আফ্রিদি, ফরেস্ট গাম্প কিংবা এক চাটনিওয়ালার গল্প: ভারত-পাকিস্তান সিরিজে সবই আছে
‘হ্যাঁ, অ্যাশেজ তো আছেই। কিন্তু আমার মতে, এটা অ্যাশেজের চেয়েও বড়।’
বক্তা ক্রিকেটের ‘প্রফেসর’ রবিচন্দ্রন অশ্বিন। তবে অ্যাশেজের চেয়েও কী বড়, সেই গল্পের ভিতটা বলছেন শোয়েব আখতার, ‘ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ইতিহাস আছে।’
বীরেন্দর শেবাগ বলছেন সাতচল্লিশে সেই ইতিহাসের শুরুটা, ‘ভারত ও পাকিস্তান আলাদা দেশ হওয়ার আগে একটি দেশই ছিল। দুই ভাই আলাদা হয়ে গেল।’
ভাই?
মানচিত্র দেখে কল্পচোখে পাশাপাশি দুই ভাইয়ের বাড়ি মনে হয় বটে, কিন্তু সম্পর্কে যে সাপে-নেউলে তা সবাই জানে। রমিজ রাজার মতে, দুই প্রতিবেশীর পাল্টাপাল্টি এই সম্পর্কের মূল আঁচটা আসে ‘রাজনৈতিক সম্পর্ক’ থেকে। স্রেফ বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচগ্র্য মেদিনী। সেটা হোক যুদ্ধক্ষেত্রে কিংবা ক্রিকেট মাঠে। পরেরটিতে চাপ আরও বেশি।
যুদ্ধ কেউ চায় না, কিন্তু ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ চায় গোটা দুনিয়া। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার স্বাদ-গন্ধই আলাদা। সাধারণ এক ক্রিকেট–ভক্ত বলছেন, এই ম্যাচ দেখতে তাঁরা নাকি সাত-আট দিন আগে থেকে প্রস্তুতি নেন। আর শচীন টেন্ডুলকারের জীবনে এমন ১৪-১৫ বার হয়েছে যে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে আগের রাতে…।
তিনটি ডট চিহ্নিত ফাঁকা জায়গাগুলো পূরণে দেখতে পারেন নেটফ্লিক্সের ডকুসিরিজ ‘দ্য গ্রেটেস্ট রাইভালারি: ইন্ডিয়া-পাকিস্তান’।
বিশেষ করে নব্বই দশকের প্রজন্ম। তিন পর্বের এই সিরিজের শুরুটা ১৯৯৯ সালে পাকিস্তান দলের ভারত সফর দিয়ে। সেটা ঐতিহাসিক সফর কারণ, ১৯৫২ সালে শুরু হওয়া এই দ্বৈরথে ১৯৮৭ সালের পর সেটাই ছিল পাকিস্তান দলের প্রথম ভারত সফর। মাঝে জম্মু ও কাশ্মীর সমস্যায় কেউ দ্বিপক্ষীয় সিরিজে সফর করেনি। রাজনৈতিকভাবেও বন্ধুত্বের বাতাবরণে মোড়ানো ছিল ১৯৯৯ সালের সেই সিরিজ।
কলকাতা টেস্টের আগে শহীদ আফ্রিদির সঙ্গে কেনাকাটা করতে বের হয়েছিলেন শোয়েব। আফ্রিদির আশপাশে ভক্তদের তিল ঠাঁই না হলেও তাঁকে তখন সেভাবে কেউ চিনত না। এক লোক শুধু তাঁর পরিচয় জানতে চেয়েছিলেন। উত্তরে শোয়েব যা বলেছিলেন ও মাঠে নেমে যা করেছিলেন, এ দুটো বিষয় এবং সেই ইয়র্কার দুটি একসূত্রে গাঁথলে আদতে সেটি ক্রিকেট মহাকাশে ধূমকেতুর আবির্ভাবের গল্প। শোয়েব বলেছেন সে গল্প, আরও বলেছেন এক দরবেশের কথা, যিনি তাঁর মাকে বলেছিলেন, এমন কেউ একজন আসবে…ওহ, আরও একটি কথা জানেন তো, হলিউডের সেই বিখ্যাত সিনেমার চরিত্র ফরেস্ট গাম্পের সঙ্গে শোয়েবের মিল কোথায়?
আছে দিল্লির গল্পও। পাকিস্তান যাওয়ার আগে শিবসেনারা সেই যে ফিরোজ শাহ কোটলার (অরুণ জেট লি স্টেডিয়াম) পিচ খুঁড়ল, তারপর তাঁদের নেতা বাল থ্যাকারের বক্তব্য, এসবের ভিডিও রয়েছে। কিংবা চেন্নাইয়ে পাকিস্তানের অবিস্মরণীয় সেই জয়ে অশ্বিন কোথায় ছিলেন জানেন? শেষ ওভারে আশীষ নেহরা কেন ড্রেসিংরুমে জাভেদ মিয়াঁদাদকে দেখে বোলিং করবেন বলেছিলেন? এমন কিছু অজানা গল্পে নস্টালজিক হওয়ার রসদ আছে।
গল্পটিকে টেনেছেন খ্যাতিমান কয়েকজন সাংবাদিক ও ঐতিহাসিক। ‘ক্রিকেট ভিসা’ বলেও কিছু হয় সেটা জানেন তো? কিংবা সেই ফ্রুট চাটনিওয়ালা, ২০০৪ সালে ভারত ক্রিকেট দল পাকিস্তান সফরে যাওয়ার পর সৌরভ-রাহুলদের আতিথেয়তার অনুপম দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিলেন যিনি। শোয়েবের সঙ্গে তাঁর কথাগুলো ভারত-পাকিস্তানের ভেতরে এক অন্য রকম সম্পর্কেরও প্রকাশ। যেমনটা পাকিস্তানে পেয়েছিলেন বীরেন্দর শেবাগ। বীরু নাকি সেই সফরটি কখনো ভুলতে পারবেন না। ভালো কথা, ২০০৪ সালের সেই সফরের গল্প নিয়েই দ্বিতীয় পর্বের বেশির ভাগ। শেষ পর্বে নিয়ে আসা হয়েছে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিকে।
আছে আইপিএলের এক টুকরো গল্পও। সেখানে অবশ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, আপন করে নেওয়ার পথে হঠাৎ বিচ্ছেদের গল্প। আছেন গাভাস্কারও। ব্রিটিশদের শেখানো কেতাদুরস্ত ব্যাটিংয়ের মহারথী ও বিশ্লেষক হিসেবে। গাভাস্কারদের পর টেন্ডুলকারদের প্রজন্ম এসে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে ভারতীয় ব্যাটিংয়ের ধারা পাল্টে দেওয়ার টুকরো গল্পও আছে, যেখানে পূর্ণতা পেয়েছে শেবাগে। আর আছে একটা রূপক, যেটা মাঠে দুই দলের প্রতিচ্ছবি। ভারতের ব্যাটিং বনাম পাকিস্তানের বোলিং।
শোয়েবকে এই বোলিংয়ের নেশাতেই পেয়েছিল। সে জন্য কেন খালি পকেটে বাসের ছাদে উঠেছিলেন, শেবাগই বা কেন লেখাপড়া করা পর্যন্ত ক্রিকেট খেলতে চেয়েছিলেন, এসব গল্প বলেছেন তাঁরাই। শিকড়ের গল্পও আছে। ’৮৩ ও ’৯২ বিশ্বকাপ—যে দুটি টুর্নামেন্টের পর ভারত ও পাকিস্তানের ক্রিকেট মানচিত্র পাল্টে গেল, দ্বৈরথও পেল অন্য মাত্রা। দুই দেশেই জন্ম হলো কয়েকজন নায়কের।
ভারত ও পাকিস্তানে ক্রিকেটের সম্প্রসারণে এমন কয়েকজন নায়ক দরকার ছিল। কপিল দেব, ইমরান খান…। তাতে এই দুই দলের দ্বৈরথও পেতে থাকে অন্য মাত্রা। প্রথম পর্বের নাম তাই ‘রাইজ অব দ্য লেজেন্ডস’ বা কিংবদন্তিদের উত্থান। দ্বিতীয় পর্বের নাম ‘ দ্য ব্যাটল গ্রাউন্ড’ এবং শেষ পর্ব ‘মেকিং হিস্ট্রি’।
ইমরান খানের অনুপস্থিতি অবাক করতে পারে। পুরোনো ভিডিওতে আছেন অবশ্য। ওয়াসিম আকরামও পুরোনো ভিডিওতে। ওয়াকার ছিলেন, ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের উত্তাপ নিয়ে বলেছেন। জাভেদ বরাবরের মতোই ‘স্ট্রিট স্মার্ট’, তাঁর মতে, এই ম্যাচে খেলোয়াড়দের চাপ নেই। সব চাপ দর্শকদের।
কিন্তু আসলে কি তা–ই? জিজ্ঞেস করতে পারেন, মিয়াঁদাদকে। মঈন খান ক্রিজে থাকতে তিনি কেন ড্রেসিংরুমে শ্যাডো করছিলেন? ইনজামামকে কেন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ম্যাচটা পাতানো কি না? এই ম্যাচের আগে ওয়াসিমকে তাঁর মা ও পথচারীর কাছ থেকে কী শুনতে হয়েছে। মোহাম্মদ শামিকে অনলাইনে হয়রানি করেছিল কারা। দর্শকদের চাপটা বুঝিয়ে দেওয়া যায় একটি তথ্যে। সাতচল্লিশে দেশভাগের পর সবচেয়ে বেশি মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিল এই দ্বৈরথের কারণে। কিন্তু কোন সফরে ও কী পরিমাণ মানুষ?
ভারত ও পাকিস্তানের অনেক তারকাই এই তথ্যচিত্রে নেই। মাঠের দ্বৈরথের ভিডিও-ও বেশ কম। কিন্তু গল্পটা ক্রিকেটার, ক্রীড়া সাংবাদিকের মুখে বেশ ভালো জমে ওঠায় ক্লান্তি লাগে না। বরং কোনো একটি টেস্টের আগে একটি স্টেডিয়ামের সাতটি গেটের সব কটি দর্শকের ভেঙে ফেলার কথা শুনে অবাক লাগতে পারে। ভারতের সাবেক পেসার মনোজ প্রভাকর সরফরাজ নওয়াজের কাছ থেকে রিভার্স সুইংয়ের বিদ্যা শিখে নিয়েছিলেন, সেটা অবশ্য আরও চমকপ্রদ।
চন্দ্রদেব ভগত ও স্টুয়ার্ট সাগের যৌথ পরিচালনায় এ তথ্যচিত্র চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে মুক্তি পায়। শেবাগ ও শোয়েব পুরো সিরিজে ধারা বর্ণনা করেছেন। নব্বই ও মিলেনিয়ামের দশকে ভারত-পাকিস্তান উন্মাদনায় ফিরে তাকাতে চাইলে এ সিরিজটি আপনার জন্যই।
দ্য গ্রেটেস্ট রাইভালারি: ইন্ডিয়া ভার্সেস পাকিস্তান
পরিচালক: চন্দ্রশেখর ভগত ও স্টুয়ার্ট সাগ
ধরন: প্রামাণ্যচিত্র
যাঁরা আছেন: শোয়েব আখতার, বীরেন্দর শেবাগ, ওয়াকার ইউনিস, সুনীল গাভাস্কার, সৌরভ গাঙ্গুলী, রবিচন্দ্রন অশ্বিন, জাভেদ মিয়াঁদাদ, ইনজামাম-উল-হক।
রানটাইম: তিনটি পর্ব (প্রতি পর্ব ৩২-৩৬ মিনিট)
আইএমডিবি রেটিং: ৬.৫/১০
দেখা যাবে: নেটফ্লিক্সে