চলে গেলেন আর্জেন্টিনাকে প্রথম বিশ্বকাপ জেতানো কিংবদন্তি কোচ মেনোত্তি

সিজার লুইস মেনোত্তি (১৯৩৮-২০২৪)এএফপি

আর্জেন্টিনাকে ১৯৭৮ বিশ্বকাপ জেতানো কিংবদন্তি কোচ সিজার লুইস মেনোত্তি ৮৫ বছর বয়সে মারা গেছেন। আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (এএফএ) আজ তাঁর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘এক্স’ হ্যান্ডলে মেনোত্তির মৃত্যুর খবর জানিয়ে এএফএ লিখেছে, ‘আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশন অত্যন্ত শোকের সঙ্গে বর্তমান জাতীয় দলের পরিচালক ও আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী কোচ লুইস সিজার মেনোত্তির মৃত্যুর খবর জানাচ্ছে। বিদায় প্রিয় ফ্লাকো!’

আরও পড়ুন

লিওনেল মেসির জন্মশহর রোজারিওতে ১৯৩৮ সালে মেনোত্তির জন্ম। খেলোয়াড়ি জীবনে স্ট্রাইকার পজিশনে খেলা মেনোত্তি ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের হয়ে ১১ ম্যাচ খেলে ২ গোল করেন। খেলা ছাড়ার পর ৩৭ বছরের কোচিং ক্যারিয়ারে ১১টি ক্লাব ও দুটি দেশের জাতীয় দলের কোচের ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত ছিলেন নিজের দেশ আর্জেন্টিনার কোচের দায়িত্বে। ১৯৯১–১৯৯২ সালে সামলেছেন মেক্সিকো জাতীয় দলকে।

আর্জেন্টিনাকে ঘরের মাঠে ১৯৭৮ বিশ্বকাপ জিতিয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন মেনোত্তি। ছিপছিপে গড়নের জন্য ‘এল ফ্লাকো’ তকমা পাওয়া মেনোত্তি  আর্জেন্টিনাকে প্রথম বিশ্বকাপ জেতানোর পরের বছর অনূর্ধ্ব-২০ দলকেও জিতিয়েছেন যুব বিশ্বকাপ। জাপানে ১৯৭৯ সাল অনুষ্ঠিত সেই টুর্নামেন্টে সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনা। গোল্ডেন বল জিতে সেই টুর্নামেন্ট দিয়ে নিজের আগমনী বার্তা দিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার ১৯৮৬ বিশ্বকাপজয়ী দলের অধিনায়ক। ফাইনালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ৩-১ গোলে হারিয়েছিল আর্জেন্টিনা অনূর্ধ্ব-২০ দল। মেনোত্তির হাত ধরে বড়দের বিশ্বকাপের মতো যুব বিশ্বকাপও সেবারই প্রথম জিতেছিল আর্জেন্টিনা।

আরও পড়ুন

তবে আর্জেন্টাইন ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয়ে মেনোত্তি আরও একটি কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। মেনোত্তির হাত ধরেই সহিংসতাপূর্ণ খেলার কুখ্যাতি থেকে সরে এসে রোমান্টিক ধাঁচের ফুটবল খেলে সমর্থকদের মন জিতেছে আর্জেন্টিনা।

মেনোত্তির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে নিজের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের অধিনায়ক লিওনেল মেসি লিখেছেন, ‘আর্জেন্টিনার ফুটবলের অন্যতম গ্রেট আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁর পরিবার এবং প্রিয়জনদের প্রতি সমবেদনা। শান্তিতে ঘুমান।’

আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের কোচ লিওনেল স্কালোনি ইনস্টাগ্রামে শোক প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘ফুটবলের একজন শিক্ষক আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। সেই সব স্নেহ সঞ্চারক কথার জন্য ধন্যবাদ, যার মাধ্যমে আপনি আমাদের মনে ছাপ রেখে গেছেন। চিরকাল হৃদয়ে থাকবেন প্রিয়।’

দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থতায় ভুগছিলেন মেনোত্তি। লোকচক্ষুর অন্তরালে্ও ছিলেন দীর্ঘদিন। আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, মৃত্যুর আগে রক্তশূন্যতায় ভুগে প্রায় মাসখানেক হাসপাতালে ভর্তিও ছিলেন।

আরও পড়ুন

১৯৭০ সালে আর্জেন্টিনার ক্লাব নিওয়েলস ওল্ড বয়েজ দিয়ে মেনোত্তির কোচিং ক্যারিয়ার শুরু। পরের বছর দায়িত্ব নেন হুরাকানের। ১৯৭৩ সালে ক্লাবটিকে জেতান তাদের ইতিহাসে ১৯২৮ সালের পর প্রথম লিগ শিরোপা। পরের বছর দায়িত্ব নেন আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের। ব্যক্তি জীবনে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন মেনোত্তি, কিন্তু ১৯৭৬ সালে আর্জেন্টিনা সামরিক শাসনের অধীনে আসার পরও জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব চালিয়ে যান তিনি। হয়তো বড় স্বপ্ন দেখেছিলেন, আর সেটাই সত্যি হয় ১৯৭৮ সালে।

১৯৭৮ বিশ্বকাপ ফাইনালে নেদারল্যান্ডসকে ৩-১ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল মেনোত্তির আর্জেন্টিনা। মেনোত্তির হাত ধরেই এই বিশ্বকাপের আগের বছর আর্জেন্টিনা জাতীয় দলে অভিষেক ম্যারাডোনার। কিন্তু ১৭ বছর বয়সী ম্যারাডোনাকে ’৭৮ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা দলে নেননি মেনোত্তি। আর্জেন্টিনার ক্রীড়া সাময়িকী ‘এল গ্রাফিকো’কে তার কারণও ব্যাখ্যা করেছিলেন মেনোত্তি, ‘যেটা আমাকে করতেই হতো, সেটাই করেছি। তার (ম্যারাডোনা) দেখভাল করাটা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, আমি আসলে ডিয়েগোতে মুগ্ধ ছিলাম। সে ছিল একদমই তরুণ, খুবই ছোট।’

কোচিং ক্যারিয়ারে  মেনোত্তি লম্বা চুল এবং চেইন-স্মোকিং স্বভাবের কারণেও আলাদা করে স্মরণীয়। একবার বলেছিলেন, ‘আমি কখনো নাপিতের কাছে যাইনি। নিজেই নিজের চুল কাটি।’ মেনোত্তির বয়স যখন ১৬ বছর, তখন তাঁর বাবা ক্যান্সারে মারা যান। বাবার মতো তিনিও পরবর্তীতে চেইন-স্মোকার বনে যান। ধূমপানের স্বভাব নিয়েও একবার বলেছিলেন, এটা ‘একাকীত্বে আমার বন্ধু।’ তবে ২০১১ সালে ফুসফুসের অস্ত্রোপচার করানোর পর মেনোত্তি ধূমপান ছেড়ে দেন।

আরও পড়ুন

১৯৮২ বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে আর্জেন্টিনার বিদায়ের মধ্য দিয়ে মেনোত্তির দেশের জাতীয় দলের কোচিং অধ্যায়েরও সমাপ্তি ঘটে। ১৯৮৩ সালে বার্সেলোনার কোচের দায়িত্ব নিয়ে দুই মৌসুমে দুটি কাপ জেতেন মেনোত্তি। ম্যারাডোনা তখন তাঁর অধীনে বার্সাতেই খেলতেন। কে জানত, মেনোত্তি বার্সার হয়েই কোচিং ক্যারিয়ারে শেষ শিরোপা জিতবেন! তাঁর মৃত্যুতে ইনস্টাগ্রামে কাতালান ক্লাবটির বিবৃতিতে বলা হয়, ‘সাবেক কোচ সিজার লুইস মেনোত্তির মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করছে বার্সেলোনা। শান্তিতে ঘুমান।’

বার্সা অধ্যায় শেষ করে মেনোত্তি ইতালি, মেক্সিকো, উরুগুয়ের ক্লাব ফুটবলে কোচিং করিয়েছেন। ফিরেছিলেন আর্জেন্টিনার ঘরোয়া ফুটবলেও। বোকা জুনিয়র্স, রিভার প্লেট, ইন্দেপেন্দিয়েন্তের মতো আর্জেন্টিনার অন্যতম সেরা তিনটি ক্লাবের কোচের দায়িত্বও পালন করেছেন।

মেনোত্তি ফুটবল খেলার স্টাইলের সঙ্গে রাজনীতির মিল খুঁজে পেতেন। এ নিয়ে অনেক কোচের সঙ্গেই তাঁর দীর্ঘ বিবাদ ছিল। ২০০৬ সালে জার্মান সাময়িকী ‘কিকার’কে বলেছিলেন, ‘বামপন্থী ফুটবল বিনয়ী এবং জনতার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এটা ফলাফলকে সবকিছুর ওপরে রাখে না।’

আর্জেন্টিনার ক্লাব রোজারিও সেন্ট্রালের হয়ে ১৯৬০ সালে খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন মেনোত্তি। বোকা জুনিয়র্সের হয়ে জিতেছেন আর্জেন্টিনার শীর্ষ লিগ। ১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাব নিউইয়র্ক জেনারেলস ঘুরে পরের বছর যোগ দেন ব্রাজিলের সান্তোসে। ব্রাজিলের কিংবদন্তি পেলের সতীর্থ ছিলেন সেখানে।