আর্জেন্টিনার ১০০ বছরের এক ‘বোকা’ ভক্তের গল্প

বোকা জুনিয়র্সের জার্সি পরে আন্তোনিও রোমান মেন্দেজলা নাসিওন

ভক্ত কেমন হয়?

এক আর্জেন্টাইনের উদাহরণ দেওয়া যায়। লোকটির নাম আন্তোনিও রোমান মেন্দেজ। তাঁর ছেলের নাম আরমান্দো। বাবা ও ছেলের নামের মধ্যেই বোকা জুনিয়র্সের ইতিহাসের বড় একটা অংশ ধারণ করা যায়।

আন্তোনিও রোমান মেন্দেজ—এই নামের প্রথম অংশটুকু শুনে আপনার মতে পড়তে পারে ১৯৫৬ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত বোকায় খেলা ক্লাবটির কিংবদন্তি আন্তোনিও র‌্যাটিনকে। রোমান—নামটি শুনে মনে পড়তে পারে বোকার বর্তমান সভাপতি ও ক্লাবটির কিংবদন্তি হুয়ান রোমান রিকেলমেকে। আর আর্মান্দো? সেখানেও আছে ঐতিহাসিক সংযোগ। সত্তর দশকে বোকাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি পাইয়ে দেওয়া ক্লাবটির কিংবদন্তি সভাপতি ছিলেন ‘এল পুমা’খ্যাত আলবার্তো আরমান্দো। তাতেও সন্তুষ্ট না হলে জেনে নিতে পারেন, বোকার আরেক কিংবদন্তি ম্যারাডোনার পুরো নাম ডিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা!

আরও পড়ুন

ভাবতে পারেন, বোকাকে প্রচণ্ড ভালোবাসেন বলেই হয়তো আন্তোনিও রোমান মেন্দেজ নামের এ ভক্ত ক্লাবের খেলোয়াড় ও সভাপতি মিলিয়ে নিজের ও ছেলের নাম রেখেছেন। ভুল। এই ভালোবাসার সংযোগ আসলে কাকতালীয়। মনে হতে পারে দৈব কোনো সংযোগ আছে!

শুনুন তাহলে—আন্তোনিওর বয়স যখন ২৯ বছর, আরমান্দো তখন বোকার সভাপতি হন। তাঁর ৩১ বছর বয়সে র‌্যাটিনের অভিষেক হয় বোকার জার্সিতে। আর রিকেলমে জন্ম নেন তাঁর বয়স যখন ৫১ বছর। ২০০০ সালে রিকেলমে যখন বোকার হয়ে প্রথম কোপা লিবার্তোদোরেস জেতেন, আন্তোনিও রোমান মেন্দেজের বয়স তখন ৭৪ বছর। আপাদমস্তক বোকার এই সমর্থক যেন ক্লাবটির ‘জীবন্ত’ এক ইতিহাস!

১৯৪০ সালে বোকার লা বোমবোনেরা স্টেডিয়াম উদ্বোধনের সময় বুয়েনস এইরেসে ছিলেন আন্তোনিও। আর্জেন্টিনার রাজধানী শহরটিতে তত দিনে তাঁর বসবাস পাঁচ বছর হয়ে গেছে। সেই পথে কাঠ দিয়ে বানানো বোকার আগের স্টেডিয়ামও দেখেন আন্তোনিও।

বোকাকে জীবনের বড় একটা অংশ দেওয়া এই সমর্থক গত ৯ আগস্ট শতবর্ষী হন। আর্জেন্টাইন সংবাদমাধ্যম ‘লা নাসিওন’–এর ভাষায়, পৃথিবীতে তাঁর মতো খুব কম সমর্থকই আছেন, যাঁর জীবনকে তাঁর প্রাণের ক্লাবের মতোই ‘গ্রেট’ বিবেচনা করা হয়। আন্তোনিও সেই বিরল সমর্থকদেরই একজন।

আরও পড়ুন

জন্ম ১৯২৫ সালে। সে বছর বোকা জুনিয়র্স তাদের বিখ্যাত ইউরোপ সফর থেকে ফেরার দুই মাস পর আন্তোনিওর জন্ম। প্রথম আর্জেন্টাইন ক্লাব হিসেবে ইউরোপ সফরে গিয়ে রিয়াল মাদ্রিদকে হারানোর পাশাপাশি মোট ১৯ ম্যাচের মধ্যে ১৫টি জিতেছিল বোকা।

আন্তোনিওর শৈশব শুরু হয়েছিল বুয়েনস এইরেস থেকে অনেক দূরে। জন্ম লাভালে, গোয়া শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে। তাঁর বাবা, এলিওডোরো ছিলেন গোবেরনাদর মার্তিনেস নামের কাছাকাছি একটি শহরের প্রথম বসতি স্থাপনকারী। তিনিই প্রথম সেখানে কৃষিকাজ শুরু করেন—তামাক, ভুট্টা ও চিনাবাদাম চাষ করে তা রপ্তানি করতেন ব্রাজিলে। দীর্ঘজীবী হওয়া আন্তোনিওর রক্তেই। তাঁর নানি লিবেরেতা বেঁচেছেন ১১১ বছর।

এগারো ভাইবোনদের মধ্যে ১০ম আন্তোনিওকে মায়ের মৃত্যুর পর পরিবারসহ কোরিয়েন্তেসের কুরুজু কুয়াতিয়া অঞ্চলে চলে আসতে হয়। সেখানে আর্জেন্টিনার কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী তারাগো রসের বাড়ির কাছাকাছিই থাকেন তাঁরা। তারাগো রসের বাবার সঙ্গে শৈশবের ফুটবল খেলার পাশাপাশি বোকা জুনিয়র্সের সঙ্গে পরিচয় হয় আন্তোনিওর। রেডিওতে বোকার খেলার ধারাভাষ্য ও সাময়িকীগুলোয় ক্লাবটিকে নিয়ে বিভিন্ন লেখা পড়তেন। সাময়িকীগুলো পড়তে ছুটে যেতেন অপেক্ষাকৃত ধনী পরিবার তারাগো রসের বাসায়। আন্তোনিওর ভাষায়, ‘(বোকার) জার্সি দেখে এর রঙের প্রেমে পড়ে যাই।’

আরও পড়ুন

শৈশবে দারিদ্র্যের কশাঘাতে জীবন কেটেছে আন্তোনিওর। ১০ বছর বয়সের মধ্যে ঘড়ির কাজ করার পাশাপাশি অনেক ছোটখাটো কাজই করতে হয় তাঁকে। এ কারণে আর ফুটবলার হতে পারেননি। আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সে বয়সভিত্তিক দলের হয়ে চতুর্থ বিভাগ পর্যন্ত খেলেছিলেন। কিন্তু আন্তোনিওর ভাষায়, ‘খেলার জন্য আমাকে বুট, মোজা, জার্সি ও যাতায়াত ভাড়া জোগাড় করতে হতো—যেটা অসম্ভব হয়ে পড়ে।’

আন্তোনিও এখনো ১৯৪০ সালে বোকার লিগজয়ী দলের খেলোয়াড়দের নাম বলতে পারেন। তাঁর ছেলে আরমান্দোও বোকার সমর্থক। নাতি জোনাথন একজন সাংবাদিক এবং বোকার সমর্থক। আশ্চর্য হলো, আন্তোনিও এই বয়সেও পুরোদস্তুর একজন কর্মবীর! রাস্তাঘাটে লোকজনের ফেলে দেওয়া বিভিন্ন জিনিসপত্র দিয়ে ফুলের টব, গয়না এবং অন্যান্য জিনিস বানান। মুঠোফোন ব্যবহার করেন না এবং এখনো প্রতিবেশীদের বিভিন্ন কাজে সহায়তা করেন।

আন্তোনিওর ভাষায়, ‘সেদিনও দুই বন্ধুর বাথরুম ঠিক করে দিলাম। জঘন্য অবস্থায় ছিল! শুধু বিদ্যুতের কাজ করি না। ছোটবেলায় একটি দুর্ঘটনা দেখার পর ও নিয়ে (বিদ্যুৎ) আর আগ্রহ জাগেনি।’

আন্তোনিওর শততম জন্মবার্ষিকীর দিন বোকার মাঠ লা বোমবোনেরা স্টেডিয়ামের জায়ান্টস্ক্রিনে তাঁকে দেখানো হয়। জীবনে তাঁর আর চাওয়া–পাওয়ার কিছু নেই। কারণ, বোকা আছে তো!