টাতে কতটা কাজে লাগছে সেই প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়।
গত বছরের ২০ ডিসেম্বরে ছাত্রলীগের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। এর ৫ দিনের মাথায় ছাত্রলীগের নতুন সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ সারা দেশে সংগঠনের সব নেতা-কর্মীর জন্য ১০ দফা নির্দেশনা দেন। এর মধ্যে ছয় নম্বর নির্দেশনাটি ছিল—বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল, মাদ্রাসাসহ প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একাডেমিক পরিবেশ বজায় রেখে সাংগঠনিক কর্মসূচি পরিচালনা করতে হবে। শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিটি বিষয়ের প্রতি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
এই নির্দেশনা সারা দেশে কতটা পালন করা হচ্ছে সেটি বলার আর অপেক্ষা রাখে না। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কেউ যদি ছাত্রলীগের কোনো নেতা বা নেত্রীর কথা না শোনেন তাহলে পরিণতি কী হতে পারে সেটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে।
আগে অভিযোগ ছিল, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা হয় প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় নয়তো নিজেরা-নিজেরা মারামারি করে। কিন্তু গত কয়েক বছরে দেখা যাচ্ছে, প্রশ্নফাঁস, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণের মতো ঘটনাতেও ছাত্রলীগের অনেক নেতা-কর্মীর নাম আসছে। এসব ঘটনায় অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন, অনেকের বিরুদ্ধে করা মামলার বিচার চলছে।
সবশেষ কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন সাধারণ ছাত্রীর ওপর ছাত্রলীগের একজন নেত্রী এবং তাঁর অনুসারীরা নির্যাতন চালিয়েছিলেন। এই নির্যাতন যে অমানবিক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই ঘটনার প্রতিবাদ হচ্ছে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়েও। নির্যাতনের শিকার সেই ছাত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত।
কুষ্টিয়ায় ছাত্রলীগের নেত্রীদের ‘কীর্তির’ খবর গণমাধ্যমে আসার বিষয়টি সংগঠনটির নতুন সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের হয়তো পছন্দ হয়নি। সরাসরি এ বিষয়ে কিছু না বললেও ইঙ্গিতে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। ১৮ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জ পৌর ওসমানী স্টেডিয়ামে এক বিশেষ কর্মিসভায় ছাত্রলীগের সভাপতি গণমাধ্যমের কাছে ‘সঠিক দায়িত্বশীলতা’ দাবি করেছেন। ‘ক্ষোভ’ থেকেই হয়তো তিনি বলেছেন, ‘ছাত্রলীগ ১০০টি ভালো কাজ করলে একটিও নিউজ হয় না। আর ছাত্রলীগ একটি খারাপ কাজ করলে ১০০টি নিউজ হয়। আমরা গণমাধ্যমের সঠিক দায়িত্বশীলতা দেখতে চাই।’
ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা অপরাধে জড়ালে কিংবা অন্য কোনো সংগঠনের সঙ্গে বা নিজেরা মারামারি করলে সেই খবর প্রচার ও প্রকাশ করা অবশ্যই গণমাধ্যমের দায়িত্ব। সেটি কম করা কিংবা কম গুরুত্ব দেওয়া কোনোভাবেই গণমাধ্যমের জন্য ‘সঠিক দায়িত্বশীলতা’ হতে পারে না।
ছাত্রলীগের নেতিবাচক ভাবমূর্তি কেন সেটি খোঁজার চেষ্টার চেয়ে গণমাধ্যমের ওপর দায় চাপাতেই ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বেশি উৎসাহী বলে মনে হয়। গত ১৫ জানুয়ারি প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি ছাত্রলীগের নেতিবাচক ভাবমূর্তির দায় চাপিয়েছেন সংবাদমাধ্যমের ‘মনোভাবের’ ওপর। এ ছাড়া ওই সাক্ষাৎকারে তিনি ছাত্রলীগের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের জন্য সংগঠনটিতে ‘অনুপ্রবেশকারীরা’ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দায়ী বলে উল্লেখ করেছেন। তবে এত ‘অনুপ্রবেশ’ ছাত্রলীগে কেন এবং কীভাবে ঘটে সেটি বলেননি তিনি। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেসব ঘটনা ঘটেছে তাতে জড়িত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ‘অনুপ্রবেশকারী’ কাউকে খুঁজে পাওয়া গেছে কি না, সে বিষয়ে সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এখন পর্যন্ত কিছু জানায়নি।
‘ছাত্রলীগকে যাঁদের থামানোর দায়িত্ব, তাঁরা তাকিয়ে তাকিয়ে এসব ঘটনা দেখছেন। তাঁরা কোনো প্রতিক্রিয়াই ব্যক্ত করছেন না।’
সাম্প্রতিক সময়ে নানা ঘটনায় সমালোচনার মুখে এবার ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি ১০ দফা নির্দেশনা দিয়েছে। ১৯ ফেব্রুয়ারি দেওয়া এসব নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ক্যাম্পাসে মোটরসাইকেল শোডাউন (মহড়া), উচ্চ শব্দে হর্ন না বাজানো, ইভ টিজিং, র্যাগিং ও বেআইনি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কোনোভাবেই নেতা-কর্মীদের জড়িত হওয়া যাবে না। এতে আরও বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও আবাসিক হলগুলোয় শতভাগ শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্যোগী হতে হবে। পরিবেশ নষ্ট হতে পারে এমন কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত না হওয়ার কথাও বলা হয়েছে নির্দেশনায়।
এসব নির্দেশনা মানা হবে কী হবে না, সেটি সময়ই বলে দেবে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির দেওয়া নির্দেশনাগুলো সংগঠনের নেতিবাচক ভাবমূর্তি কতটা দূর করতে পারবে সেটিও প্রশ্ন সাপেক্ষ। কারণ, এর আগেও নির্যাতন ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন ঘটনায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি অনেকের বিরুদ্ধে সাংগঠনিকভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। সংগঠন থেকেও অনেককে বহিষ্কার করেছে। কিন্তু এসবের ফল কী, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন রয়েছে। ‘অদম্য’ ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব যাঁদের তাঁরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বড় জোর ‘বকা দিয়েই’ দায়িত্ব শেষ করছেন। এ বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় লিখেছেন, ‘ছাত্রলীগকে যাঁদের থামানোর দায়িত্ব, তাঁরা তাকিয়ে তাকিয়ে এসব ঘটনা দেখছেন। তাঁরা কোনো প্রতিক্রিয়াই ব্যক্ত করছেন না।’
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে নির্যাতনের ঘটনায় ছাত্রলীগের নাম আসার পর বিষয়টি উল্লেখ না করে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ১৮ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জে কর্মী সভায় বলেছেন, ‘ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা প্রেমিক হবে, ভালোবাসতে শিখবে। ছাত্রলীগের কর্মীরা মেয়েদের কাছে প্রেমের চিঠি লিখবে। একই সঙ্গে যারা মেয়েদের ওপর আঘাত করে, নিপীড়ন করার চেষ্টা করে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানাভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করে, তাদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’
প্রেমের চিঠি লেখার আগে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর নির্যাতন বন্ধের অঙ্গীকার দরকার ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের। নিজেদের জন্য পালনীয় যে ১০ দফা নির্দেশনা দিয়েছে ছাত্রলীগ, সেটি আগে মেনে চলুক সারা দেশের নেতা-কর্মীরা। নেতিবাচক ভাবমূর্তির জন্য অন্যকে দোষ না দিয়ে নিজেদের ভুল-ত্রুটি আগে খুঁজে বের করুক ছাত্রলীগ।
ইমাম হোসেন সাঈদ, ডেপুটি হেড অব রিপোর্টিং, প্রথম আলো