বিএনপির বিরুদ্ধে মামলা, সাক্ষী কিছুই জানেন না

প্রতীকী ছবি

বগুড়া শহরে পুলিশের ওপর হামলা ও ‘নাশকতা’র অভিযোগ এনে এক পৌর কাউন্সিলরসহ বিএনপি-ছাত্রদল-যুবদল-স্বেচ্ছাসেবক দলের ৭০ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে গত সোমবার সদর থানায় মামলা হয়েছে। পুলিশের দায়ের করা মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে পুলিশের একজন সহকারী উপপরিদর্শক এবং দুজন পথচারীকে।

মামলার এক দিন পর গতকাল মঙ্গলবার মুঠোফোনে কথা হয় মামলার দ্বিতীয় সাক্ষী জাকির হোসেনের সঙ্গে। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘কোন মামলার সাক্ষী এটা প্রথম শুনলাম। ঘটনা সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। পুলিশের ওপর ককটেল হামলার কোনো ঘটনা আমি দেখিনি।’

বগুড়া শহরের বুজরুকবাড়িয়া পূর্ব পাড়ার বাসিন্দা জাকির হোসেন দাবি করেন, শহরের নদী-বাংলা কমপ্লেক্সে ‘স্বাধীন ফার্মেসী’ নামে তাঁর একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল। অনেক আগেই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছেন। গত রোববার বিকেল পাঁচটার দিকে তিনি তাঁর বন্ধু এবং শহরের উত্তর চেলোপাড়ার বাসিন্দা শুকুয়া চৌহান চা খেতে সোনিয়া সিনেমা হলের গলির দিকে যাচ্ছিলেন। এ সময় তিন-চারজন পুলিশ সদস্য তাঁদের পথ আটকে বলেন, ‘ধরেন, কাগজে স্বাক্ষর করেন।’

কিসের কাগজ জিজ্ঞেস করতেই পুলিশের এক সদস্য বলেন, ‘কোনো কিছু জানার দরকার নাই। স্বাক্ষর না করলে ধরে নিয়ে হাজতে ভরে রাখব। এরপর ভয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস না করে কাগজে স্বাক্ষর করলে পুলিশ ছেড়ে দেয়। এর বাইরে আর কিছুই জানি না। ঘটনাই জানি না, মামলার সাক্ষী কেন হব? আদালতে ডাকলে এফিডিভেট দাখিল করে সাক্ষীর নাম প্রত্যাহার চাইব।’

একই কথা বললেন মামলার ১ নম্বর সাক্ষী শুকুয়া চৌহান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের ওপর হামলার কোনো ঘটনা দেখিনি। বিএনপির কোনো লোককেও পুলিশের ওপর চড়াও হতে দেখিনি। আমি আর জাকির চা খেতে সোনিয়া সিনেমা হলের গলির ভেতরে যাওয়ার পথে পুলিশ পথ আটকে কাগজে শুধু সই নিয়েছে। কিসের কাগজ, সেটা পড়ে দেখিনি। কোন মামলার সাক্ষী করা হয়েছে, সেটাও কেউ বলেননি।’

একই মামলার ৩ নম্বর সাক্ষী সদর থানার সহকারী উপপরিদর্শক রিপন আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই দিন সেখানে সরকারি দায়িত্বে ছিলাম। কী ঘটেছে, সেটা স্যাররা বলতে পারবেন। স্যারদের নির্দেশেই সাক্ষী হয়েছি। পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে। তবে ভিডিও ফুটেজ বা দালিলিক কোনো প্রমাণ আমার কাছে নেই।’

কাউকে হয়রানি করতে কোনো মামলা দায়েরের অভিযোগ ঠিক নয় বলে জানিয়েছেন বগুড়ার পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী।

আরও পড়ুন

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বগুড়ায় ‘নাশকতা’র অভিযোগ এনে চার দিনে ছয় থানায় বিএনপি-ছাত্রদল-যুবদল-স্বেচ্ছাসেবক দল, কৃষক দলের ৩৫৫ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা দায়ের হয়েছে। অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে বহু নেতা–কর্মীকে। এসব মামলার সাক্ষীদের সিংহভাগই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। দলীয় নেতা–কর্মীর বাইরে যে দু-একজন আছেন তাঁরা বলছেন, ঘটনা সম্পর্কে তাঁরা কিছুই জানেন না। প্রায় একই চিত্র দেখা গেল রাজশাহী, নাটোর, পাবনা, নওগাঁ, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জেও। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে উত্তরের এসব জেলায় ১৬টি মামলা হয়েছে। অর্থাৎ সাত জেলায় মোট মামলা হয়েছে ২২টি। ‘নাশকতা’র অভিযোগ এনে বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দায়ের করা বেশির ভাগ মামলার বাদীই পুলিশ। এসব মামলায় বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের ৮৩৩ নেতা–কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। আর অজ্ঞাত আসামি কয়েক হাজার। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ৩২ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

আরও পড়ুন

বিএনপি বলছে, আগামী ৩ ডিসেম্বর রাজশাহী বিভাগীয় গণসমাবেশ ঠেকাতেই পুলিশ বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ‘গায়েবি’ মামলা করছে। মামলাগুলোর এজাহারে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, সে ধরনের ঘটনা কোথাও ঘটেনি।

রাজশাহী জেলায় বিএনপির নেতা–কর্মীদের নামে ১৫ নভেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ছয়টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে চারটি মামলার সাক্ষীদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়েছে। সাক্ষীরা সবাই ঘটনার সময় বিস্ফোরণের আওয়াজ পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। কিন্তু পুলিশ ছাড়া অন্য কোনো মানুষকে ঘটনাস্থলে দেখেননি। শুধু একজন সাক্ষী ‘ধর ধর, পালাল পালাল’ বলতে শুনেছেন।

জেলার মোহনপুর থানায় ১৫ নভেম্বর রাতে প্রথম মামলাটি হয়। এ মামলায় সাত আসামির নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ১৫০ থেকে ১৬০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এজাহারে বলা হয়েছে, রাত সোয়া ১০টার দিকে থানার বসন্তকেদার কলেজ মাঠে ১৫০ থেকে ১৬০ জন নেতা–কর্মী নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অস্থিশীলতা সৃষ্টি করার উদ্দেশে গোপন বৈঠক করছিলেন। গোপন সংবাদ পেয়ে মোহনপুর থানার পুলিশ সেখানে অভিযান চালালে তাঁরা ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পালিয়ে যান। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ টেপ দিয়ে মোড়ানো চারটি অবিস্ফোরিত ককটেল, একটা ছুরি, একটি প্লাস্টিকের মাদুর, ২৫টি ভাঙা ইটের টুকরো ও ১০টি বাঁশের লাঠি জব্দ করে। এ ঘটনায় ওই দিন রাতেই বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫ (৩) ও ২৫-ডি ও বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৪ ধারায় একজন উপপরিদর্শক বাদী হয়ে মামলা করেছেন।

আরও পড়ুন

এ মামলার ১ নম্বর সাক্ষী উপজেলার মৌগাছি ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সোহেল রানা (৩৬)। তিনি বলেন, ঘটনার দিন সেখানে আওয়াজ শুনেছেন। তারপর পুলিশ ডেকে নিয়ে যায়। পুলিশ কয়েকটা ককটেল দেখায়। পুলিশ বলেছে, সন্ত্রাসীরা এগুলো ফেলে গেছে। সেখানে পুলিশ ছাড়া তিনি অন্য কোনো মানুষ দেখেনি।

নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড বিএনপি নেতা–কর্মীরা করেছেন মামলার সাক্ষীরা কেউ তা বলতে পারছেন না। তাহলে কিসের ভিত্তিতে বিএনপির নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হচ্ছে—জানতে চাইলে রাজশাহীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইফতে খায়ের আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের গোয়েন্দা তথ্য বলছে, যাঁদের নামে মামলা করা হয়েছে, তাঁরাই পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তোলার জন্য এই নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। নিজেদের আড়াল করার জন্য তাঁরা এমনভাবে ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছেন, সাধারণ মানুষের চোখে পড়ছে না।’

আরও পড়ুন

পুলিশের এমন অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন আগামী ৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় রাজশাহী বিভাগীয় গণসমাবেশের সমন্বয়কারী ও বিএনপির রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ সরকার টিকিয়ে রেখেছে পুলিশ। এ জন্য বিএনপির গণসমাবেশ সফল হবে কি না, তা নিয়ে পুলিশেরই মাথাব্যথা বেশি। তাই পুলিশ এভাবে বিএনপি নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা সাজাচ্ছে।

আরও পড়ুন