৩২ দলের ২৯টিরই গোলকিপার ৩ জন করে। কিন্তু এত কমে (!) ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারেনি সুইজারল্যান্ড, তিউনিসিয়া আর ইরান। তিনটি দেশই বিশ্বকাপে নিয়ে গেছে চারজন গোলকিপার। নিন্দুকেরা টিপ্পনী কাটে, অতি রক্ষণাত্মক ফুটবলের চিন্তা থেকেই নাকি এত গোলকিপার। তবে ইরান চাইলে রসিকতার ছলে আপত্তি জানাতে পারে। দলটির ১ নম্বর গোলরক্ষক আলীরেজা বেইরানভন্দ ঠিক গোলকিপার নন, ফরোয়ার্ড!
ডিফেন্ডারকে মিডফিল্ডার বলে চালিয়ে দেওয়া যায়, মিডফিল্ডারকে ফরোয়ার্ড; কিন্তু গোলকিপার কীভাবে ফরোয়ার্ড হন? মাঠের এ–মাথা ও–মাথার ব্যবধান বলে কথা!
আলীরেজা আসলে গোলপোস্টই সামলান। থাকেন নিজেদের বক্সের ভেতর। তবে ৩০ বছর বয়সী এই গোলকিপারকে ফরোয়ার্ড হিসেবে ভেবে নিতে পারে প্রতিপক্ষ। রক্ষণভাগে জমাট হয়ে থাকা ইরানকে হঠাৎ আক্রমণে তুলে আনার সামর্থ্য যে আলীরেজার ভালোমতোই আছে, সেটা কীভাবে?
লম্বা থ্রোয়ের মাধ্যমে। বল থ্রোয়িংয়ে অসামান্য দক্ষতা আছে আলীরেজার। দেখা গেল, প্রতিপক্ষের আক্রমণ সামলাতে গিয়ে দলের সবাই নিচে নেমে এসেছেন। ঢুকে গেছেন নিজেদের অর্ধে। ওই সময় আচমকাই হাতের থ্রোয়ে বল প্রতিপক্ষের সীমানায় পাঠিয়ে দিতে পারেন আলীরেজা। ভালো ‘ফিনিশিং’য়ে গোলও পেয়ে যেতে পারে দল। ইরানের ক্লাব ফুটবলে এমনটা কিন্তু অনেকবারই ঘটেছে।
একজন গোলকিপারের এমন থ্রোয়ার হয়ে ওঠার পেছনে আছে সংগ্রামী এক জীবনের গল্প। ইরানের সারাব–ই–ইয়াসে জন্ম আলীরেজার। যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠার সময় রাখাল হয়ে পশু চরাতে হতো তাঁকে। সেই সময়ে দুটি খেলা ছিল কিশোর আলীরেজার খুব প্রিয়। একটি ফুটবল, আরেকটি ‘দাল পারান’। দাল পারান হচ্ছে, কে কত দূরে পাথর ছুড়ে মারতে পারে, সেই খেলা। ছেলেবেলার সেই পাথর ছোড়ার খেলাটিই পরে ফুটবলে ভীষণ কাজে লাগে আলীরেজার।
অবশ্য ফুটবলার হওয়ার কাজটিও সহজ ছিল না। ফুটবল খেললে পেট ভরবে না বলে বাবা তাঁর খেলা পছন্দ করতেন না। খেলার টানে তাই নিজের এলাকা ছেড়ে তেহরানে চলে গিয়েছিলেন তিনি। কেউ ছিল না রাজধানী শহরে। বেঁচে থাকার তাগিদে আলীরেজা কখনো রাস্তার পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করেছেন, কখনো রাতের পাহারাদারের চাকরি নিয়েছিলেন তিনি। পরে গাড়ি ধোয়ার কাজ আর পিৎজার দোকানের কর্মীও ছিলেন আলীরেজা। চাকরির বাকি সময়টা কাটাতেন ঘুম আর ফুটবল ক্লাবে অনুশীলন করে।
একপর্যায়ে নাফত–ই–তেহরান ক্লাবে স্থায়ী হবার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি আলীরেজাকে। ২০১০ সালে ইরান অনূর্ধ্ব–২০ আর ২০১২ সালে অনূর্ধ্ব–২৩ দলের সিঁড়ি ধরে তিনি জাতীয় দলে ডাক পেয়ে যান ২০১৪ সালে।
আলীরেজা অনেক দূরত্বে বল ছুড়ে মারার সামর্থ্য দেখিয়েছেন জাতীয় দলেই। ২০১৬ সালে রাশিয়া বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে ৬১ দশমিক ২৬ মিটার দূরত্বে বল ছুড়ে মারেন তিনি। সবচেয়ে বেশি দূরত্বে বল ছোড়ার রেকর্ড হিসেবে এটি গিনেস ওয়াল্ড৴ রেকর্ডসে জায়গা করে নেয়। ২০১৮ বিশ্বকাপে মাঠে নেমে অবশ্য নিজের আসল সামর্থ্যেরও দারুণ জানান দিয়েছিলেন। গ্রুপ পর্বে ইরান–পর্তুগাল ম্যাচে রুখে দেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পেনাল্টি শট।
এবারের বিশ্বকাপে আলীরেজাদের প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র ও ওয়েলস। গ্রুপ ফেবারিট ও ১৯৬৬ সালের চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লড়াইটা আগামীকাল। গ্যারেথ সাউথগেটের দল সাধারণত আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলে। রক্ষণাত্মক ইরানের বিপক্ষে চাপিয়ে খেলার পথেই হাঁটার কথা হ্যারি কেইন–মার্কাস রাশফোর্ডদের। কিন্তু আলীরেজা যদি আচমকাই থ্রোয়ার হয়ে ‘ফরোয়ার্ড’ হয়ে ওঠেন, তখন?