ব্রাজিলে প্রথম ক্রিকেট ব্যাটের কারখানা, ব্যাটের দাম ২ হাজার টাকারও কম

আপন মনে ব্যাট বানানোর কাজ করছেন লুইজ রবার্তো ফ্রান্সিসকোছবি: এএফপি

লুইজ রবার্তো ফ্রান্সিসকো এখন পেশায় পুরোদস্তুর কাঠমিস্ত্রী। তাঁর কারখানার জানালা দিয়ে বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্যটা মনোলোভা। সবুজ বনানীতে সাজানো পর্বতমালা। জায়গাটা ব্রাজিলের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলে।

ফ্রান্সিসকো কাঠের কাজ কারও কাছ থেকে শেখেননি। কথায় আছে না ‘গাইতে গাইতে গায়েন, বাজাতে বাজাতে বায়েন’—ফ্রান্সিসকোও তেমনি কাঠের কাজ করতে করতে এখন কাঠমিস্ত্রী।

ফুটবল–পাগল দেশটিতে তাঁর সময় কাটে বিরল শিল্পকর্ম তৈরিতে। দেশটার নাম ব্রাজিল বলেই ক্রিকেট ব্যাট বানানোকে বিরল শিল্পকর্ম বলতে হচ্ছে। পাইনের কাঠ দিয়ে ফ্রান্সিসকো বানিয়ে চলছেন একের পর এক ‘শিল্পকর্ম।’

আরও পড়ুন

ব্রাজিলে মিনাস গেরাইস প্রদেশে লোকসংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার। সেখানে ছোট্ট শহর পোকোস দে কালদাসে একটি কারখানা দিয়েছেন ৬৩ বছর বয়সী ফ্রান্সিসকো। ফুটবলে পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলে এটাই প্রথম ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কারখানা।

ফ্রান্সিসকো নিজেই ব্যাট বানানোর কারখানা দিযেছেন
ছবি: এএফপি

২০০২ সালে আইসিসির সদস্যপদ পায় ব্রাজিল। ১৫ বছর পর পায় সহযোগি সদস্য দেশের মর্যাদা। ২০০৯ সালে আমেরিকাস চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে আইসিসির ডিভিশন টু–তে উন্নীত হলেও পরের বছর অবনমন ঘটে ব্রাজিলের। নেমে যায় ডিভিশন থ্রি–তে।

ফুটবলার রপ্তানিতে যে দেশ শীর্ষ কাতারে থাকে, ফুটবল যে দেশে ধর্মের মতো মর্যাদা পায়, সে দেশের ক্রিকেটে উন্নতিটা মন্থর হওয়াই স্বাভাবিক। তাই বলে ব্রাজিল ক্রিকেট কনফেডারেশন হাল আমলে যাত্রা শুরু করেছে ভাবলে ভুল হবে।

আরও পড়ুন

উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশদের হাত ধরে রিও ডি জেনিরোয় ক্রিকেট খেলার শুরু। ১৮৬০ সালের দিকে বেশ কিছু ক্রিকেট ক্লাবেরও জন্ম হয় ব্রিটিশদের হাত ধরে। ১৮৭২ সালে রিও ক্রিকেট ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন জর্জ কক্স।

আরও পড়ুন

কথিত আছে, ১৮৮০–এর দশকের শুরুতে এই ক্লাবেরই মাঠে ব্রাজিলের প্রথম ফুটবল ম্যাচ আয়োজন করেছিলেন জর্জের ছেলে অস্কার। তারও বেশ পরে ১৯২২ সালে ব্রাজিল ক্রিকেট কনফেডারেশনের (সিবিসি) যাত্রা শুরু হয়। ব্রাজিল ফুটবল কনফেডারেশনের (সিবিএফ) বয়স তখন সবে আট বছর।

ফ্রান্সিসকোর বানানো ক্রিকেট ব্যাট দেশটির আনাচে–কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে
ছবি: এএফপি

সে যা হোক, স্পা–র জন্য বিখ্যাত পোকোস দে কালদাসেই ব্রাজিল কনফেডারেশনের সদরদপ্তর অবস্থিত। ইংল্যান্ডের কেন্টে জন্ম নেওয়া সাবেক লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটার ম্যাট ফেদারস্টোন সিবিসির প্রধান। এক সময় ব্রাজিল জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়কত্বও করেছেন।

খেলা ছাড়ার পর বোর্ডপ্রধান হিসেবে এখন তাঁর লক্ষ্য, আগামী তিন বছরের মধ্যে ব্রাজিল থেকে অন্তত ৩০ হাজার ক্রিকেটার বের করা। ‘ইট ফুটবল, ড্রিংক ফুটবল’–এর দেশে লক্ষ্যটা পূরণ করা যে কঠিন তা বলাই বাহুল্য।

আরও পড়ুন

পেশাদার ক্রিকেট ছাড়ার পর ২০০০ সালে নিজের ব্রাজিলিয়ান স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর দেশে চলে আসেন ফেদারস্টোন। ৫১ বছর বয়সী এই লোক তখন সিবিসির মাত্র ১৯ জন স্টাফ নিয়ে ব্রাজিলে ক্রিকেট ছড়িয়ে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ নেন।

সংবাদসংস্থা এএফপি জানিয়েছে, ব্রাজিলে এখন ক্রিকেটারের সংখ্যা ৫ হাজারের বেশি। বোর্ডের নানারকম আঞ্চলিক এবং বয়সভিত্তিক পরিকল্পনায় ক্রিকেটার বেরিয়ে আসছে। ব্রাজিলের মেয়েদের জাতীয় দল তো গত পাঁচবারের মধ্যে চারবারই দক্ষিণ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছে।

ক্রিকেট ব্রাজিলের পক্ষ থেকে কচি–কাঁচাদের খেলাটি শেখানো হয়। আগ্রহীর সংখ্যা বাড়ছে
ছবি: এএফপি

কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পর সব কিছু স্থবির হয়ে পড়েছিল। ক্রিকেট ছড়িয়ে দিতে যে জিনিসটি লাগবেই, সেই ক্রিকেট ব্যাটের খরায় ভুগেছে ব্রাজিল। তখনই দেবদূতের মতো আর্বিভাব ঘটে ফ্রান্সিসকোর। স্থানীয় এক অ্যালুমিনিয়াম প্লান্টে এক সময় ইলেকট্রিশিয়ানের কাজ করতেন তিনি। হাতের কাজে বিশেষ করে কাঠের কাজে সুনাম ছিল এলাকায়। ফেদারস্টোন তাঁকে খুঁজে বের করেন।

ফ্রান্সিসকোর ভাষায়, ‘(ফেদারস্টোন) সে জানায়, ক্রিকেট ব্যাট বানাতে পারে এমন কাউকে খুঁজছে। আমি কাজটা করতে পারব কি না জানতে চায়। আমি প্রস্তাবটি গ্রহন করি।’

আরও পড়ুন

শুরুটা ছিল খুব কঠিন। ক্রিকেট ব্যাট বানানো দূরে থাক, ফ্রান্সিসকো তার আগে জীবনে কখনো ব্যাট ধরেই দেখেননি। কিন্তু আধুনিক এই সময়ে ইউটিউব তো অনেক সমস্যারই সমাধান দিয়ে দিচ্ছে। ফ্রান্সিসকো ধর্না দেন ইউটিউবে।

ক্রিকেট ব্যাট কীভাবে বানায় তা বিভিন্ন ভিডিও দেখে শিখে নেন। শুরুতে ভুল করেছেন, ধৈর্য না হারিয়ে আবারও শিখেছেন, এভাবে হাত পাকানোর পর নিজের ঘরের পাশেই কারখানাটি দেন ফ্রান্সিসকো—যার নাম রয়্যাল ব্যাটস।

অনুশীলনে ব্রাজিল নারী জাতীয় দলের ক্রিকেটার লরা আগাথা। ব্রাজিলের নারী দল উঠে আসছে
ছবি: এএফপি

ইউটিউবে কাঠ কেটে ব্যাট কীভাবে তৈরি করা হয় তা শিখেছেন ফ্রান্সিসকো। ব্যাটের ‘সুইট পয়েন্ট’–এ ঘনত্ব ঠিক রাখতে কীভাবে আঁশগুলোর ওপর চাপ দিতে হয় তাও শিখেছেন। ক্রিকেট ব্যাট বানাতে উপযোগি কোনো যন্ত্র তখন তাঁর কাছে ছিল না।

কিন্তু প্রয়োজন যেমন আইন মানে না তেমনি ইচ্ছে থাকলেও উপায় হয়—ফ্রান্সিসকো নিজেই ব্যাট বানানোর উপযোগি যন্ত্র বানিয়ে নেন, ‘এই কাজ করতে ব্রাজিলে তখন কোনো যন্ত্র ছিল না। আমি অনেক কিছু চেষ্টা করে দেখা পর নিজেই এমন একটি যন্ত্র বানাই।’

আরও পড়ুন

শুরুতে কাঠ বাছাইয়েও সমস্যা হয়েছে ফ্রান্সিসকোর। এমনিতে উইলো থেকে বানানো হয় ব্যাট। শুরুর দিকে ফ্রান্সিসকো যেকোনো মজবুত কাঠ পেলেই তা দিয়ে ব্যাট বানানোর চেষ্টা করেছেন কিন্তু তা তেমন কাজে লাগেনি।

মাসের পর মাস নানা পরীক্ষা–নিরীক্ষার পর ক্রিকেট ব্রাজিল (সিবিসি) ও ফ্রান্সিসকো পাইন কাঠে মনস্থির করেন। ফ্রান্সিসকো এখন মাত্র পাঁচ ঘণ্টার ব্যবধানে বানাতে পারেন। ২০ ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৮৪৬ টাকা) করে দাম পড়ে একেকটি ব্যাটের। বিদেশ থেকে আমদানী করা প্রিমিয়াম ব্যাটের দামের তুলনায় যা প্রায় ৭০ গুণ কম।

ক্রিকেট ব্রাজিলের প্রধান ম্যাট ফেদারস্টোন
ছবি: এএফপি

ব্রাজিলে ক্রিকেটের পসার যেহেতু বাড়ছে ফ্রান্সিসকোও তাই নিজের কাজের ব্যাপ্তি বাড়িয়েছেন। শুধু ক্রিকেট ব্যাট নয়, স্টাম্প এবং মাঠে দর্শকদের বসান উপযোগি চেয়ারও বানান তিনি।

আরও পড়ুন

ফ্রান্সিসকোর এই কর্মযজ্ঞের প্রভাব পড়েছে দেশটির ক্রিকেটে। অনেকেই তাঁর ব্যাট ব্যবহার করেন। আর ব্রাজিলিয়ান ক্রিকেটও এগোচ্ছে আপন গতিতে। ২০২০ সালেই নারী ক্রিকেটারদের পেশাদার চুক্তির আওতায় নিয়ে এসেছে ক্রিকেট ব্রাজিল (সিবিসি)।

ব্রাজিলের নারীদের মধ্যে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বেড়েছে
ছবি: এএফপি

বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে পুরুষ দলের আগে নারী দলকে পেশাদার বানানোর গৌরবটা ব্রাজিলেরই। আর নিরলস শ্রম ও নিবেদনে ব্রাজিলের ক্রিকেটকে এতদূর নিয়ে আসায় যাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি, সেই ম্যাট ফেদারস্টোনকে শুরুতে অনেকে পাত্তা দেননি। কেউ কেউ তাঁকে পাগলও ঠাউরেছেন। ফেদারস্টোন এমনই একজনের নাম বললেন, ‘বউ মনে করে, আমি পাগল।’