ভোটে শঙ্কা বাড়াচ্ছে অবৈধ অস্ত্র, গুজব

গণভোট ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের মতবিনিময়–ব্রিফিং। মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনেছবি: প্রথম আলো

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট সুষ্ঠু করার পথে অবৈধ অস্ত্র, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার, গুজব ছড়ানো, চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের ঢালাও জামিন, সীমান্তে নিরাপত্তার দুর্বলতাসহ নানা চ্যালেঞ্জ ও আশঙ্কার কথা তুলে ধরেছেন প্রশাসন ও পুলিশের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা।

গণভোট ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার রিটার্নিং কর্মকর্তা ও মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের মতবিনিময় ও ব্রিফিংয়ে এসব চ্যালেঞ্জের কথা উঠে আসে। এসব মোকাবিলায় পদক্ষেপ নিতে নানা পরামর্শও দেন কর্মকর্তারা।

সভায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন। চার নির্বাচন কমিশনারও তাঁদের বক্তব্যে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নির্বাচনসংক্রান্ত নানা দিকনির্দেশনা দেন।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবন মিলনায়তনে এই মতবিনিময়/ব্রিফিংয়ে ৮ বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশের ৮ উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি), ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার, ইসির ১০ আঞ্চলিক কর্মকর্তা, ৬৪ জেলার নির্বাচন কর্মকর্তাসহ মোট ২২৬ জন কর্মকর্তা অংশ নেন।

আরও পড়ুন

সভায় বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বক্তব্য দেন। কর্মকর্তাদের কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, নির্বাচন বানচালে নানা ধরনের অপকর্ম হতে পারে। তবে কর্মকর্তাদের সবাই একটি ভালো নির্বাচন উপহার দেওয়ার অঙ্গীকার করেন।

১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণা করা হয়। ভোট গ্রহণের তারিখ ১২ ফেব্রুয়ারি। তফসিল ঘোষণার পরদিন ১২ ডিসেম্বর ঢাকায় সম্ভাব্য প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করা হয়। তাঁর মৃত্যুর পর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ হয়। ঘটে বেশি কিছু নাশকতার ঘটনা। এর পর থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা বাড়ে।

গত বছরের আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানের সময় ৫৭৫৩টি অস্ত্র লুট হয়। প্রায় সাড়ে ৪ হাজার অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। এখনো ১ হাজারের বেশি অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। এর বাইরেও সন্ত্রাসীদের হাতে আছে অবৈধ অস্ত্র। এবারের নির্বাচনে অবৈধ অস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কা বড় আকারে সামনে এসেছে।

আরও পড়ুন

কর্মকর্তাদের পরামর্শ

কর্মকর্তারা সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো, চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের জামিন বন্ধ রাখতে বিচার বিভাগের সঙ্গে আলোচনায় বসা যায় কি না, জামিনে থাকা অপরাধীদের গতিবিধি নজরে রাখা, কারাগারে থাকা ব্যক্তিদের অবাধে মুঠোফোন ব্যবহার বন্ধের ব্যবস্থা, কারাবন্দী অপরাধীদের কর্মকাণ্ড নজরে রাখা, সীমান্তে নিরাপত্তা ও নজরদারি বাড়ানো, নতুন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, দায়িত্ব পালনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা, সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিরাপত্তায় জোর দেওয়া, যে নির্বাচনী এলাকায় কর্মরত সেখানে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা হিসেবে কাউকে নিয়োগ না দেওয়া, ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো এবং গণভোটের প্রচারে রাজনৈতিক দলগুলোকে সম্পৃক্ত করা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যা বাড়ানো, প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা, কিছু জায়গায় ভোটকেন্দ্রের সংস্কার, অতিরিক্ত যানবাহনের ব্যবস্থা করা, সময়মতো প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেওয়াসহ নানা পরামর্শ দিয়েছেন মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

আরও পড়ুন

আইনশৃঙ্খলা নিয়ে শঙ্কা

ঢাকা মহানগরে আইনশৃঙ্খলা একটা বড় ইস্যু বলে মন্তব্য করেন ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী। তিনি বলেন, অপরাধীদের জামিনের বিষয় আলোচনায় এসেছে। যদিও এটি বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, নির্বাচন-পূর্ব সময়ে অপরাধীদের জামিনের বিষয়টি একটু নিয়ন্ত্রণ করা গেলে তাঁদের জন্য সহজ হবে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ বাহিনীর অভিযান প্রয়োজন বলেও মত দেন কর্মকর্তাদের কেউ কেউ। এ ছাড়া বেশির ভাগ কর্মকর্তা আশঙ্কা করেন, এবারের নির্বাচনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার ও গুজব বড় বাধা হিসেবে দাঁড়াতে পারে।

খুলনার বিভাগীয় কমিশনার মোখতার আহমেদ বলেন, দৌলতপুরে কালু-কাঁকন বাহিনীর সঙ্গে প্রশাসন পেরে উঠছে না। অস্ত্রের ঝনঝনানি, অবৈধ অস্ত্র, এআই ও গুজব—এগুলো মোকাবিলা করতে হবে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে।

সীমান্তে নজরদারি বাড়ানোর বিষয়টি উঠে আসে কয়েকজন কর্মকর্তার বক্তব্যে। সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী বলেন, সিলেটের তিন দিকে সীমান্ত। অস্ত্র, টাকা ও অপরাধীরা সীমান্ত পার হয়ে আসে। অপরাধ করে তারা আবার পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নেয়। তিনি সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করা, চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা যাতে সহজে জামিন না পায়, সেটা বিবেচনার পরামর্শ দেন।

আরও পড়ুন

অস্ত্র উদ্ধারে সহায়তা পাচ্ছে না পুলিশ

রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার জিল্লুর রহমান বলেন, পুলিশের অনেক অস্ত্র খোয়া গেছে। এসব উদ্ধারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ৪৫৫টি পিস্তল এখনো বাইরে। ভারী অস্ত্রও আছে। এসব উদ্ধারে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। অস্ত্র উদ্ধারে প্রণোদনা ঘোষণার পরামর্শ দেন তিনি।

পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আহসান হাবিব বলেন, তাঁরা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু যথাযথ সহায়তা পাচ্ছেন না। অপরাধীদের ধরতে গেলে নানা তদবির আসে। দিনের বেলায় যাঁরা বক্তৃতা দেন, রাতের বেলা তাঁরা তদবির করেন।

সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরী বলেন, ৫ আগস্টের পর ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) কিছুটা সীমিত আকারে কাজ করছে। এ সংস্থাকে আগের অবস্থায় নেওয়া গেলে তা সহায়ক হবে।

আরও পড়ুন

সম্পূর্ণ সক্ষমতা আছে: আইজিপি

মতবিনিময় সভায় পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, জুলাই আন্দোলন-উত্তর বাংলাদেশে বাস্তব কারণে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘ সময় নানান অসুবিধা ভোগ করছে পুলিশ। নির্বাচনের আগে এই পর্যায়ে পুলিশ যথেষ্ট সক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে। তিনি ইসির কাছে পুলিশের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে অব্যাহত সমর্থন চান।

আইজিপি বলেন, সমাজের বিভিন্ন অংশে ছোটখাটো ইস্যুতে দাবি, রাস্তা অবরোধ এবং মহাসড়ক অবরোধ করে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা দেখা যায়। এগুলো বন্ধ করার সময় এসেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি সব জায়গায় অর্ডার (শৃঙ্খলা) প্রতিষ্ঠিত করতে না পারি, আমাদের পক্ষে নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহায়তা দেওয়া সম্ভব হবে না।’

পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম
ফাইল ছবি
আরও পড়ুন

নিরপেক্ষভাবে কাজ করুন: সিইসি

মতবিনিময়ের শেষ পর্যায়ে সিইসি ও চার নির্বাচন কমিশনার নানা দিকনির্দেশনা দেন। সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দীন কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, কোনো ধরনের পক্ষপাতিত্ব নিয়ে কাজ করবেন না। পেশাদারির সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবে।

সিইসি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মাঠ প্রশাসন ও পুলিশের আশ্বাসে তাঁর বুকের জোর বেড়েছে। তিনি কর্মকর্তাদের ইসির নির্বাচন-সংক্রান্ত সব পরিপত্র, নির্বাচন পরিচালনা বিধিসহ সব আইন-বিধি, নির্দেশনা পড়ার নির্দেশনা দেন।

সম্প্রতি ময়মনসিংহে একজনকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার কথা উল্লেখ করে সিইসি আশঙ্কা করেন, এ ধরনের উসকানিমূলক ঘটনা আরও ঘটতে পারে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিশ্চিত করতে হবে। এটা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে রাখতে হবে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটাররা যেন নিরাপদে ভোট দিয়ে ঘরে ফিরে যেতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে।

সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দীন। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশনে
ছবি: বাসস
আরও পড়ুন

এর আগে সকালে উদ্বোধনী বক্তব্যে সিইসি বলেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে ব্যর্থতা ও নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য সামগ্রিকভাবে ইসিকে দায়ী করা হচ্ছে। সিইসি বলেন, ‘এই অপবাদ থেকে আমরা মুক্তি চাই। এই অপবাদ আমরা ঘোচাতে চাই। প্রমাণ করতে চাই, আমরা সঠিক-সুন্দর নির্বাচন করতে পারি। এটা সম্ভব কেবল আইনের শাসনের মাধ্যমে।’

সভায় নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ, তাহমিদা আহমদ, আনোয়ারুল ইসলাম সরকার ও আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বক্তব্য দেন।

সামনের চ্যালেঞ্জ এবং করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা বাস্তবতার ভিত্তিতেই চ্যালেঞ্জগুলোর কথা বলেছেন। এ বাস্তবতা মেনে সমস্যা সমাধানে ব্যবস্থা নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে।

বদিউল আলম মনে করেন, তফসিল ঘোষণার পর এখন মূল দায়িত্ব ইসির। সবার সহায়তা নেওয়া এবং সংশ্লিষ্ট সবাই দায়িত্ব পালন করছেন কি না, তা নিশ্চিত করা ইসির দায়িত্ব। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর সদাচরণও গুরুত্বপূর্ণ।