একজন ‘বাংলাদেশপ্রেমী’ জর্জ কোটানকে ভোলা যাবে না কখনোই

বাংলাদেশ ফুটবল দলের সাবেক কোচ জর্জ কোটানছবি: জর্জ কোটানের ফেসবুক পোস্ট থেকে

ভিনদেশি হলেও বাংলাদেশের ফুটবলের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন তিনি। একেবারে গভীরভাবে। ফুটবলারদের ভীষণ ভালোবাসতেন। আর চাইতেন বাংলাদেশের ফুটবল উঠে দাঁড়াক। সেই চেষ্টায় সফলও হয়েছিলেন। তাঁর হাত ধরেই ঢাকায় ২০০৩ সালে প্রথমবার বাংলাদেশ ফুটবল দল সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতে।

দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে শ্রেষ্ঠত্বের মালা সেই একবারই গলায় পরা হয়েছে লাল–সবুজের ফুটবলারদের। সেই অনন্য সাধারণ সাফল্যের নেপথ্য কারিগর বাংলাদেশ ফুটবল দলের সাবেক কোচ জর্জ কোটান চলে গেলেন না ফেরার দেশে। ৭৭ বছর বয়সে। আর কখনো আসবেন না বাংলাদেশে। কখনো আর প্রিয় ফুটবলারের কাঁধে হাত রেখে পিতৃস্নেহে দেবেন না নানা পরামর্শ। কোচ ছাপিয়ে হয়ে উঠবেন না একজন অভিভাবক।

জর্জ কোটানের মৃত্যুর কথা জানিয়ে আজ সকালে তাঁরই সাবেক শিষ্য বাংলাদেশ ফুটবল দলের সাবেক গোলরক্ষক বিপ্লব ভট্টাচার্য ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন। তাতে তিনি লিখেছেন, ‘তোমার চলে যাওয়া বিশ্বাস করতে পারছি না প্রিয় কোচ। তুমিই আমাদের শিখিয়েছ সাফল্য পেতে একে অন্যের প্রতি আস্থা রাখতে হবে। একটা দল হিসেবে খেলতে হবে। তুমি তোমার খেলোয়াড়দের উজ্জীবিত করতে এবং সবার প্রতি সবার সম্মান ছিল। যার ফসল হিসেবে ২০০৩ সালে আমরা সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। আমি ভাবতেই পারছি না তুমি আমাদের ছেড়ে চলে গেছ এবং চলে গেছ সেখানে, যেখান থেকে কেউ আর ফিরে আসে না। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি তোমার পরিবার যেন এই শোক সইতে পারে। ভালো থেকো প্রিয় কোচ। তোমার আত্মা শান্তি লাভ করুক।’

বাংলাদেশ দলের সাবেক কোচ জর্জ কোটান (মাঝে)
ছবি: জর্জ কোটানের ফেসবুক পোস্ট থেকে

কিন্তু অন্য কোনো মাধ্যম থেকে কোটানের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না। তবে কোটানের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে গিয়ে দেখা যায় তাঁকে নিয়ে একটা পোস্ট করা হয়েছে পরিবারের পক্ষ থেকে। সেখানে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করা হয়। এরপর যোগাযোগ করা হলে হাঙ্গেরি জাতীয় দলের প্রেস অফিসার জর্জ জাবো ফোনে প্রথম আলোকে কোটানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেছেন, ‘এটা খুব দুঃখের যে জর্জ কোটান আর নেই। বুদাপেস্টে তিনি ২৫ সেপ্টেম্বর মারা গেছেন।’

আরও পড়ুন

৬ অক্টোবর হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। ৬ অক্টোবর কেন? কারণ, ১৯৪৬ সালের ৬ অক্টোবর তিনি জন্ম নিয়েছিলেন বুদাপেস্টে। জন্মদিনেই তাঁকে সমাহিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরিবার। জীবনের এ–ও এক দিক। যেদিন পৃথিবীতে এসেছিলেন, ঠিক ৭৭ বছর পর সেই দিনেই তাঁর নশ্বর দেহ পাড়ি জমাবে অনন্তলোকে।

কিন্তু তিনি যেখানেই থাকুন, বাংলাদেশের ফুটবলারদের মনে শ্রদ্ধার আসনে থাকবেন। তাঁকে একটু বেশিই মনে রাখবেন জাতীয় দলের সাবেক গোলকিপার আমিনুল হক। ২০০৩ সাফের আগে চোটগ্রস্ত আমিনুলকে ফিট করে তোলেন কোটান। তাঁকে বাড়তি অনুশীলন করাতেন। সেই আমিনুলই সাফ জেতায় রাখেন অগ্রণী ভূমিকা। এভাবে অনেক ফুটবলারকেই তিনি নতুন জীবন দিয়েছেন। মাঠে ফিরিয়ে সেরাটা আদায় করে নিয়েছেন।

জর্জ কোটানের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করা কোটানের মৃত্যু সংবাদ
ছবি: জর্জ কোটানের ফেসবুক পোস্ট থেকে

বাংলাদেশ ফুটবল দলের দীর্ঘদিনের সহকারী মোহাম্মদ মহসিনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল কোটানের। সেই মহসিন কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন, ‘গত জুনে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে যাওয়ার আগেও তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি। তখন বলেছিলেন শরীরটা খারাপ। এরপর তাঁকে ফোন-মেসেজ পাঠালেও আর সাড়া পাইনি। আজ তাঁর ছেলেকেও ফোন করেছি। কিন্তু কোনো সাড়া নেই। যত দূর জানি কোটান আর নেই। বাংলাদেশের ফুটবলে কোটান যা দিয়ে গেছেন তার কোনো তুলনা হয় না।’

আরও পড়ুন

জর্জ কোটান এমন একজন মানুষ ছিলেন, প্রতিটি ক্ষণ কাজে লাগানো ছিল যাঁর নেশা। ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখতেন চারপাশ। পেশাদার সাংবাদিকদের মুহূর্তে আপন করে নিতেন। কোনো ভেদাভেদ ছিল না। বন্ধুর মতো মিশতেন। নানা কথা বলতেন, উপদেশ দিতেন।

২০০০-২০০৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচ ছিলেন জর্জ কোটান। এই সময়ে সাফ জিতিয়েছেন বাংলাদেশকে। সাফ ফাইনালের আগের দিন তখনকার হোটেল শেরাটনে টিম মিটিংয়ে কোটান ফুটবলারদের বলেছিলেন, ‘মনে করো, তুমি তোমার এক বন্ধুকে হারিয়েছ। ও ছিল তোমার অনেক প্রিয়। ফাইনালটা বন্ধুর জন্য খেলো। ওকে কিছু দেওয়ার চেষ্টা করো। তাতে দেশকেও কিছু দেওয়া হবে তোমার।’

কোটানের কথাগুলো অনুপ্রাণিত করেছিল আমিনুল, সুজন, নজরুল, হাসান আল মামুনদের। মালদ্বীপের সঙ্গে ফাইনালটা অতিরিক্ত সময় শেষেও ১-১। তারপর টাইব্রেকারএ ৫-৩ গোলে জিতে বাংলাদেশের জয়োল্লাস। কোটানকে সেদিন মাথায় তুলে নিয়েছিলেন ফুটবলাররা।

আরও পড়ুন

অমন সাফল্য দেওয়ার পরও বাফুফের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় কোটান ফিরে গিয়েছিলেন। তবে এরপরও তিনি বারবার এই বাংলায় ফিরে এসেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রের কোচ হয়ে এসেছেন। পাকিস্তান জাতীয় দলের কোচ হিসেবেও তাঁকে দেখা গেছে ২০১০ ঢাকা এসএ গেমসে। সর্বশেষ ২০১৫-১৬ সালে আসেন ঢাকা আবাহনীর কোচ হয়ে। সে সময়ের একটা ছবিতে এখনো চোখ আটকে যায়। আবাহনী মাঠে মেশিনে চেপে ঘাস কাটছেন কোটান। মাঠটাকে নিজের উপাসনালয় ভাবতেন তিনি। তাই তো অবসর সময়টাও কাজে লাগাতেন। এটা–ওটা করতেন। সবকিছু যেন নিজের বাড়ির মতো।

আবাহনী মাঠে জর্জ কোটানের সেই ঘাস কাটার ছবি
ছবি: প্রথম আলো

জন্ম হাঙ্গেরিতে হলেও অস্ট্রিয়ায় আবাস গড়েছিলেন কোটান। ঢাকায় সাফ জিতে ফিরে গিয়ে ভিয়েনার বাড়ির দেয়ালে টানিয়ে রেখেছিলেন বাংলাদেশের পতাকা। সে কথা তিনি ঢাকায় ফিরে বলেছিলেন এই প্রতিবেদককে। বলেছিলেন, বাংলাদেশকে বুকের ভেতর লালন করেন। তাঁকেও বাংলাদেশের ফুটবল আপনজন মনে করে। এ দেশে কাঁড়ি কাঁড়ি ডলারের বিদেশি কোচ এসেছেন। পেশাদারি পোশাক ছেড়ে বের হতে পারেননি অনেকেই। কিন্তু কোটান পেরেছেন। পেরেছেন বলেই তাঁর চিরবিদায় ব্যথিত করছে দেশের ফুটবলকে।

ভারতের চার্চিল ব্রাদার্সের কোচ ছিলেন, কাজ করেছেন ফিফার গোল প্রজেক্টে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে কোটান ছিলেন বিপ্লব-আমিনুলদের চ্যাম্পিয়ন কোচ। যাঁর কাছ থেকে এ দেশের ফুটবল ও ফুটবলাররা নিয়েছেন দুহাত ভরে। আজ আর তিনি নেই। জর্জ কোটানের অমর স্মৃতির প্রতি রইল বেদনাবিধুর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

আরও পড়ুন