ইসলামে শহীদ কী, মর্যাদা কেমন

ফিলিস্তিনের গাজায় শহীদদের কবরস্থানে এক শিশুছবি: এএফপি

ইসলামি জীবনদর্শনে শাহাদাত হলো ইবাদতের চূড়ান্ত শিখর। এটি এমন এক গৌরবময় মৃত্যু, যা একজন মুমিনকে জান্নাতের সর্বোচ্চ সোপানে পৌঁছে দেয়। এই গৌরব কেবল আল্লাহর প্রিয় বান্দারাই লাভ করেন। কোরআন ও সুন্নাহে শহীদের অনেক ফজিলত ও মর্যাদার কথা বর্ণিত হয়েছে।

তবে এই মর্যাদা লাভের প্রধান শর্ত হলো ইমান এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিশুদ্ধ নিয়ত। কোনো পার্থিব খ্যাতি বা বীরত্ব প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে প্রাণ দিলে তা শাহাদাত হিসেবে গণ্য হবে না।

আরবি ভাষার অভিধান লিসানুল আরব-এর বর্ণনা অনুযায়ী, ‘শহীদ’ শব্দের মূল অর্থ হলো উপস্থিত থাকা, সাক্ষী হওয়া বা অবগত থাকা। আল্লাহ তাআলার অন্যতম গুণবাচক নাম ‘আশ-শহীদ’, যার অর্থ এমন এক সত্তা, যাঁর জ্ঞান থেকে কোনো কিছুই গোপন নয়।

শরিয়তের পরিভাষায় সেই ব্যক্তিই শহীদ, যিনি কাফেরদের বিরুদ্ধে ন্যায়সংগত যুদ্ধে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বিশুদ্ধ নিয়তে প্রাণ বিসর্জন দেন। এখানে শাব্দিক ও শারঈ অর্থের যোগসূত্র এই যে শহীদ ব্যক্তি নিজের জীবন ও উপস্থিতির মাধ্যমে সত্যের সাক্ষ্য দিয়ে যান।

এই ধরনের মৃতকে শহীদ বলার কারণ উল্লেখ করে ইবনে হাজার আসকালানি (রাহ.) ফাতহুল বারী গ্রন্থে লিখেছেন, তাঁর রুহ বা আত্মা সব সময় জান্নাতে উপস্থিত থাকে। আল্লাহ ও ফেরেশতারা তাঁর জান্নাতি হওয়ার সাক্ষ্য দেন। মৃত্যুর সময় তিনি নিজের উচ্চ মর্যাদা ও সম্মান স্বচক্ষে অবলোকন করেন। কিয়ামতের দিন তিনি পূর্ববর্তী নবীদের রিসালাত প্রচারের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়াবেন।

শহীদের প্রকারভেদ

ইসলামি ফিকহশাস্ত্র অনুযায়ী শহীদ প্রধানত তিনটি শ্রেণির:

তারা তাদের প্রতিপালকের কাছে জীবিত এবং রিজিকপ্রাপ্ত।
কোরআন, সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৬৯

১. দুনিয়া ও আখেরাতের শহীদ: যিনি কেবল আল্লাহর দীন ইসলামকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে রণক্ষেত্রে শহীদ হন. অথবা রণক্ষেত্রে আহত হয়ে পরে সেই একই আঘাতে মারা যান। তাঁর জন্য বিধান হলো, বিনা গোসলে জানাজা ও রক্তভেজা কাপড়সহ দাফন করা।

২. দুনিয়ার শহীদ: যিনি বাহ্যত রণাঙ্গনেই মারা গেছেন সত্য, কিন্তু তাঁর অন্তরে লোক–দেখানো স্বার্থ ছিল, অর্থাৎ তিনি আল্লাহর জন্য যুদ্ধ করেন নি, বরং লোকে তাকে বীর বলবে কিংবা গনিমত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) অর্জন করতে পারবেন, এই কারণে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। পার্থিব বিচারে তিনি শহীদ হলেও আখেরাতে কোনো সওয়াব পাবেন না।

৩. আখেরাতের শহীদ: এঁরা সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যাননি, কিন্তু বিভিন্ন দুর্ঘটনায় বা কঠিন রোগে (যেমন পানিতে ডুবে, মহামারি, পেটের রোগ বা প্রসববেদনায়) মারা গেছেন। রাসুল (সা.)-এর ভাষ্যমতে, এঁরা আখেরাতে শহীদের সওয়াব পাবেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,৯১৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৩১১১)

আরও পড়ুন

কোরআনে শহীদের মর্যাদা

পবিত্র কোরআনে ইসলামে শহীদের জীবন এবং তাঁদের সুউচ্চ মর্যাদার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তাদের মৃত বলো না। বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা তা বোঝো না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৪)

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণ বলেন, ‘বাহ্যিকভাবে আমরা দেখি শহীদের দেহ নিথর হয়ে গেছে, কিন্তু রুহের জগতে তাঁরা সাধারণ মৃতদের চেয়ে ভিন্নতর এক সজীবতা লাভ করেন।

শহীদদের জীবন কেবল একটি রূপক বিষয় নয়। তাঁদের রুহ বা আত্মা জান্নাতের নিয়ামত উপভোগ করে। তবে এই জীবনের প্রকৃতি আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, যা আল্লাহ আয়াতে পরিষ্কার করে দিয়েছেন, ‘কিন্তু তোমরা তা বোঝো না।’

অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তারা তাদের প্রতিপালকের কাছে জীবিত এবং রিজিকপ্রাপ্ত।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৬৯)

শহীদরা কেবল জীবিতই নন, বরং তাঁরা আল্লাহর পক্ষ থেকে রিজিক লাভ করেন। এই রিজিকের স্বরূপ সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, শহীদদের রুহগুলো সবুজ রঙের পাখির পেটের ভেতরে থাকে। এই পাখিগুলো জান্নাতের যেখানে ইচ্ছা ঘুরে বেড়ায় এবং জান্নাতের ফলমূল ও নহর থেকে রিজিক বা খাবার গ্রহণ করে। এরপর তাঁরা আরশের নিচে ঝুলন্ত প্রদীপসমূহে বিশ্রাম নেয়।

আর ‘রিজিক’ শব্দ দিয়ে কেবল খাবার নয়, বরং জান্নাতের অনাবিল শান্তি, নিরাপত্তা এবং মহান আল্লাহর নৈকট্যকেও বোঝানো হয়েছে।

শহীদের মর্যাদা এত বেশি হওয়া সত্ত্বেও অন্যের পাওনা বা ‘ঋণ’ একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়। আল্লাহর হক মাফ হলেও মানুষের হক পরিশোধ না করা পর্যন্ত শহীদের আত্মা আটকে থাকে।

হাদিসে শহীদের মর্যাদা

শহীদের জন্য সাতটি বিশেষ পুরস্কার:

  • ১. রক্তের প্রথম ফোঁটা ঝরতেই ঋণ ব্যতীত সব গুনাহ মাফ করা হয়। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,৮৮৬)

  • ২. জান্নাতে তাঁর সুউচ্চ আসন তাঁকে সরাসরি দেখানো হয়।

  • ৩. তাঁকে ইমানি পোশাকে সজ্জিত করা হয়।

  • ৪. ৭২ জন হুরের সঙ্গে তাঁর বিবাহ সম্পন্ন হয়।

  • ৫. কবরের আজাব থেকে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।

  • ৬. কেয়ামতের দিনের ‘মহাভীতি’ থেকে তাঁকে নিরাপদ রাখা হয়।

  • ৭. তাঁর মাথায় সম্মানের মুকুট পরানো হয়, যার একটি ইয়াকুত পাথর গোটা দুনিয়ার চেয়ে মূল্যবান।

এ ছাড়া তিনি তাঁর পরিবারের ৭০ জন সদস্যের জন্য শাফায়াত করতে পারবেন। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১,৬৬৩; ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২,৭৯৯)

হজরত আনাস বিন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘জান্নাতে প্রবেশের পর কেউ দুনিয়ায় ফিরে আসতে চাইবে না, একমাত্র শহীদ ছাড়া। সে শাহাদাতের মর্যাদা দেখে এই আকাঙ্ক্ষা করবে, সে যেন দুনিয়ায় ফিরে গিয়ে আরও ১০ বার শহীদ হতে পারে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২,৮১৭; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,৮৭৭)

শহীদের মর্যাদা এত বেশি যে তিনি বারবার দুনিয়াতে ফিরে এসে আল্লাহর পথে শহীদ হওয়ার তামান্না করবেন।

শহীদেরা হাশরের ময়দানে কোনো হিসাব-নিকাশ ছাড়াই জান্নাতে প্রবেশ করবেন। তাঁদের আমলনামা পরীক্ষা করার প্রয়োজন পড়বে না। শহীদেরা কবরের সওয়াল-জওয়াব থেকেও মুক্তি পাবেন।

এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, মুমিনদের কবরে পরীক্ষা (সওয়াল-জওয়াব) করা হয়, কিন্তু শহীদদের কেন করা হয় না?’ তিনি বললেন, ‘তার মাথার ওপর তলোয়ারের ঝনঝনানিই। (পরীক্ষা হিসেবে) যথেষ্ট ছিল।’ (সুনানে নাসায়ি: ২০৯৩; মিশকাতুল মাসাবিহ: ৩৮৩৩)

শহীদ যখন নিহত হন, তখন ফেরেশতারা তাঁদের ডানা দিয়ে তাঁকে ছায়া দান করেন এবং সসম্মানে তাঁর রুহ নিয়ে আসমানে গমন করেন। হজরত জাবির (রা.) বর্ণনা করেন, ওহুদ যুদ্ধের দিন যখন তার পিতার (আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন হারাম) লাশ নিয়ে আসা হলো, তখন রাসুল (সা.) বললেন, ‘তোমরা তার ওপর ক্রন্দন করো আর না-ই করো, তোমরা তাকে তুলে নেওয়া পর্যন্ত ফেরেশতারা নিরবচ্ছিন্নভাবে তাদের ডানা দিয়ে তাকে ছায়া দিচ্ছিল।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২,৮১৬; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৪৭১)

আরও পড়ুন

আল্লাহর পথে জীবন দিলে সব গুনাহ মাফ হয়, কিন্তু মানুষের পাওনা বা ঋণ মাফ হয় না। নবীজি বলেছেন, ‘আল্লাহর পথে শাহাদাতবরণকারীর প্রতিটি গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়, তবে ঋণ ব্যতীত।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,৮৮৫)

শহীদের মর্যাদা এত বেশি হওয়া সত্ত্বেও অন্যের পাওনা বা ‘ঋণ’ একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়। আল্লাহর হক মাফ হলেও মানুষের হক পরিশোধ না করা পর্যন্ত শহীদের আত্মা আটকে থাকে।

আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মুমিনের আত্মা তার ঋণের কারণে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে (জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে না), যতক্ষণ না তার পক্ষ থেকে তা পরিশোধ করা হয়।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১,০৭৮; ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২,৪১৩)

শহীদের দাফন-কাফন

শহীদের ক্ষেত্রে বিধান হলো, তাঁদের শাহাদাতস্থলেই দাফন করা। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘নিহতদের তাদের শাহাদাতস্থলেই দাফন করো।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ৩,১৩১; তিরমিজি, হাদিস: ১,৭১৭)

ওহুদের যুদ্ধের সময় অনেক সাহাবিকে মদিনায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হলে রাসুল (সা.) তাঁদের ফিরিয়ে এনে রণক্ষেত্রেই দাফন করার আদেশ দেন। আলেমদের মতে, এটি একটি মোস্তাহাব বা উত্তম আমল। এতে শাহাদাতের স্মৃতিবিজড়িত স্থানের মর্যাদা রক্ষা পায়।

আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তাদের মৃত বলো না। বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা তা বোঝো না।
কোরআন, সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৪

নিয়তের গুরুত্ব ও শাহাদাত লাভের উপায়

নিয়তের গুরুত্ব নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, ‘আমরা কীভাবে শহীদ হব?’ রণাঙ্গনে গিয়ে সরাসরি যুদ্ধ করার সুযোগ হয়তো সবার জীবনে আসে না। কিন্তু ইসলামের সৌন্দর্য হলো, আল্লাহ তাআলা বান্দার আমলের চেয়ে নিয়তের একাগ্রতাকে বেশি গুরুত্ব দেন।

নবীজি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সত্য হৃদয়ে আল্লাহর কাছে শাহাদাত প্রার্থনা করে, আল্লাহ তাকে শহীদের মর্যাদায় পৌঁছে দেবেন, যদিও সে নিজের বিছানায় স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,৯০৯)

অর্থাৎ শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষা যদি অন্তরে জাগ্রত থাকে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জীবন উৎসর্গ করার মানসিক প্রস্তুতি থাকে, তবে মহান রব তাঁর দয়ায় সেই বান্দাকে শহীদের খাতায় নাম লিখিয়ে দেন।

মোটকথা, শাহাদাত শুধু তির-তরবারির যুদ্ধ নয়; নিজের নফস বা প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়েরও চূড়ান্ত পরিণতি। সত্যের পথে অবিচল থাকা এবং ইসলামের জন্য সর্বদা নিবেদিত থাকাই হলো শাহাদাতের প্রকৃত প্রস্তুতি।

তবে এই মর্যাদালাভের প্রধান শর্ত হলো ইমান, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিশুদ্ধ নিয়ত এবং ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী বৈধ কোনো উদ্দেশ্যে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া। পাপাচার বা অবাধ্যতায় লিপ্ত অবস্থায় মৃত্যু হলে এই মর্যাদা লাভ সম্ভব নয়।

ইলিয়াস মশহুদ : লেখক ও অনুবাদক

আরও পড়ুন