এস্তেভাও উইলিয়ান: ব্রাজিলকে বিদায় বললেন ৪৯১ কোটি টাকার রত্ন
ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপে পালমেইরাসের বিদায়ের মধ্য দিয়ে এস্তেভাও উইলিয়ানের ব্রাজিল–অধ্যায়ও আপাতত শেষ হলো। চেলসিতে দেখা যাবে এই উঠতি প্রতিভাকে।
ছেলেটির আদর্শ নেইমার, কিন্তু খেলার ধাঁচ লিওনেল মেসির মতো।
নাইকি তার সঙ্গে স্পনসরচুক্তি করে যখন, তার বয়স মাত্র ১০ বছর। পেলে–গারিঞ্চা থেকে রোনালদো–রোনালদিনিওদের দেশের ফুটবল ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে নাইকির সঙ্গে চুক্তি করা নিশ্চয়ই চাট্টিখানি কথা নয়! ভেতরে অবশ্যই কিছু থাকতে হয়। আর যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ক্রীড়া সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক এ প্রতিষ্ঠান যে ভুল করেনি, সেটা চার বছর পরই বুঝিয়ে দেয় ছেলেটি। যোগ দেয় ব্রাজিলের অন্যতম বড় ক্লাব পালমেইরাসে। পেশাদার ফুটবলে অভিষেক দুই বছর পরই, মাত্র ১৬ বছরে!
প্রতিভাবান ফুটবলার–প্রসবাভূমি ব্রাজিলে তাকে প্রথম আবিষ্কার করেছিল ক্রুজেইরোর স্কাউটরা। তাদের অনূর্ধ্ব–৯ দলে প্রথম সবার নজরে পড়ে ছেলেটি। ক্রুজেইরোর স্কাউটরা পাকা জহুরির মতো রত্ন চিনতে পেরে তার পরিবারকে সাও পাওলো থেকে বেলো হরাইজন্তেতে (ক্রুজেইরো সেখানকার ক্লাব) নিয়ে গিয়েছিল। এস্তেভাও উইলিয়ানের বাকিটা এত দিনে প্রায় সবারই জানা।
ক্রুজেইরোর একাডেমিতে সকালে যেতে হতো স্কুলে। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর অনুশীলন, কখনো আবার একটু অবসর, তখন করতে হতো স্কুলের হোমওয়ার্ক। আর সন্ধ্যায় স্কুলের ফুটসাল দলের হয়ে অনুশীলন। ১৩ বছর বয়সে এস্তেভাও ফুটবল কিংবা ফুটসালে এতটাই ভালো ছিল যে স্কুলের অনূর্ধ্ব–১৫ দলের কোচ আন্তোনিও অগাস্তো তাকে বড়দের সঙ্গে খেলাতে নিজের দলে ডেকে নেন, ‘তার বয়সে যেটা স্বাভাবিক, সে তার চেয়েও অনেক এগিয়ে। উদ্ভাবনী বুদ্ধির পাশাপাশি খুব তীক্ষ্ণ, বলের ওপর দখলও খুব ভালো—অনেকটাই মেসির খেলার মতো।’
মেসির মতো এস্তেভাও–ও বাঁ পায়ের ফুটবলার, মেসির মতোই খেলে রাইট উইংয়ে। ‘মেসিনিও’—নামটাও সতীর্থদের কাছ থেকে সে পেয়েছে ক্রুজেইরোয়। কেউ কেউ ‘লিটল মেসি’ বলেও ডাকতেন। তবে ব্রাজিলের কোনো প্রতিভার নামকরণ করা হবে তাদের চির প্রতিদ্বন্দ্বীদের দেশের সেরা খেলোয়াড়ের নামে—এটা ব্রাজিলিয়ানদেরই পছন্দ না। ব্রাজিলিয়ান সংবাদমাধ্যম থেকে এই নামটি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার পর ‘গ্লোবো স্পোর্তে’র সংবাদকর্মী ক্যামিলা আলভেস গত বছর জুনে জানিয়েছিলেন, ‘সে (মেসিনিও) নামটি ব্যবহার করে না। এখানে আমরা তাকে এই নামে ডাকি না।’
কিন্তু এস্তেভাও নিজে জানিয়েছেন, তাঁর খেলা মেসির মতো। এই তো গতকালই তাঁর সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম ‘এএস’। ১৮ বছর বয়সী এস্তেভাও সেখানে বলেছেন, ‘মেসির খেলার সঙ্গে নিজের মিল খুঁজে পাই, যে শুধু ফুটবল খেলতে চায় এবং পরিবার আছে, যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’
পরিবারই যেহেতু এস্তেভাওয়ের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সামনের মৌসুমে তাই একটি চ্যালেঞ্জও নিতে হবে তাঁকে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে পরিবারকে ছেড়ে একাই ইংল্যান্ডে থাকবেন নাকি পরিবার নিয়েই যাবেন স্টামফোর্ড ব্রিজে।
ইউরোপিয়ান ফুটবলের খবরাখবর রাখলে নিশ্চয়ই এতটুকু তো জানা, গত বছর জুনে ৩ কোটি ৪০ লাখ ইউরোয় তাঁকে দলে টেনেছে চেলসি। তবে শর্ত ছিল ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে এস্তেভাও ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবটির হয়ে মাঠে নামতে পারবেন না, যেটা তিনি পূর্ণ করেছেন গত এপ্রিলে। আর পালমেইরাস চেলসির কাছে দাবি রেখেছিল, ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ শেষে তিনি যোগ দেবেন চেলসিতে, যেটা ব্রাজিলিয়ান ক্লাবটির জন্য শেষ হলো গতকাল সকালে।
ফিলাডেলফিয়ার লিংকন ফিন্যান্সিয়াল স্টেডিয়ামে কোয়ার্টার ফাইনালে চেলসির মুখোমুখি হয়ে ২–১ গোলে হেরেছে পালমেইরাস। ম্যাচটি এস্তেভাওয়ের জন্য ছিল নিজের অতীত ও বর্তমানের হয়ে ভবিষ্যতের মুখোমুখি হওয়া, যেখানে দুই দলেরই আশা পূরণ করেছেন এস্তেভাও।
পালমেইরাসের হয়ে গোল করেছেন এস্তেভাও। যে গোলে আসলে খুশিই হয়েছেন চেলসি কোচ এনজো মারেস্কা, ‘রাতটা পারফেক্ট। আমরা জিতেছি এবং সে গোল করেছে।’ আর এই গোলে চেলসি ভাবতেই পারে, ৩ কোটি ৪০ লাখ ইউরো (৪৯১ কোটি ২৩ লাখ টাকা) তাঁরা জলে ফেলেনি।
দক্ষিণ আমেরিকার উঠতি প্রতিভা এর আগেও কিনেছে চেলসি। গত বছর জুনে ‘দ্য অ্যাথলেটিক’ জানিয়েছিল, গত ২৫ বছরে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ থেকে এমন ৯ জন উঠতি প্রতিভা কিনেছে চেলসি, তাঁদের মধ্যে শুধু অস্কারই এ পর্যন্ত তারকা হয়ে বের হতে পেরেছেন স্টামফোর্ড ব্রিজ থেকে।
এরপর কি এস্তেভাও? সময়ই তা বলে দেবে। আপাতত আশা করতে কী দোষ!
কোল পালমারও সেই আশাতেই মজেছেন। চেলসির এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার কাল রাতে ম্যাচ শেষে আরও কয়েকজন সতীর্থকে নিয়ে ঘিরে ধরেছিলেন এস্তেভাওকে। হাসিমুখে ভবিষ্যৎ সতীর্থের সঙ্গে কথা বলেছেন তাঁরা। পরে মিক্সড জোনে পালমারের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, কী কথা হলো তাঁর সঙ্গে? পালমারের জবাব শুনে হেসে ফেলতে পারেন, ‘এস্তেভাও খুব উঁচুমানের খেলোয়াড়। আমরা সবাই তা দেখেছি। তাকে বলেছি আমরা তোমার যোগ দেওয়ার অপেক্ষায় আছি। কিন্তু সে আমার একটি কথাও বুঝতে পারেনি (এস্তেভাও পর্তুগিজ ভাষায় কথা বলেন)।’
মুখের ভাষা যেহেতু এক নয়, তা না বোঝাই স্বাভাবিক। তবে ফুটবলের ভাষাটা পৃথিবীর সব জায়গাতেই একই রকম। এস্তেভাও সেই ভাষাতেই বুঝিয়েছেন, তিনি কোন জাতের খেলোয়াড়। ১৬ মিনিটে পালমারের গোলের পর ৫৩ মিনিটে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
মিডফিল্ডার রিচার্ড রিওস ডান প্রান্তের এক কোনা থেকে পাস দেন বক্সে দাঁড়ানো এস্তেভাওকে। গায়ের সঙ্গে সেঁটে থাকা চেলসির ডিফেন্ডারকে সামনে আরেকটু টেনে নিয়ে যান, তাতে ডান পাশের পোস্ট দিয়ে গোল করা খুব কঠিন হয়ে যায়। কোণটা খুব দুরূহ ছিল তবে প্রতিভাবান বলেই ওই দুরূহ কোণ দিয়েই ডান পায়ের শট নেন এস্তেভাও। বল বুলেট গতিতে পোস্টে লেগে ঢুকে পড়ে জালে। গোলটি দেখে কারও কারও ’৮৮ ইউরোয় মার্কো ফন বাস্তেনের সেই ভলি মনে পড়তে পারে। এস্তেভাও ভলি করেননি, তবে কোণটা প্রায়ই একই রকম কঠিন ছিল। কিংবা ’৯৮ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ডেনিস বার্গক্যাম্পের গোলও মনে পড়তে পারে। সেটাও খুব কঠিন কোণ থেকে করা গোল ছিল।
এস্তেভাওয়ের ওই গোলে যেমন আত্মবিশ্বাসের স্ফুরণ, ঠিক একই ছটা বোঝা যায় তাঁর মুখের কথাতেও। লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোদের জমানা তো শেষের পথে। একদম উঠতিদের মধ্যে ১৭ বছর বয়সী লামিনে ইয়ামাল এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠিত তারকা—তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিতে বিশ্লেষকেরা এরই মধ্যে আর্জেন্টিনার ১৭ বছর বয়সী উইঙ্গার ফ্রাঙ্কো মাস্তানতুয়োনোর নামটা বারবার টেনে আনছেন। গত মাসেই তাঁকে রিভার প্লেট থেকে দলে ভেড়ায় রিয়াল মাদ্রিদ। এস্তেভাও এ দুজনের সঙ্গেই পাল্লা দিতে চান। কিসের পাল্লা? ব্যালন ডি’অর!
এএস–কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এস্তেভাও সে কথাই বলেছেন। জানতে চাওয়া হয়েছিল, ভবিষ্যতে ইয়ামাল ও মাস্তানতুয়াতোর সঙ্গে ব্যালন ডি’অর জয়ের লড়াইয়ে তাঁকে দেখা যাবে কি না? উত্তর শুনুন এস্তেভাওয়ের মুখেই, ‘খুব করে সেটাই আশা করি। আমাদের বয়স একই। ওই জায়গায় নিজেদের দেখাটা হবে অবিশ্বাস্য ব্যাপার।’
পালমেইরাসকে এরই মধ্যে বিদায় জানিয়েছেন এস্তেভাও। বলেছেন, ‘সবাই সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টার পরও না পারায়’ তাঁর ‘হৃদয়টা বিদীর্ণ হয়েছে।’ এস্তেভাওকে বিদায় জানাতে গিয়ে নিশ্চয়ই পালমেইরাস সমর্থকদের হৃদয়েও পোড়া পোড়া ধোঁয়া উড়েছে। হ্যাঁ, দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ইউরোপে রপ্তানি হলেন আরও এক প্রতিভা।
ফুল হয়ে এখন ফোটে কি না, সেটাই দেখার অপেক্ষা।