ঘণ্টায় ১০০ মাইল—শোয়েব আখতারের রেকর্ড গড়া সেই দ্রুততম বলের গল্প
লম্বা দৌড় শেষে ব্যাটসম্যানের দিকে তেড়েফুঁড়ে বল ছুড়ে মারা—এই ছিল মাঠের শোয়েব আখতারের চেনা চেহারা। ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট দিয়ে দলে অভিষেক, খেলেছেন ২০১১ বিশ্বকাপ পর্যন্ত। ‘রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেস’কে অনেক কারণেই ক্রিকেট মনে রাখবে, যার মধ্যে একটা—তিনিই ক্রিকেট ইতিহাসের দ্রুততম বোলার এবং অফিশিয়ালি ১০০ মাইলের বেশি গতিতে বল করা একমাত্র বোলারও। আত্মজীবনী ‘কন্ট্রোভার্শিয়ালি ইয়োরস’-এ শোয়েব লিখেছেন সেই রেকর্ডের জন্য তাঁর প্রস্তুতি এবং শেষ পর্যন্ত সেই বলটা করার গল্প।
কী লিখেছেন শোয়েব আখতার
২০০০ সাল। আমি তখন অস্ট্রেলিয়ায়। আমার এক সাংবাদিক বন্ধু আমার বহুদিনের একটা ইচ্ছা পূরণ করে দিলেন। তিনি জেফ টমসনের (কিংবদন্তি অস্ট্রেলিয়ান ফাস্ট বোলার) সঙ্গে আমার একটা সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিলেন।
তাঁকে আমি সব সময় বিশ্বের সেরা ফাস্ট বোলারদের একজন মনে করি। ১৯৭৫ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এক টেস্টে তাঁর ঘণ্টায় ৯৯.৭ মাইল গতিতে বলের রেকর্ডটাই আমি ভাঙতে চেয়েছিলাম।
টমসন তখন ব্রিসবেনে পরিবারসহ থাকতেন। তিনি আমাকে চায়ের দাওয়াত দিলেন। দেখা করতে গেলাম। আমাকে দারুণ আন্তরিকভাবে বরণ করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আলাপ চলে গেল ক্রিকেটে। কিংবদন্তি সেই বোলার মুচকি হেসে বললেন, ‘তাহলে কি আমার রেকর্ড ভাঙার চিন্তা করছ?’
আমি হেসে বললাম, ‘ওটা ভাঙতেই হবে, এই ভেবে চাপ নিচ্ছি না। তবে যেদিন শরীর একদম ফুরফুরে লাগবে, সেদিন ভেঙে দেব!’
ওটা ভাঙার আসলে খুব চাপ ছিল না। তবে বিশ্বের দ্রুততম বোলার হিসেবে পরিচিত হতে আমি মরিয়া ছিলাম। ক্যারিয়ারের শুরুতেই মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম—এই পরিচয়টাই চাই। পাকিস্তানের হয়ে ম্যাচ জেতানোর মতো বোলার আমি তত দিনে হয়ে গেছি, কিন্তু আমি আরও বেশি কিছু চাচ্ছিলাম।
শুরু থেকেই জানতাম, আমি আলাদা ধরনের ফাস্ট বোলার। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ঢোকার পর বুঝলাম, আমি এখনো সবচেয়ে দ্রুত নই। ১৯৯৯ সালে কলকাতায় প্রথমবার শচীনকে আউট করার সময়ও জানতাম, আমি খুব গতিতে বল করছি, কিন্তু নিজের সীমা পর্যন্ত যেতে পারিনি। তাই মন দিলাম গতি বাড়ানোর দিকে। অনেকে বলত, আমি ওয়াকার ইউনিসের চেয়ে ধীর। কথাটা মানতাম না।
ইংল্যান্ডে ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে সবাই বুঝে গেল আমি সত্যিই দ্রুত। স্পিডগান তখন প্রতি বলের গতি দেখাত, তাই আমার গতি আর অস্বীকার করা যাচ্ছিল না। তখন অ্যালান ডোনাল্ডকে ধরা হতো বিশ্বের দ্রুততম বোলার। কিন্তু আমি নিয়মিত ৯৬–৯৭ মাইল গতিতে বল করছিলাম। ভালো লাগছিল। গতিও পাচ্ছিলাম, যা নিশ্চিতভাবেই আরও ওপরের দিকে যেতে পারত। কিন্তু সত্যি কথা হলো, আমিই যেন নিজেকে আটকে রেখেছিলাম।
হাঁটুর ব্যথা তখনো ছিল, সেটি নতুন কিছু না। আসল সমস্যা ছিল নিজের ভেতরের ভয়। আমার অ্যাকশন নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল, যা আমাকে একটু অস্বস্তিতে ফেলেছিল। মুরালিকেও (মুত্তিয়া মুরালিধরন) সেই সময়ে সন্দেহের মুখে পড়তে দেখা গেছে। আমি চাইনি আমার ক্ষেত্রেও সেটা ঘটুক। কিন্তু ঠিক সেটাই ঘটল।
যেদিন আমার অ্যাকশন নিয়ে প্রশ্ন উঠল, সেদিন থেকেই নিজের ওপর আস্থা হারাতে লাগলাম। এক বছর কেটে গেল এই অভিযোগের জালে আটকে। কেউ বলত এটা করো, কেউ বলত ওটা করো। সব মিলিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছিলাম। জীবনের সেরা সময়টায় ছন্দ হারিয়ে ফেললাম। নিজের ওপর সন্দেহ ঢুকে গেল, আমি কি খেলার সঙ্গে প্রতারণা করছি? ভয় পেতে লাগলাম, যদি অ্যাকশন অবৈধ ধরা হয়! এ রকম পরিস্থিতিতে মন-প্রাণ ঢেলে খেলা সম্ভব নয়। আমি খেলছিলাম, কিন্তু অর্ধেক মন দিয়ে।
২০০২ সালের জানুয়ারিতে করাচিতে জাতীয় দলের ক্যাম্পে যোগ দিলাম। তখনো দলে আমার জায়গা নিশ্চিত নয়। আমাদের বাংলাদেশ সফরে যাওয়ার কথা। সিরিজের প্রথম টেস্টেই প্রথম বল করার পর ওয়াসিম আকরামের হ্যামস্ট্রিং ছিঁড়ে গেল। মনে আছে, ভীষণ হতাশ হয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন তিনি। জানতেন, ক্যারিয়ার শেষের দিকে। এই চোট হয়তো সেটাকে আরও এগিয়ে আনবে। তখন লে. জেনারেল জিয়ার (তৎকালীন পিসিবি চেয়ারম্যান) সঙ্গে ওয়াসিম ভাইয়ের সম্পর্কও খুব একটা ভালো ছিল না, ফলে চিন্তা আরও বাড়ল তাঁর।
আমাদের মধ্যে অনেক মতবিরোধ থাকলেও ওয়াসিম ভাইয়ের প্রতিভার প্রতি সব সময়ই শ্রদ্ধা ছিল আমার। তত দিনে হয়তো একটু পরিণতও হয়ে গিয়েছিলাম। তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলাম, ‘ঠিক আছে, চিন্তা করবেন না। পরের বিশ্বকাপে খেলবেন আপনি।’
ওয়াসিম ভাই তখন নিজের ওপর রাগে ফুঁসছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই চোটই আমার জন্য দরজা খুলে দিল। দ্বিতীয় টেস্টে খেললাম, নিলাম ৪৮ রানে ৪ উইকেট। এরপর গেলাম শারজায়, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। আমার হ্যামস্ট্রিং তখনো পুরোপুরি সেরে ওঠেনি, তবু ধীরে ধীরে ছন্দ ফিরে পাচ্ছিলাম। টেস্ট ও ওয়ানডে—দুই ফরম্যাটেই ভালো করলাম। তবে পুরোনো ছন্দ ফিরে পেতে আমার এক বছর লেগে গিয়েছিল।
একজন খেলোয়াড়ের জীবনে এক বছর অনেক লম্বা সময়, আর যদি সে ফাস্ট বোলার হয়, তাহলে তো কথাই নেই। তবে শেষ পর্যন্ত আইসিসি আমার বোলিং অ্যাকশনকে বৈধ ঘোষণা করল। একটা বিশাল বোঝা যেন নেমে গেল কাঁধ থেকে। আমার মন আবার স্থির হতে শুরু করল। বুঝতে পারলাম, আবার আসল কাজে মন দিতে পারছি।
সেই এপ্রিলেই, ২০০২ সালে, লাহোরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এক ওয়ানডেতে ক্রিকেট ইতিহাসের দ্রুততম বলটা করলাম আমি—ঘণ্টায় ১০০.০৫ মাইল গতিতে! তবে স্বাভাবিকভাবেই, আমার এই কীর্তি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিতর্কের মুখে পড়ল।
সেই সময় সব বলের গতি মাপা হতো দক্ষিণ আফ্রিকার ইলেকট্রনিক ডেভেলপমেন্ট হাউসের তৈরি একটি সিস্টেমে। সেই সিস্টেমে রেকর্ড হওয়া দ্রুততম ডেলিভারিটিও আমারই করা—দুই বছর আগে ভারতের বিপক্ষে ঘণ্টায় ৯৬.৭৫ মাইল (১৫৫.৭ কিলোমিটার)।
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে যখন ঘণ্টায় ১০০.০৫ মাইল (১৬১ কিলোমিটার) গতি তুললাম, দারুণ খুশি হয়েছিলাম। কারণ, আমিই প্রথম বোলার যে ‘১০০ মাইল ক্লাবে’ ঢুকেছে। কিন্তু এরপরই আমাদের জানানো হলো, ‘অফিশিয়াল’ স্পিড মেশিনটি নষ্ট ছিল বলে সেই বলের গতি মাপা হয়েছিল লাহোরের একটি হাইটেক কোম্পানি ‘সাইবারনেট’-এর যন্ত্রে। এই অজুহাতেই আইসিসি আমার রেকর্ড অনুমোদন করল না।
আমি জানতাম, যন্ত্রটা ঠিকই ছিল। রেকর্ডটাও ঠিক। সাংবাদিকদের বলেছিলাম, আমি এখন পুরো ফিট। চাইলে যেকোনো দিন ১০০ মাইলের ওপর গতি তুলতে পারি। বলেছিলাম, রেকর্ডটা স্বীকৃতি পেলে ভালো লাগবে, না পেলেও কিছু যায়-আসে না। কারণ, আমি জানি, আমিই ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে দ্রুতগতির বল করেছি।
পরদিন সকালে ব্রেট লি ফোন করে অভিনন্দন জানাল। এরপর কয়েক দিনে অনেক বন্ধু ফোন করল। জাস্টিন ল্যাঙ্গার তো মিডিয়ায় বলেই দিল, আমি নাকি ‘বিদ্যুতের মতো দ্রুত’। আমার সামর্থ্য নিয়ে যারা সন্দেহ করছিল, টনি গ্রেগ তো ধারাভাষ্যে সবাইকে ধুয়ে দিলেন।
এদিকে ব্রেট লিও বলে দিল, আমার রেকর্ডে সে খুশি, তবে সে নিজেও এবার সেটা ভাঙার লক্ষ্য ঠিক করেছে। বলল, ২০০২ সালের জুনে অস্ট্রেলিয়া-পাকিস্তান সিরিজেই দেখা যাবে কে বেশি দ্রুত! তখন তিনটি ওয়ানডে হবে মেলবোর্ন আর ব্রিসবেনে। অ্যাডাম গিলক্রিস্টও মিডিয়ায় বলল, ‘ব্রেটের দক্ষিণ আফ্রিকায় করা ৯৭.৮১ মাইল (১৫৭.৪ কিমি) হয়তো ওর সবচেয়ে দ্রুত বল ছিল না।’ এই মন্তব্যের পর থেকে যেন এক নতুন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল—কে বেশি দ্রুত! মিডিয়া যেন উৎসবে মেতে উঠল।
আমার মনে হয়, ব্রেট এই আলোচনা বেশ উপভোগ করছিল। তবে এর ফলে আমার রেকর্ডের উত্তেজনাটা নিভে গেল। যেহেতু কেউ আমার আগের কীর্তিগুলো স্বীকারই করছিল না। তাই আমার মনে হলো, ‘কী সব বাজে কথা! এসবই অর্থহীন।’ সবাই রেকর্ড নিয়ে এত আলোচনা করছে, অথচ কেউ মানছে না যে রেকর্ডটা এর মধ্যেই আমি ভেঙে দিয়েছি।
এই প্রতিযোগিতা ছিল মাঠের। মাঠের বাইরে ব্রেট আর আমি ভালো বন্ধু। প্রথম দেখা হওয়ার সময়ই বলেছিল, আমি নাকি ফাস্ট বোলার হওয়ার পেছনে ওর অনুপ্রেরণা। ব্রেট যেমন দুর্দান্ত বোলার, তেমনি দারুণ গায়ক আর নাচেও ওর জুড়ি মেলা ভার। আমিও তো কম যাই না! তাই আমাদের জমত বেশ। একসঙ্গে পার্টিতে গেলে হইচই পড়ে যেত। যখন মেয়েরা দেখত বিশ্বের দুই দ্রুততম বোলার হেঁটে আসছে, তারা আমাদের দিকে ছুটে আসত।
তবে মাঠে নামলেই শুরু হতো লড়াই। আমার মনে হতো, আইসিসি হয়তো ব্রেটের রেকর্ডটাই আগে স্বীকৃতি দেবে। ওর পেছনে ছিল পুরো দেশ। আর আমার? নিজের দেশেই কেউ পাত্তা দিত না। তখনই ভাবলাম, আমি জানি আমিই সবচেয়ে দ্রুত। এবার সেটা দুনিয়াকে দেখাতে হবে।
আমি বুঝে গিয়েছিলাম, এটা শুধু কোনো আইসিসি অনুমোদিত টুর্নামেন্টেই করা সম্ভব, যেখানে অফিশিয়াল স্পিডগান থাকবে।
সেই ভাবনা নিয়েই শুরু হলো ২০০২ সালের শিকার–অভিযান। অস্ট্রেলিয়া তখন ভয়ংকর শক্তিশালী দল। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং—সব দিক থেকেই দুর্দান্ত। দলটা এক হয়ে লড়ত জেতার জন্য। আমার ক্যারিয়ারে ওরাই ছিল সবচেয়ে কঠিন প্রতিপক্ষ।
জাস্টিন ল্যাঙ্গার আমার ভালো বন্ধু, কিন্তু মাঠে নামলে আমরা যেন যুদ্ধ করতাম। ওর বিপক্ষে বল করা কঠিন ছিল, প্রায়ই মিস করত, বল শরীরে লাগত। তবু তাকে আউট করতে পারতাম না। ভীষণ দৃঢ় ওপেনার ছিল। গিলক্রিস্ট অসাধারণ মানুষ, দুর্দান্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। রিকি পন্টিং, আমার মতে, যুগের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন। হেইডেনও শক্ত প্রতিপক্ষ, আর অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস তো একাই ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতে পারত।
মাঠের বাইরে অস্ট্রেলীয়রা ছিল প্রাণবন্ত, মজার সঙ্গী। কিন্তু মাঠে নামলেই তারা হয়ে যেত ভয়ংকর। খ্যাপানো, স্লেজিং করা—সব রকম চাল তারা জানত। সত্যি বলতে, এটাই আমার ধাঁচের ক্রিকেট। প্রতিপক্ষকে ভয় দেখানোতেই তো ফাস্ট বোলারদের মজা!
সেই সিরিজে ওয়াকার ইউনিসের অধিনায়কত্বে আমি জীবনের সবচেয়ে দ্রুত বলগুলো করেছি। অসাধারণ পারফরম্যান্সে আমরা সিরিজ জিতলাম। আমি যেন তখন আগুন ঝরাচ্ছিলাম। অসাধারণ বল করে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ২ উইকেট আর তৃতীয়টিতে ৫ উইকেট তুলে নিলাম। প্রথম ম্যাচ না খেলেও আমি ‘প্লেয়ার অব দ্য সিরিজ’ পুরস্কার পেলাম।
প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়ার টপ অর্ডারকে আমার বল খেলতে গিয়ে নার্ভাস মনে হলো। তারা আমার বলের গতিতে চমকে উঠছিল—বিশ্বাস করুন, এটা ছিল দারুণ তৃপ্তিদায়ক।
বাড়ি ফেরার সময় আমার মনে হচ্ছিল, খুব ভালো কিছু ঘটতে চলেছে।
আগস্ট মাসে পাকিস্তানের মরক্কো কাপে অংশ নেওয়ার জন্য তাঞ্জিয়ারে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমার মনে হলো, আমার কিছুটা বিশ্রাম দরকার। শরীর যেন বলছিল, ‘ব্রেক দরকার’। আমি শরীরের ডাকই শুনলাম। তাই মরক্কোর বদলে আমি ফিরে গেলাম ইংল্যান্ডে, ল্যাশিংস ক্লাবে, দু-একটা ম্যাচ খেলতে।
ল্যাশিংস ক্লাবে খেলার অভিজ্ঞতা ছিল বেশ মজার। ক্রিকেট খেলতাম ঠিকই, তবে খুব কম। ক্লাবটা যেন ক্রিকেট ক্লাবের চেয়ে বেশি ছিল এক ধরনের সোশ্যাল ক্লাব—বার ছিল, আর খেলোয়াড়দের আদর-আপ্যায়নে ব্যস্ত কিছু মেয়ে। তবে যতটুকু ক্রিকেট খেলতাম, সেটা ছিল মজার, দর্শকও আসত। সিরিয়াস ক্রিকেট নয়, বরং বাউন্ডারির ধারে খেলোয়াড়েরা মেয়েদের সঙ্গে গল্পে মেতে থাকত। আমাদের জন্য সব দিক থেকেই লাভ—পার্টি, টাকা, নাম, সবই মিলত। ক্লাব মালিক ডেভিড ফোলি পেতেন প্রচারণা। যাতায়াতের গাড়ি, থাকার দারুণ ব্যবস্থা সবই ছিল। ‘ল্যাশিংস’ ছিল মজা করার জায়গা।
একবার একটা চ্যারিটি ম্যাচ খেলেছিলাম কেন্টের বিপক্ষে। পাকিস্তানের কয়েকজন ক্রিকেটারও খেলেছিল, ওয়াসিম আর ওয়াকারও ছিলেন ল্যাশিংসের দলে। ওরা পরে তাঞ্জিয়ারে চলে গেল, আমি থেকে গেলাম। পরে কেনিয়ায় দলের সঙ্গে যোগ দিলাম।
কেনিয়া সফরটা ছিল একেবারে দুঃস্বপ্ন। বাজে খেললাম, সিরিজ হারলাম। আর পাকিস্তান হারলে ড্রেসিংরুম হয়ে ওঠে পৃথিবীর সবচেয়ে অস্বস্তিকর জায়গা। আমাদের দলীয় ব্যর্থতা চলতেই থাকল, যার ফল—পরের মাসে শ্রীলঙ্কায় চ্যাম্পিয়নস ট্রফি থেকেও ছিটকে গেলাম।
এরপর আমাদের অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তিনটি টেস্ট ম্যাচের সিরিজ। যার প্রথমটি হলো কলম্বোয়। আমি আমার চারপাশের সব নেতিবাচকতা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলাম। আর খেললামও বেশ ভালো—৫১ রানে ৩ উইকেট, এরপর ৮ ওভারে ২১ রানে ৫ উইকেট। কীভাবে ওই সময়টা সামলেছিলাম, জানি না। কারণ, এত গরম আর আর্দ্রতা ছিল যে আমার শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল। আমি বুঝতে পারি না, কেন উপমহাদেশে গরম আর আর্দ্রতায় ম্যাচ আয়োজন করা হয়! ফাস্ট বোলারদের জন্য এটা অবিশ্বাস্য কঠিন। আর প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানরা বাড়তি সুবিধা পায়।
ইমরান খান একসময় বোর্ডকে বলতেন, এত গরমে খেলতে পারবেন না—শরীর কাজ করে না। আমাকে বলতেন, এত গরমে খেলো না, এটা তো শ্রম আইনেরও লঙ্ঘন! ৪৭ ডিগ্রির ওপরে তো কাজ করাই উচিত না।
তবু বল করলাম। শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে। এরপরের দুই ম্যাচ ছিল শারজায়। প্রথম দিনই তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি! কয়েক ওভার বল করতেই শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেল, অজ্ঞান হয়ে গেলাম। ম্যানেজমেন্টকে বললাম, আর পারছি না। শরীর ভেঙে পড়ছে। দেশে ফিরে এলাম।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে সিরিজটা হারলাম। লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়া পদত্যাগপত্র জমা দিলেন। আমরা সবাই খুব লজ্জিত ছিলাম। পরে সবাই মিলে তাঁকে অনুরোধ করে পদত্যাগ প্রত্যাহার করালাম।
বছরটা শেষ হলো হাঁটুর চোট আর জিম্বাবুয়েতে এক দর্শকের দিকে পানির বোতল ছুড়ে মারার শাস্তি নিয়ে। নভেম্বর ২০০২। জিম্বাবুয়ে সিরিজজুড়েই হাঁটুতে ব্যথা ছিল। ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছিলাম, রাগ সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। প্রথম ওয়ানডেতেই মাথা গরম হয়ে গেল। বাউন্ডারির ধারে দাঁড়িয়ে পানি খাচ্ছিলাম। তখন এক দর্শক লাগাতার গালাগাল করছিল। এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। খেলাপ্রেমী দর্শকের মধ্যেও কিছু ‘পচা আপেল’ থাকেই। সাধারণত এসব এড়িয়ে যাই, কিন্তু সেদিন মাথায় আগুন ধরে গেল।
আমার রাগ এমনিতেই তীব্র, আর বল করার সময় সেটা আরও বেড়ে যায়। ঘুরে দাঁড়িয়ে পানির বোতলটা ছুড়ে মারলাম। সোজা গিয়ে লাগল লোকটার মুখে। চোটও পেল। ম্যাচ রেফারি সব দেখলেন। এক ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ হলাম। শাস্তি প্রাপ্য ছিল।
২০০২ সালের শেষটা কাটল দুশ্চিন্তায়। শরীর নিয়ে চিন্তা বাড়ছিল। সামনে ২০০৩ বিশ্বকাপ, দল থেকে বাদ পড়ার ভয় তাড়া করছিল। হাঁটু যেন তখন একেবারে ভেঙে পড়েছে। ব্যথানাশক ইনজেকশন নিতে হচ্ছিল সরাসরি হাঁটুতে। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়া ডেকে পাঠালেন আমার বন্ধু ও চিকিৎসক তৌসিফ রাজ্জাককে। তৌসিফের চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হলাম। আর তাতেই সম্ভব হলো দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে খেলা।
২০০৩ বিশ্বকাপের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এল ২২ ফেব্রুয়ারি। নিউল্যান্ডস, কেপটাউনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাকিস্তানের ম্যাচ। ম্যাচের শুরুতেই বুঝে গেলাম, আমি অস্বাভাবিক দ্রুত বোলিং করছি। স্ট্রাইকে ছিলেন নিক নাইট। নিজের গতি খেয়াল করছিলাম—বল ৯০ মাইলের ঘর ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এরপর নিজেকে আরও চাপ দিলাম। অফিশিয়াল স্পিডগান তখন দেখাচ্ছে ৯৪ থেকে ৯৭ মাইল। তারপর ছুঁলাম ৯৯ মাইল। নিজেকে বললাম, ‘এই তো সময়, এখন না হলে আর কবে। প্রাণপণ দৌড়াও, আজ একটা রেকর্ড গড়া যাক!’
কিন্তু যতই তাড়াহুড়ো করছি, কিছু একটা গন্ডগোল হচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম না, কোথায় সমস্যা। তারপর মন দিলাম নিজের রান-আপে—পা ফেলার জায়গায়, গতি তোলার শেষ কয়েক গজে। দেখলাম, ঠিক সেখানেই গতি হারাচ্ছি। মন স্থির করলাম, শেষ পর্যন্ত গতি ধরে রাখব। হাত ঘুরিয়ে বল ছাড়লাম। স্পিডগান দেখাল—১৬১.৩ কিমি। আবারও ১০০ মাইলের বাধা পেরিয়ে গেলাম!
প্যাভিলিয়নের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলাম—‘দেখো, আবার করে দেখালাম। আল্লাহর দোহাই, এবার অন্তত স্বীকৃতি দাও।’ এবার দিল! চারপাশে উচ্ছ্বাস। তবে আমি জানি, আরও দ্রুত বল করতে পারতাম। কিন্তু তখনকার জন্য এটুকুই যথেষ্ট ছিল।
সেদিন সন্ধ্যায় নাইটের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বলগুলোর গতি টের পেয়েছ?’ সে বলল, ‘অবশ্যই! প্রতিটা বল!’ সেই ডেলিভারির লিমিটেড এডিশন ছবি বের হলো। নাইট আমার কাছ থেকে একটা অটোগ্রাফও নিল। আবেগ ছুঁয়ে গিয়েছিল। আরও কয়েকজন বন্ধুর জন্যও সই করেছি—তারা এখনো দেয়ালে টাঙিয়ে রেখেছে।
এই রেকর্ডটাই ছিল ওই বিশ্বকাপের একমাত্র সুখস্মৃতি। কারণ, আমাদের পারফরম্যান্স ছিল ভয়াবহ। পাকিস্তানের ২০০৩ বিশ্বকাপ এককথায় দুঃস্বপ্ন। কেউ ভালো খেলেনি, আমিও না। টুর্নামেন্টের গ্রুপ পর্ব থেকেই ছিটকে গেলাম।
পাঠকের জন্য
১৯৯৭ থেকে ২০১১—১৪ বছরের ক্যারিয়ারে তিন সংস্করণে মোট ২২৪ ম্যাচ খেলেছেন শোয়েব, নিয়েছেন ৪৪৪ উইকেট। বর্তমানে ইউটিউব, টক শো এবং ধারাভাষ্যে ব্যস্ত সময় কাটান শোয়েব। ‘কন্ট্রোভার্শিয়ালি ইয়োরস’ বইয়ের মতো সেখানেও অকপট, সোজাসাপ্টা শোয়েবেরই দেখা মেলে, যেমনটা ছিলেন বোলিংয়ে।