বিএনপির ১০ দফা: বিপরীতমুখী অবস্থানে ক্ষমতাসীন ও বিরোধীরা

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দলীয় পতাকা।

রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে গতকাল শনিবার ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশে বিএনপি যে ১০ দফা দাবি পেশ করেছে, তা একেবারেই নতুন নয়। বরং দলটি অনেক দিন ধরেই এসব দাবি জানিয়ে আসছে। এবার তারা দাবিগুলো সুনির্দিষ্ট করল।

বিএনপির দাবির ব্যাপারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অবস্থান পুরোপুরি বিপরীতমুখী। আওয়ামী লীগ স্পষ্টতই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনমুখী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দলটির নেতারা এখন থেকেই মানুষের কাছে ভোট চাইছেন। অন্যদিকে বিএনপি সাফ জানিয়ে দিয়েছে, দাবি আদায় না হলে তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির এই বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায়, তা নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

আরও পড়ুন

বিএনপি কীভাবে তাদের দাবি আদায় করবে? ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ কি বিএনপির দাবি মেনে নেবে? এসব প্রশ্ন মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।

নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবিতে প্রায় এক যুগ ধরে রাজপথে আছে বিএনপি। কিন্তু এই সময় তারা কোনো ফল অর্জন করতে পারেনি। আগামী দিনেও যে দলটি সহজে কিছু পেয়ে যাবে, এমনটা বিএনপির নেতা-কর্মীরাও বিশ্বাস করেন না।

এবার আসা যাক, বিএনপির ১০ দফা দাবিতে কী আছে? দলটির প্রথম ও প্রধান দাবি হলো—বর্তমান অনির্বাচিত, অবৈধ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করে ভোটবিহীন, গণতন্ত্র হরণকারী, লুটেরা ক্ষমতাসীন সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে।

দ্বিতীয় দাবি—১৯৯৬ সালে সংবিধানে সংযোজিত ধারা ৫৮ খ, গ ও ঘ—এর আলোকে দলনিরপেক্ষ একটি অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হবে। বিএনপির বাকি দাবিগুলো মূলত সুষ্ঠু নির্বাচন, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার, মানবাধিকার, সুশাসন, আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত।

আরও পড়ুন

আ.লীগ-বিএনপির বিপরীত যাত্রা

নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পুরোপুরি বিপরীতমুখী অবস্থান সবশেষ দেখা যায় ২০১৪ সালে। তখন যেকোনো মূল্যে নির্বাচন করতে অনড় ছিল আওয়ামী লীগ। আর যেভাবেই হোক নির্বাচন ঠেকাতে চেয়েছিল বিএনপি। আওয়ামী লীগ নির্বাচন করে সরকার গঠন করে। বিএনপি নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থ হয়। তখন ভোটের আগে ও পরে সংঘাত-সহিংসতার চূড়ান্ত রূপ দেখে বাংলাদেশ। বিএনপির টানা হরতাল-অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও এখনো জাতির সামনে দুঃস্বপ্ন হয়ে আছে।

আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়েও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পুরোপুরি বিপরীত অবস্থানে রয়েছে। অনড় অবস্থা থেকে কারও সরে আসা বা সমঝোতার কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। ফলে দেশ কোন দিকে যাচ্ছে, তা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নতুন করে দানা বাঁধছে।

নির্বাচন কমিশন (ইসি) যে ধারণা দিয়েছে, তাতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৪ সালের জানুয়ারির শুরুতে অনুষ্ঠিত হবে। ভোটের এখনো এক বছরের বেশি সময় বাকি। তবে একটা জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য কমপক্ষে তিন থেকে ছয় মাস সময় লাগে।

আরও পড়ুন

আওয়ামী লীগ ঘোষণা দিয়ে এখনই নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যশোর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের সমাবেশে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকায় ভোট চেয়েছেন। আওয়ামী লীগের অন্য নেতারাও ভোট চাইছেন।

বিএনপি গত জুলাই থেকে মোটামুটিভাবে সারা দেশে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ শুরু করেছে। সবশেষ তারা দেশের ১০টি স্থানে বিভাগীয় গণসমাবেশ করেছে। এই সমাবেশের কোথাও তারা ভোট চায়নি। বর্তমান সরকারের অধীন নির্বাচনে না যাওয়ার কথা তারা জোর দিয়ে বলে আসছে।

বিএনপির মূল দাবি হলো, বর্তমান সরকারের পদত্যাগ। দলনিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি স্বাধীন-নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন। অবাধ নির্বাচনের পূর্বশর্ত হিসেবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা।

আরও পড়ুন

বিএনপি শুরু থেকে বর্তমান সংসদকে ‘অবৈধ’ বলে আসছে। তা সত্ত্বেও দলটির সাতজন সংসদ সদস্য বর্তমান সংসদে যোগ দেন। তাঁরা গত চার বছর সংসদের আলোচনায় অংশ নিয়ে সরকারের নানা সমালোচনা করেছেন। তবে গতকাল এই সাতজন সংসদ সদস্য পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। এই ঘোষণার মাধ্যমে বর্তমান সরকার, নির্বাচনব্যবস্থা ও জাতীয় সংসদের প্রতি অনাস্থা প্রকাশকে আরেকটি স্তরে গেল।

ইসি বলেছে, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর বিবাদ মেটাতে তারা উদ্যোগী হবে না। ১৯৯৬, ২০০৬ ও ২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে জাতিসংঘসহ প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিনিধিরা নানাভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করেছে।

দেশের ভেতর থেকে উদ্যোগ নিয়ে ২০০৬ সালে বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের মধ্যে সংলাপ হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেন। তবে এর কোনোটাই ফলপ্রসূ হয়নি।

আরও পড়ুন

এবার বিএনপি তাদের ১০ দফা দাবি আদায়ে সমমনা দলগুলোকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের জোটসঙ্গীসহ সমমনাদের নিয়ে বিএনপিকে কোণঠাসা করতে চাইবে।

বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট চলছে। এর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। নিত্যপণ্যের অত্যধিক মূল্যবৃদ্ধি ও ডলার–সংকট সবাইকে ভাবাচ্ছে। এই সংকটের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মুখোমুখি অবস্থান দেশকে কোথায় নিয়ে যায়, তা ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আরও পড়ুন

নিরপেক্ষ সরকারের ধারণা যেভাবে এল

স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদের পতন ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দল, বিএনপির নেতৃত্বে ৭ দল ও ওয়ার্কার্স পার্টি-জাসদের নেতৃত্বে ৫টি বাম দল আন্দোলনে নেমেছিল, যা তিন জোট নামে পরিচিত। ১৯৯০ সালের ২১ নভেম্বর যৌথভাবে তারা রূপরেখা ঘোষণা করেছিল। জামায়াত তিনদলীয় জোটে না থাকলেও এরশাদবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল।

আরও পড়ুন

তিন জোটের রূপরেখার প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে ছিল—অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন, রেডিও-টেলিভিশনসহ সব রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমকে স্বাধীন-স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় পরিণত করা, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী সব রাজনৈতিক দলের প্রচার-প্রচারণায় অবাধ সুযোগ নিশ্চিত করা, জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা, আইনের শাসন নিশ্চিত করা, মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী সব আইন বাতিল করা।

বিএনপি গতকাল যে ১০ দফা দাবি দিয়েছে, তার প্রায় সব কটি তিন জোটের রূপরেখায় ছিল। অর্থাৎ তিন দশকেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো দেশের নির্বাচনব্যবস্থা কী হবে, সেই বিষয়ে একমত হতে পারেনি।

এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়। কিন্তু তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেনি।

১৯৯৬ সালে আরেকটি নির্বাচনের সময় এলে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলনে নামে। বড় দলগুলোর বর্জনের মুখে ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে বিএনপি। কিন্তু তারা টিকতে পারেনি। শেষমেশ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর সরকার গঠন করে।

আরও পড়ুন

২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন—এ নিয়ে মতবিরোধে আন্দোলনে নামে আওয়ামী লীগসহ বিরোধীরা। সংঘাত-সহিংসতার পর এক-এগারোয় সেনাসমর্থিত সরকার আসে।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল ক্ষমতায় আসে। ২০১১ সালের ৩০ জুন ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে। এতে বাংলাদেশের রাজনীতি পুনরায় সংকটে পড়ে।

২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট বয়কট করে। ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, যা গোটা বিশ্বেই ছিল বিরল।

২০১৮ সালে বিএনপিসহ বিরোধীরা ভোটে অংশ নেয়। তবে এই নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়। নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার অভিযোগ ওঠে।

আরও পড়ুন

আরেকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এবং তাদের সমমনারা এখন মুখোমুখি অবস্থানে। বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচন চায়। আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এই ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নয়।

বাংলাদেশে বিরোধী দলের দাবি আদায়ের যে ইতিহাস, তা অনেকাংশে রাজপথের আন্দোলননির্ভর। এই আন্দোলনে সহিংসতা লক্ষ করা যায়। বিষয়টি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবার কি দেশ এই সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারবে? যদি পারে, তাহলে তা সবার জন্যই মঙ্গল হবে।

আরও পড়ুন