সাইমন্ডস নেই, বিশ্বাসই হচ্ছে না সিডন্সের

এ শহরের দলের হয়ে আইপিএল খেলেছিলেন অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস। আকস্মিক মৃত্যুর পর মুম্বাইয়ে এক দেয়ালে তাঁর চিত্রকর্ম এঁকে ভালোবাসা প্রকাশ করলেন ভক্তরা।এএফপি

খবরটা প্রথম শুনে যেমন বিশ্বাস হয়নি, ১২ ঘণ্টা পরও একই রকম অবিশ্বাসে আচ্ছন্ন পেলাম জেমি সিডন্সকে।
সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে দুঃসংবাদটা পেয়েছেন বাংলাদেশ দলের ম্যানেজার নাফিস ইকবালের মাধ্যমে। পরে নেটে গিয়ে নিশ্চিত হয়েছেন, আগের রাতে কুইন্সল্যান্ডে গাড়ি দুর্ঘটনায় মাত্র ৪৬ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন সাবেক অস্ট্রেলিয়ান অলরাউন্ডার অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস। তারপরও বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল থেকে যেন বেরোতেই পারছেন না সিডন্স।

চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথম দিনের খেলা শেষে কাল সন্ধ্যায় র‍্যাডিসন ব্লু হোটেলের জিমে যখন কথা বলতে গেলাম, বাংলাদেশের ব্যাটিং কোচকে তখনো হকচকিত দেখাচ্ছে। শোকাতুর তো বটেই।

গতকাল সন্ধ্যায় র‍্যাডিসন ব্লু হোটেলের জিমে সিডন্স
প্রথম আলো

ট্রেডমিলে দৌড় শেষ করে স্ট্রেচিং করছিলেন। অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসকে নিয়ে কথা বলতে চাই—হাবিবুল বাশারের মাধ্যমে বার্তাটা আগেই দিয়ে রেখেছিলাম। পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই সিডন্স যেন অনুনয় করলেন, ‘এ নিয়ে আমি কথা বলতে চাই না। আমি তো এখনো বিশ্বাসই করতে পারছি না। গত বছর ডিন জোন্স, কিছুদিন আগে রডনি মার্শ, শেন ওয়ার্ন, এখন অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস—অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে এ কী মৃত্যুর মিছিল শুরু হলো! আমি আর নিতে পারছি না।’

আরও পড়ুন

পূর্বপরিচিত সাংবাদিকের অনুরোধ এড়াতে পারছেন না, আবার এ নিয়ে কথা বলতেও ইচ্ছা করছে না। এই উভয়সংকট থেকে জেমি সিডন্সকে উদ্ধার করতে বললাম, ‘ঠিক আছে, আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার দিতে হবে না। চলুন, মিনিট দশেক কোথাও বসে অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসের স্মৃতিচারণা করা যাক। আমারও তো কিছু স্মৃতি আছে। সেসবও না হয় বলব। মনটা হালকা হবে।’
সিডন্স রাজি হলেন। সুইমিংপুলের পাশে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন, ‘ডিন জোন্স আর শেন ওয়ার্নের মৃত্যুই আমি এখনো মেনে নিতে পারি না। সাইমন্ডসের খবরটা পাওয়ার পর থেকে আমার অনুভূতিগুলো অসাড় হয়ে গেছে। ওরা সবাই আমার খুব কাছের মানুষ ছিল। এটা কোনো কথা হলো...কারোরই তো তেমন কোনো বয়স হয়নি!’

সাইমন্ডসের উন্মাতাল ব্যাটিংয়ের সাক্ষী অনেকবারই হয়েছেন সিডন্স
রয়টার্স

অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রতিপক্ষ হিসেবে পেয়েছেন সাইমন্ডসকে। স্লিপে দাঁড়িয়ে সাইমন্ডসের উন্মাতাল ব্যাটিংয়ের সাক্ষী হয়েছেন অনেকবারই। পরে অস্ট্রেলিয়া দলের সহকারী কোচ হিসেবে খেলোয়াড় হিসেবে পেয়েছেন সাইমন্ডসকে। ২০০৬ সালে মেলবোর্নে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সাইমন্ডসের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি দেখেছেন ড্রেসিংরুমে বসে, ‘কী দুর্দান্ত এক ইনিংসই (১৫৬) না খেলেছিল ও! মনে আছে ছক্কা মেরে সেঞ্চুরি করেছিল। ওর টেস্ট ক্যারিয়ারটা দীর্ঘ হয়নি, তবে সাদা বলে ও ছিল সত্যিকার এক ম্যাচ উইনার। আমার তো মনে হয়, ক্রিকেট ইতিহাসে হার্ড হিটারদের ছোট্ট তালিকায়ও সাইমন্ডস থাকবে।’

আশ্চর্য এক মানুষ ছিল সিম্মো। মাঠের বাইরে এমন রিল্যাক্সড থাকত, মনে হতো, জীবন-ক্রিকেট কোনোটাই ওর কাছে সিরিয়াস বিষয় নয়। ইয়ার্কি-দুষ্টুমিতে চারপাশ মাতিয়ে রাখত। প্রতিটি দলই ওর মতো একজন-দুজন খেলোয়াড় পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করে।
জেমি সিডন্স

হার্ড হিটিং ব্যাটিংয়ের স্মৃতিচারণা করলেন, মনে করিয়ে দিলেন পেস-স্পিন দুই ধরনের বোলিং করতে পারার বিরল ক্ষমতার কথাও, তবে সাইমন্ডসের ক্রিকেট নিয়ে আলোচনায় ঘুরেফিরে বারবার এল ফিল্ডিং, যা বলার সময় সিডন্সের চোখেমুখে মুগ্ধতা, ‘ওর মতো ফিল্ডার আমি আর দেখিনি। অলরাউন্ড ফিল্ডার হিসেবে যদি ও অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের সেরা না-ও হয়, অবশ্যই সেরাদের একজন।’
সাইমন্ডসের অকালমৃত্যুর পর তাঁর ক্রিকেট নিয়ে যত আলোচনা হচ্ছে, তার চেয়েও বেশি হচ্ছে মানুষ সাইমন্ডসকে নিয়ে। জেমি সিডন্সও এত কাতর হয়ে পড়েছেন এ কারণেই, ‘আশ্চর্য এক মানুষ ছিল সিম্মো। মাঠের বাইরে এমন রিল্যাক্সড থাকত, মনে হতো, জীবন-ক্রিকেট কোনোটাই ওর কাছে সিরিয়াস বিষয় নয়। ইয়ার্কি-দুষ্টুমিতে চারপাশ মাতিয়ে রাখত। প্রতিটি দলই ওর মতো একজন-দুজন খেলোয়াড় পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করে।’

পেস-স্পিন দুই ধরনের বোলিং করতে পারতেন সাইমন্ডস
এএফপি


আমার কিছু স্মৃতিও বলব বলে কথা দিয়েছিলাম। সাইমন্ডসের কথা উঠলে সব ছাপিয়ে প্রথম যা মনে হয়, সেটাই বললাম সিডন্সকে। ২০০৫ সালে কার্ডিফে ন্যাটওয়েস্ট ট্রফির অমর সেই ম্যাচ, বাংলাদেশ যাতে সে সময়ের অপরাজেয় অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দিয়েছিল। সারা রাত নাইট ক্লাবে কাটিয়ে সেই ম্যাচের দিন সকালে হোটেলে ফিরেছিলেন সাইমন্ডস। সকালে ওয়ার্মআপের সময়ও তাঁর মুখ থেকে অ্যালকোহলের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। শাস্তি হিসেবে সাইমন্ডসকে বাদ দেওয়া হয় সেই ম্যাচ থেকে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পরের ম্যাচে দলে ফিরেই ৭৩ রান আর ১ উইকেটে ম্যাচসেরা। পরের ম্যাচে প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ, ম্যানচেস্টারে ১৮ রানে ৫ উইকেট নিয়ে আবারও ম্যাচসেরা। শুনতে শুনতে সিডন্সের মুখে এই প্রথম মৃদু হাসি, ‘সেদিন কিন্তু ও মিডিয়াম পেস বোলিং করেছিল। আহা, সিম্মো!’
বলার পরই একটু আনমনা হয়ে যান সিডন্স। সুদূরে দৃষ্টি মেলে দিয়ে যেন ভুলেই যান আমার উপস্থিতি।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন