১৮ বছর টিকে থাকা রেকর্ড ৮ মাসে ভাঙল তিনবার
মেয়েদের দলবদলের বাজারে কীভাবে এই রেকর্ডের বিবর্তন ঘটেছে এবং সামনে কী অপেক্ষা করছে, তা নিয়েই এই বিশ্লেষণ।
ক্লাব ফুটবলে ছেলেদের মতো মেয়েদের দলবদলেও যে দেদার টাকা ওড়ানো হচ্ছে, সেটির প্রমাণ ২০২৫ সাল। মেয়েদের দলবদলে সর্বোচ্চ খরচের রেকর্ড ১৮ বছর টিকে থাকলেও এ বছর আট মাস না পেরোতেই তা ভেঙেছে তিনবার।
গত জানুয়ারিতে সান ডিয়েগো ওয়েভ থেকে চেলসিতে নাম লেখান নাওমি গিরমা। এর মধ্য দিয়ে ইতিহাসের প্রথম নারী ফুটবলার হিসেবে দলবদলে ১০ লাখ ডলারের মাইলফলক করেন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ব্যাক। তাঁকে কিনতে খরচ পড়ে ১১ লাখ ডলার (১৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা)।
জুলাইয়ে সেই রেকর্ড ভেঙে দেয় আর্সেনাল। লিভারপুল থেকে ১৩ লাখ ডলারে (১৫ কোটি ৮০ লাখ) কানাডার ফরোয়ার্ড অলিভিয়া স্মিথকে নিয়ে আসে গানাররা। তাদের রেকর্ড দেড় মাসও স্থায়ী হলো না।
কদিন আগেই ১৫ লাখ ডলারে (১৮ কোটি ২৩ লাখ টাকা) যে লিজবেথ ওভায়েকে তিগরেস ইউএএনএলের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে অরল্যান্ডো প্রাইড! মেক্সিকান উইঙ্গার ওভায়েই এখন মেয়েদের দলবদল ইতিহাসের সবচেয়ে দামি খেলোয়াড়।
মেয়েদের দলবদলের বাজারে কীভাবে এই রেকর্ডের বিবর্তন ঘটেছে এবং সামনে কী অপেক্ষা করছে, তা নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে দ্য অ্যাথলেটিক।
রেকর্ডের শুরু ও বিবর্তন
মেয়েদের ক্লাব ফুটবলে দলবদলের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০০২ সালে, ব্রাজিলের সাবেক মিডফিল্ডার মিলেনে দমিঙ্গেসকে দিয়ে। দমিঙ্গেস সেই সময় ছিলেন ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি রোনালদো নাজারিওর স্ত্রী।
‘দ্য ফেনোমেনন’ খ্যাত রোনালদো ২০০২ বিশ্বকাপ জয়ের পর ইতালিয়ান ক্লাব ইন্টার মিলান ছেড়ে যোগ দেন স্প্যানিশ পরাশক্তি রিয়াল মাদ্রিদে। স্বামীকে অনুসরণ করে দমিঙ্গেসও ইতালি ছেড়ে চলে আসেন স্পেনে; ফিয়াম্মামোনৎসাকে বিদায় বলে যোগ দেন রায়ো ভায়েকানোতে। এখনকার বিনিময় হার অনুযায়ী দলবদলের অঙ্কটা ছিল ২ লাখ ৬৮ হাজার ডলার (৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা)।
তবে ভায়েকানোতে দমিঙ্গেস কোনো প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলতে পারেননি। কারণ, সেই সময় মেয়েদের স্প্যানিশ লিগে (লা লিগা ফেমেনিনো) বিদেশি খেলোয়াড়কে খেলতে দেওয়া হতো না। বিষয়টি জেনেও দমিঙ্গেসকে দলে ভেড়ায় ভায়েকানো। ক্লাবটি পরে জানায়, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে তাঁকে নিয়ে আসা হয়।
মেয়েদের পেশাদার ফুটবলে তখন সুযোগ ছিল সীমিত। তাই এই রেকর্ড ১৮ বছর টিকে ছিল। ২০২০ সালে ডেনমার্কের অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার পেরনিলে হার্ডার ৩ লাখ ১৫ হাজার ৫২৫ ডলারে ভলফ্সবুর্গ থেকে চেলসিতে যোগ দিলে রেকর্ড ভেঙে যায়।
দলবদলের বাজারে উত্থান
হার্ডারের পর থেকে মাত্র পাঁচ বছরে ছয়বার দলবদলে সর্বোচ্চ খরচের রেকর্ড ভেঙেছে এবং খেলোয়াড়ের দাম বেড়েছে চার গুণ।
ইংল্যান্ডের পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়া অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ক্রিস্টিনা ফিলিপু বলেছেন, ‘মেয়েদের ফুটবলের দলবদলে এখন রীতিমতো বিস্ফোরণ ঘটছে। সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে নারী ফুটবলে এখন অনেক বেশি অর্থ আসছে এবং ক্লাবগুলো এটিকে ব্যবসা হিসেবে গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে। ব্র্যান্ডগুলো এখন নারী দর্শকদের গুরুত্ব দিচ্ছে, যা নারী ফুটবলে অর্থের প্রবাহ অনেক বাড়িয়েছে এবং বাজারে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে।’
শুধু রেকর্ড ভাঙার ক্ষেত্রেই নয়, সাধারণ দলবদলেও ব্যয় ব্যাপক বেড়েছে। গত বছর জাম্বিয়ান স্ট্রাইকার বারব্রা বান্দার অরল্যান্ডো প্রাইডে নাম লেখানোর ফি-ই রেকর্ড হতে পারত, যদি–না এর কদিন আগে তাঁর স্বদেশি র্যাচেল কুন্দানাঞ্জি বে এফসিতে যোগ দিতেন। এ বছর অ্যালাই সেন্টনরকে আনতে কানসাস সিটি কারেন্ট ৬ লাখ ডলার (৭ কোটি ২৯ লাখ টাকা) খরচ করেছে, যা দুই বছর আগে হলে মেয়েদের দলবদলে সর্বকালের সর্বোচ্চ দাম হতো।
কোন ক্লাব এত অর্থ ঢালছে
সব ক্লাবের পক্ষে খেলোয়াড় কেনার পেছনে এত খরচ করা সম্ভব নয়। মিলেনে মিঙ্গেসের পর থেকে মাত্র পাঁচটি ক্লাব এই বিশ্ব রেকর্ড গড়েছে। এর মধ্যে চেলসিই তিনবার। বার্সেলোনা, অরল্যান্ডো প্রাইড, আর্সেনাল ও বে এফসি একবার করে।
চেলসি ও বার্সেলোনা টানা ছয়বার ঘরোয়া লিগ জিতেছে। আর্সেনাল বর্তমানে মেয়েদের চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপাধারী আর যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাব অরল্যান্ডো প্রাইড গত বছর মেয়েদের জাতীয় সকার লিগের শিল্ড ও চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছে। শুধু বে এফসি ব্যতিক্রম। তারা এখনো লিগ পয়েন্ট তালিকার তলানির দিকের দল।
ক্রিস্টিনা ফিলিপুর মতে, মাত্র কয়েকটি ক্লাবের এমন ব্যয় করতে পারার সামর্থ্য মেয়েদের ফুটবলের জন্য কিছু উদ্বেগজনক, ‘টাকার জোরে হাতে গোনা কিছু ক্লাব প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে চাইলে তা লিগের ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারে। দর্শক টানতে হলে লিগে অনিশ্চয়তাও থাকা জরুরি।’
বিক্রেতা ক্লাব ও নতুন বাজার
ভালো খবর হলো, খেলোয়াড় বিক্রি করা ক্লাবগুলোর মধ্যে বৈচিত্র্য বাড়ছে। লা লিগা ফেমেনিনো এখন প্রতিভার চারণভূমি হয়ে উঠেছে, যেখান থেকে কুন্দানাঞ্জি ও মায়রা রামিরেজকে কেনা হয়েছে।
ইউরোপীয় ক্লাবগুলোর মধ্যে চারটি রেকর্ড দলবদল হলেও একমাত্র অলিভিয়া স্মিথ ব্যতিক্রম। তাঁর দলবদল হয়েছে ইংল্যান্ডের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের মধ্যে। তিনি লিভারপুল থেকে আর্সেনালে যোগ দেন।
লিজবেথ ওভায়ের বিশ্ব রেকর্ড গড়ে ক্লাব পাল্টানোয় তিগরেস প্রথম অ–ইউরোপীয় ও যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের প্রথম ক্লাব, যারা সবচেয়ে বেশি দলবদল ফি পেয়েছে।
কোন দেশের খেলোয়াড়েরা এগিয়ে
দলবদলের রেকর্ডে ইউরোপীয় ক্লাবগুলো আধিপত্য দেখালেও খেলোয়াড়দের বেশির ভাগ এসেছেন উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার মহাদেশ থেকে। গিরমা যুক্তরাষ্ট্রর, স্মিথ কানাডার, ওভায়ে মেক্সিকোর, তারসিয়ানে ব্রাজিলের, রামিরেজ কলম্বিয়ার। আবার কুন্দানাঞ্জি আফ্রিকার দেশ জাম্বিয়ার।
সামনে কী অপেক্ষা করছে
ক্রিস্টিনা ফিলিপু মনে করেন, সাত অঙ্কের ডলার, ইউরো বা পাউন্ডের দলবদল ফি অদূর ভবিষ্যতে নিয়মিত ব্যাপার হয়ে উঠবে। বিনিয়োগ বাড়ার পাশাপাশি খেলোয়াড়দের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিও এর পেছনে ভূমিকা রাখবে। কারণ, ক্লাবগুলোর কাছ থেকে খেলোয়াড় ছাড়িয়ে নিতে বেশি অর্থ দিতে হবে।
তবে বাজেট থাকা সত্ত্বেও কিছু ক্লাব হয়তো বেশি ব্যয় করতে চাইবে না। এর কারণ ব্যাখ্যায় ফিলিপু বলেছেন, ‘যেসব ক্লাব মেয়েদের ফুটবলে নিয়মিত বিনিয়োগ করছে, তারা এখন নিজস্ব একাডেমি আছে ও প্রতিভাবানদের উন্নয়নকাজে অনেক এগিয়েছে। তাই তাদের বড় অঙ্কের বিনিময়ে কাউকে চুক্তি করানোর দরকার নেই, বরং কিছু জায়গায় টুকটাক পরিবর্তন আনলেই যথেষ্ট।’
ফিলিপু একটি সতর্কবার্তাও দিয়েছেন, ‘মেয়েদের ফুটবলে আর্থিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা এখনো ছেলেদের মতো কড়াকড়ি নয়। তবে সামনে কড়াকড়ি হতে পারে। তখন দলবদলের খরচের পরিমাণ কমতে পারে।’