এশিয়া কাপ ফাইনালের পর কী ঘটেছে, কেন ঘটেছে
ম্যাচের শেষটা ছিল রোমাঞ্চকর। পাকিস্তানের ১৪৬ রান তাড়ায় ভারতের শেষ ওভারে দরকার ছিল ৮ রান। হারিস রউফের দ্বিতীয় বলে তিলক বর্মার ছক্কা আর চতুর্থ বলে রিংকু সিংয়ের চারে ভারত সেই লক্ষ্যে পৌঁছে যায় ২ বল হাতে রেখে। এবারের আসরে পাকিস্তানের বিপক্ষে টানা তৃতীয় জয়ে ভারত পেয়েছে এশিয়া কাপে নবম শিরোপার দেখা।
কিন্তু নিখাদ ক্রিকেটীয় লড়াইয়ের এই রোমাঞ্চটাই মিলিয়ে যায় কিছুক্ষণ পর। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দুবাইয়ে পৌঁছে ভারতীয় দলের প্রতিটি দিন কেটেছে যে মুহূর্তটার জন্য, আরও স্পষ্ট করে বললে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ট্রফি উঁচিয়ে ধরার যে লক্ষ্য, সেটিই আর পূরণ হয়নি এ রাতে। ভারত জিতেছে ঠিকই, পুরস্কার বিতরণী মঞ্চও তৈরি করা হয়েছিল একটি—কিন্তু সূর্যকুমার যাদবদের হাতে ট্রফি ওঠেনি। রিংকু সিংয়ের ওই জয়সূচক চারের পরের পরের দেড় ঘণ্টায় দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম পরিণত হয় নাটকের মঞ্চে।
সাধারণত, কোনো টুর্নামেন্টের ফাইনাল শেষ হতে না হতেই পুরস্কার বিতরণী মঞ্চ তৈরির কাজ শুরু হয়ে যায়। ১০–২০ মিনিটের মধ্যে শুরু হয়ে যায় অনুষ্ঠানও। কিন্তু দুবাইয়ে তখনই গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে, ভারতীয় দল আদৌ ট্রফি অনুষ্ঠানে অংশ নেবে কি না। গুঞ্জনের কারণ টুর্নামেন্টজুড়ে পাকিস্তান বিষয়ে ভারতের নেতিবাচক অবস্থান।
১৪ সেপ্টেম্বর দুই দলের প্রথম ম্যাচের টসের সময় পাকিস্তান অধিনায়কের সঙ্গে হাত মেলাননি ভারত অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদব। আর ম্যাচ শেষ হওয়ার পর ভারতের ক্রিকেটাররা ড্রেসিংরুমের দরজাই বন্ধ করে দেন।
পরে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে সূর্যকুমার জানান, ভারত সরকার ও বিসিসিআইয়ের অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এমন আচরণ তাঁর দলের। এমনকি গত মে মাসে পাকিস্তানে চালানো ভারতের সামরিক অভিযানের প্রসঙ্গও টানেন সূর্যকুমার। সেই থেকে টুর্নামেন্টজুড়ে ভারত–পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের বৈরী সম্পর্কের ছাপ ছিল দুই দলের মাঠের খেলায়ও।
নিয়মানুযায়ী, এশিয়া কাপের ট্রফি বিজয়ীদের হাতে তুলে দেন সংস্থাটির সভাপতি। বর্তমানে এর সভাপতি পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) প্রধান মহসিন নাকভি, যিনি আবার পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। খেলা শেষে তিনি সময়মতোই মাঠে নামেন। কিন্তু পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শুরু তখনো বাকি। এ সময় ভারতের ক্রিকেটারদেরকে মাঠে উদ্দেশ্যহীনভাবে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। কেউ বসেছিলেন ঘাসের ওপর, কেউবা ছোট ছোট দলে জটলা হয়ে। পাকিস্তান দল তখন মাঠেই নেই। পুরো দল খেলা শেষে ড্রেসিংরুমে যাওয়ার পর আর বের হয়নি।
অস্বাভাবিক ওই পরিস্থিতির মধ্যে চলছিল আলোচনা। ভারত জানিয়ে দেয়, তারা নাকভির হাত থেকে ট্রফি নেবে না। সেই সময়ে ভারতীয় খেলোয়াড়দের বোঝানোর চেষ্টা করেন এসিসি কর্মকর্তারা। ম্যাচ রেফারি রিচি রিচার্ডসন, মাঠের দুই আম্পায়ার আহমাদ শাহ পাকতিন ও মাসুদুর রহমানকেও কথা বলতে দেখা যায়।
একপর্যায়ে ভারত জানায়, মাঠে থাকা এমিরেটস ক্রিকেট বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান খালিদ আল জারুনির হাত থেকে ট্রফি নিতে চায় তাঁরা। তখন বেঁকে বসেন নাকভি। এসিসি সভাপতি হিসেবে তিনিই পুরস্কার তুলে দেবেন, নয়তো দেওয়া হবে না। এমন অচলাবস্থার মধ্যেই ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে আসে পাকিস্তান দল। শুরু হয় পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে।
পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে মঞ্চে নাকভির সঙ্গে ওঠেন খালিদ আল জারুনি এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি আমিনুল ইসলাম। ছিলেন পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা। উপস্থাপক সাইমন ডুল এক এক করে ব্যক্তিগত পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম ধরে ডাকেন।
শিবম দুবে (গেমচেঞ্জার অব দ্য ম্যাচ), কুলদীপ যাদব (ভ্যালু প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচ), তিলক বর্মা (সুপার সিক্সেস অব দ্য ম্যাচ ও ম্যান অব দ্য ম্যাচ) ও অভিষেক শর্মারা (প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্ট) মঞ্চে উঠে শুধু ক্রেস্টদাতার সঙ্গে হাত মিলিয়েই নেমে আসেন।
রানার্সআপ দল হিসেবে পাকিস্তানের খেলোয়াড়দের হাতে পদক তুলে দেন আমিনুল। এই পুরস্কার ও পদক বিতরণের সময় নাকভি মঞ্চে দাঁড়িয়েছিলেন। পাকিস্তান অধিনায়ক সালমান আগার হাতে আমিনুল চেক তুলে দেওয়ার সময় তিনি হাত লাগান।
টুর্নামেন্টসেরার পুরস্কার দিয়ে অভিষেকের সঙ্গে কথা শেষ করেই উপস্থাপক সাইমন ডুল বলেন, ‘আমাকে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল থেকে জানানো হয়েছে ভারত আজ ট্রফি গ্রহণ করবে না। সুতরাং, এখানেই এই অনুষ্ঠানের সমাপ্তি। এরপর নাকভিসহ অন্যান্য অতিথিরা মঞ্চ থেকে নেমে যান। মঞ্চের এক পাশে থাকা এশিয়া কাপ ট্রফি একজন এসে হাতে তুলে ভেতরের দিকে চলে যান।’
ভারতের খেলোয়াড়েরা তখনো মাঠে দাঁড়িয়ে। এরই মধ্যে দুই মাঠকর্মী দুই দফায় চ্যাম্পিয়ন লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে মাঠে আসেন। দুবারই তা ফেরত নিয়ে যান। ভারতীয় দলকে দেওয়া হয়নি। এ সময় ভারতের ক্রিকেটারদের মধ্যে প্রথম হার্দিক পান্ডিয়া পোডিয়ামে গিয়ে একটি সেলফি নেন। এরপর এক এক করে অন্য খেলোয়াড় এবং কোচিং স্টাফের সদস্যরাও সেখানে যান। সূর্যকুমার যাদব হাতে ট্রফি নিয়ে আসছেন ভান করে পোডিয়ামের দিকে যান, এরপর ট্রফি উদ্যাপনের ভঙ্গি করে পুরো দল। ঠিক ট্রফি হাতে থাকলে যেমনটা হয়, সেভাবেই।
মাঠের এই অনুষ্ঠানের পর আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে মিডিয়া ম্যানেজারকে নিয়ে হাজির হন সূর্যকুমার। ট্রফিবিহীন উদ্যাপন নিয়ে তিনি বলেন, চ্যাম্পিয়ন দল ট্রফি পায়নি এমনটা আমি কখনোই দেখিনি।
সংবাদ সম্মেলনে এক পাকিস্তানি সাংবাদিক সূর্যকুমারকে বলেন, এই টুর্নামেন্টে খেলাধুলার রাজনীতিকরণ শুরু হয়েছে আপনার হাত না মেলানোর মধ্যে দিয়ে। আজ ট্রফি নিতেও অস্বীকৃতি জানালেন। আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে খেলাধুলার সঙ্গে রাজনীতি মেশানো প্রথম অধিনায়ক আপনি—এমনটা বলার পর ভারতের মিডিয়া ম্যানেজার সূর্যকুমারকে উত্তর না দিতে পরামর্শ দিলে তিনি কিছু বলা এড়িয়ে যান। আরেকজন এরই মধ্যে নরেন্দ্র মোদির অপারেশন সিঁদুরের সঙ্গে তুলনা টানা টুইট নিয়ে জানতে চাইলে ভারত অধিনায়ক বলেন ম্যাচের পর তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢোকেননি।
দুবাইয়ের এ সব ঘটনার মধ্যেই বার্তা সংস্থা এএনআইয়ের সঙ্গে কথা বলেন বিসিসিআইয়ের সচিব দেবজিত সাইকিয়া। নাকভির হাত থেকে ট্রফি নিতে না চাওয়ার কারণ ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘আমরা সেই ব্যক্তির কাছ থেকে ট্রফি নিতে পারি না, যিনি এমন একটি দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেন, যে দেশ আমাদের দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছে। তাই আমরা ট্রফি নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছি।’ তিনি ভারতীয় দলকে ট্রফি বুঝিয়ে না দেওয়ার ঘটনায় আইসিসির কাছে নালিশ করবেন বলেও জানান।
সচিব দেবজিত সাইকিয়া দাবি করেন, মহসিন নাকভি ভারতের ট্রফি এবং খেলোয়াড়দের পদক হোটেলে নিয়ে গেছেন। সেগুলো যত দ্রুত সম্ভব তাদের ফিরিয়ে দিতে বলেন তিনি। ও দিকে নাকভি তখন ভারতের প্রধামন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির টুইটের জবাব দিতে ব্যস্ত।
ভারত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার একটু পরেই মোদি টুইট করেছিলেন, ‘খেলার মাঠেও অপরাশেন সিঁদুর। ফলাফল একই—ভারতের জয়।’ নাকভি সেটা রিটুইট করে লিখেন, ‘যদি যুদ্ধই তোমার গর্বের মাপকাঠি হয়, তবে ইতিহাস এরই মধ্যে পাকিস্তানের হাতে তোমার লজ্জাজনক পরাজয়ের কথা লিখে রেখেছে। কোনো ক্রিকেট ম্যাচ সেই সত্যকে বদলাতে পারবে না। খেলায় যুদ্ধ টেনে আনা শুধু হতাশাকে প্রকাশ করে আর খেলার মূল চেতনাকেই কলঙ্কিত করে।’
* তথ্য সূত্র: আল–জাজিরা, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, টাইমস অব ইন্ডিয়া ও গালফ নিউজ।