ম্যারাডোনা ও মাটির দলায় নাপোলির উৎসব

ম্যারাডোনাকে নিয়েই উদিনেসের স্টেডিয়ামে গিয়েছিলেন নাপোলির সমর্থকেরা। তাঁর ছবি সংবলিত ব্যানারছবি: রয়টার্স

ছবিটি তুলেছেন রয়টার্সের আলোকচিত্রী। উদিনেসের মাঠ এস্তাদিও ফ্রিউলির এক টুকরো মাটি হাতে নাপোলির এক সমর্থক। মুখে বিগলিত হাসিতেই বোঝা যায়, সবুজ ঘাসওয়ালা সেই মাটির দাম তাঁর কাছে অমূল্য।

মাটির দলাটি সেই ভক্ত হয়তো স্মারক করে রাখবেন। ছেলেপুলে কিংবা নাতি-নাতনিদের কাছে গল্পের খোরাক হয়ে থাকবে। ৩৩ বছর অপেক্ষার পর উদিনেসের এই মাটিতেই যে সিরি আ জয়ের গল্প লিখেছে নাপোলি। সেই মাটির স্পর্শ না নিলে চলে!

দুঃসাহসীরা আরেক কাঠি সরেস। মাঠের ঘাসসহ মাটিই তুলে নিয়েছেন। সব উদ্‌যাপন শেষে হয়তো সে মাটি শিয়রে রেখে একটু ঘুমোবেন। কত দিন পর এই শান্তির ঘুম!

আরও পড়ুন

নাপোলির সমর্থকেরা তাই মাঠে ঢুকে পড়েছিলেন। তাদের মাঝে যেন বাচ্চাদের আবেগ ভর করছিল। বাবা কাঁদছে, সেই বাবার কোলে চড়ে ম্যাচ দেখতে আসা শিশুটিও কাঁদছে। কিশোর কিংবা বুড়োর চোখও ভেজা। সবার চোখেই আনন্দাশ্রু। ইতালির দুই শহর তুরিন এবং মিলানে সিরি আ শিরোপা গিয়েছে বেশি। নেপলসবাসী এত দিন চেয়ে চেয়ে দেখলেও দৃশ্যটা পাল্টে দিয়েছে নাপোলি। শুধু তুরিন আর মিলান কেন এখন নাপোলিকে দেখার লগ্ন তো পুরো পৃথিবীর। ইতালির দক্ষিণাঞ্চলের যে শহরটি তুলনামূলক গরিব এবং অপরাধপ্রবণ, সেই শহরে আবার ফুটবলই জীবন—এমন জায়গার একটি ক্লাব ‘এসটাবলিশমেন্ট’ এর মুখে ঝামা ঘষে পাথরে ফুল ফুটিয়েছে। মানে, ইন্টার মিলান, এসি মিলান, জুভেন্টাস নামের ‘দৈত্য’দের দঙ্গল থেকে ‘সিরি আ’ নামের আগুন চুরি করেছে।

গ্রিক পুরানের প্রমিথিউসকে মনে পড়লেও ‘চুরি’ শব্দে আপত্তি জানাতে পারেন অনেকে এবং সেটাই স্বাভাবিক। জিতেছে তো সবার চোখে চোখ রেখেই। তাহলে পাল্টা প্রশ্ন তোলা যায়, এ জয়ের আনন্দ কি প্রমিথিউস যে মানুষের জন্য আগুন চুরি করেছিলেন, তার চেয়েও বেশি?

তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো বলতেন, মানুষ নিজের সীমাবদ্ধতা নিয়েও যা করতে পারে দেবতারা তা পারেন না। সারা জীবনই তো ‘এসটাবলিশমেন্ট’কে প্রশ্ন করে গেছেন, তাই এমন কোনো বাঁকা কথাই হয়তো বলতেন। প্রাণের ক্লাবের এমন সাফল্যে আবেগে কান্নার দমক ঠেকাতে না পেরে হয়তো বলেই ফেলতেন, যেখানে ‘এসটাবলিশমেন্ট’কে ভাঙতে দেখবে সেখানেই আমাকে পাবে। আমাকে খুঁজবে প্রতিটি বিপ্লবে। কিন্তু কাল রাতে এস্তাদিও ফ্রিউলিতে তাঁকে খুঁজতে হয়নি। বরং তাঁর থাকাটা ছিল অবধারিত।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

যে শহরে তাঁর মর্যাদা ‘ঈশ্বরতুল্য’, যে শহরে তাঁর নামে ধর্ম আছে, উপাসনালয় আছে—সে শহরের মানুষ এমন আনন্দের ক্ষণে তাঁকে ভুলবে কীভাবে! কাল রাতের আগে নেপলসে শেষ যেবার রাস্তায় রাস্তায় গাড়ির ভেঁপু বেজেছে, কেউ কাউকে চেনে না কিন্তু আনন্দের আতিশয্যে জড়িয়ে ধরেছে একে-অপরকে—১৯৯০ সালে সেই উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন তিনি। নাপোলিকে সর্বশেষ তিনিই এনে দিয়েছিলেন সেই ‘আগুন।’

তারপর কেটে গেছে তিন দশকের বেশি সময়, বিস্তর পাল্টে গেছে এই পৃথিবী। মানুষ এখন যতটা আবেগী তার চেয়ে বেশি হিসেবি। কিন্তু নামটা যদি হয় ‘এল ডিয়েগো’ তাহলে নিয়াপলিতানদের কাছে আবেগের দামই বেশি। তাঁর প্রতি নিয়াপলিতানদের ভালোবাসা এতটুকু কমেনি। ২০২০ সালে কিংবদন্তির মৃত্যুর পর স্টেডিয়ামের নামই তো পাল্টে ফেলে রাখা হয়েছে ডিয়েগো ম্যারাডোনা।

উদিনেসের মাঠে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে নাপোলি। মাঠের মাটি তুলে নিলেন এক সমর্থক। সম্ভবত স্মারক হিসেবে সংগ্রহে রাখবেন
ছবি: রয়টার্স

উদিনেসের মাঠে সেই মুহূর্তটা স্মরণ করুন। নাপোলি কোচ লুসিয়ানো স্প্যালেত্তির চারপাশে জনতার ভিড়। সমর্থকেরা ছেঁকে ধরেছেন খেলোয়াড়দের। জার্সি চাই! শর্টস চাই! স্মারক করে রাখতে যা যা নেওয়া সম্ভব সব চাই! বিষয়টি এভাবে আন্দাজ করে নেওয়া গেল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ হওয়া একটি ছবি দেখে। উদিনেসের মাঠে জনতার ভিড়ের দঙ্গল থেকে বের হতে হাঁসফাঁস করছেন নাপোলির এক খেলোয়াড়। পরনে শর্টস নেই শুধু অন্তর্বাস। বোঝা যায়, জনতা স্মারক-সংগ্রহ অভিযানে কতটা মরিয়া ছিল!

শুধু একজনের ব্যানার ঘিরে কোনো ভিড় ছিল না। বরং সেই ভিড়ের মধ্যে তাঁর ছবি সংবলিত ব্যানার প্রায় সবাই তুলে ধরেছেন অন্যরকম মর্যাদায়, ভালোবাসায় আর শ্রদ্ধায়। ডিয়েগো ম্যারাডোনা!

আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির ছবি সম্ভবত নিয়াপলিতানদের ঘরে ঘরে। নাপোলির সেরা সময়ের মহানায়ককে কে ভুলবেন! তাঁর হাত ধরেই ১৯৮৭ লিগ, ১৯৮৯ উয়েফা কাপ ও ১৯৯০ সালে লিগ জিতে বিশ্বসেরা ক্লাবগুলোর কাতারে উঠে এসেছিল নাপোলি। মাঝে এই ৩৩ বছরে কত তারকা এলেন-গেলেন কেউ কথা রাখতে পারেননি। নাপোলির এর মাঝে একবার দেউলিয়া হলো, তৃতীয় বিভাগে নেমেও গেল, কিন্তু ওই যে ম্যারাডোনার জীবনের মতো ‘ভস্মাধার থেকেও উড়তে জানা এবং উড়তে উড়তে সবাই ছাড়িয়ে যাওয়া’—নাপোলিকে নিয়ে ভিক্টর ওসিমেন-খিচা কাভারাস্কাইয়ারা সেই পথে হেঁটেই আজ উড়ন্ত বলাকা।

নেপলসের স্টডিয়ামের পাশে রাস্তায় জনতার হাতে ম্যারাডোনার ব্যানার
ছবি: রয়টার্স

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নাপোলিকে নিয়ে যত পোস্ট হচ্ছে, প্রায় সবার মুখেই একটি কথা—ম্যারাডোনা নিশ্চয়ই দেখছেন! নাপোলি কোচ স্প্যালেত্তির দাবি অবশ্য অন্য কিছু। ম্যারাডোনা শুধু দেখছেন না, রক্ষাও করেছেন, করছেন এবং করবেন, ‘সমর্থকেরা গ্রেট খেলোয়াড় ও কোচদের পেয়েছে। তারা ম্যারাডোনাকে খেলতে দেখেছে আর সম্ভবত তিনি আমাদের রক্ষা করেছেন বলেই আজ এই ফল পেলাম।’

জিওভান্নি সিমিওনে ভাগ্যবান। নাপোলিতে গঞ্জালো হিগুয়েইন, এজেকুয়েল লাভেজ্জিরা খেলে গেছেন কিন্তু লিগ জেতাতে পারেননি। ম্যারাডোনার পর প্রথম আর্জেন্টাইন হিসেবে ইতালিয়ান ক্লাবটির হয়ে লিগ জিতলেন ডিয়েগো সিমিওনের ছেলে। ম্যারাডোনাকে চোখে না দেখলেও জিওভান্নি নাকি উদিনেসের মাঠে তাঁর উপস্থিতি টের পেয়েছেন, ‘নিয়াপলিতানদের মাঝে ডিয়েগো বেঁচে আছেন ঠিক আর্জেন্টাইনদের মাঝে অনুভূতিটা যেমন হয়। এই মুহূর্তটা তাই বিশেষ কিছু।’

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

নেপলস থেকে আর্জেন্টিনার দূরত্ব প্রায় ১১ হাজার ৯০০ কিলোমিটার। দুটি দেশের মানুষের চিন্তা-ভাবনা ও সংস্কৃতিতে ফারাক যথেষ্ট। কিন্তু ফুটবল দিয়ে একজন এ দুটি ভিন দেশের মানুষকে গেঁথেছেন একসূত্রে। মানুষের চোখের ভাষা ভুলে যান সেই প্রমাণ দেবে পরিসংখ্যান। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে তাদের হয়ে সর্বোচ্চ গোল করেছিলেন ম্যারাডোনা। পরের বছর নাপোলির প্রথম সিরি আ জয়েও ক্লাবটির সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন ম্যারাডোনা। ১৯৯০ সালে নাপোলির সর্বশেষ লিগ জয়েও সর্বোচ্চ গোলদাতা ম্যারাডোনা। ৩৩ বছর পর কাল রাতে নাপোলি যখন লিগ জিতল তখন পরিসংখ্যানটি অন্যরকম এক মহিমা পেয়ে যায়। নাপোলি এবারও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগের বছর বিশ্বকাপ জিতেছে আর্জেন্টিনা!

১৯৮৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা এবং পরের বছর নাপোলির চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো। পার্থক্য শুধু একটাই, যে লোকটি দুটি দেশের মানুষকে কথা বলিয়েছেন এক ভাষায়—ফুটবলের ভাষা—নাপোলির এমন আনন্দের লগ্নে তাঁকে দেখা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না, স্মরণ করতে হবে শুধু ফ্রেমবন্দী ছবিতে তাকিয়ে। নাপোলির সমর্থকদের বুকে তাই হয়তো সুখের ব্যথা বাজছে। আর ম্যারাডোনা?

তাঁর ‘বুকে’ বসেই মানে তাঁর নামে নেপলসে যে স্টেডিয়াম, সেখানে বসে নাপোলির পুর্নজন্মের চূড়ান্ত দেখেছেন প্রায় ৫৫ হাজার সমর্থক। নেপলসে উৎসবের ছবি-ভিডিওতে এখন সয়লাব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। সেই উৎসবের গভীরে তাকালেই বোঝা যায় ম্যারাডোনা মিশে নাপোলির রাস্তায়, ধুলোয়, মানুষের মনের মণিকোঠায়!

আরও পড়ুন