তহুরা, ভুটানে দিনকাল কেমন কাটছে?
তহুরা খাতুন: আলহামদুলিল্লাহ, ভালোই। কোনো সমস্যা নেই। ভালো আছি এখানে। থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা আছে। সকালের নাশতাটা রুমেই করি। দুপুর-রাতে ক্যান্টিনে চাইলে খেতে পারি। রান্না করে খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে। বাইরের খাবার খেতে চাইলেও ওরা এনে দেয়।
ভুটান লিগে প্রথমবারের মতো খেলার অভিজ্ঞতা কেমন?
তহুরা: ওদের সবকিছু গোছানো। আমাদের দেশে মেয়েদের লিগটা নিয়মিত হয় না। হলেও এক মাসেই শেষ। এখানে লিগটা পেশাদার আর ছয় মাসব্যাপী হচ্ছে। আমাদের দেশে অনেক বড় বড় ক্লাব আছে, ব্যবসায়ী আছে, টাকাওয়ালা আছে, কিন্তু মেয়েদের ফুটবলে তারা আসে না। এত বছর ধরে আমরা ভালো রেজাল্ট করছি, কিন্তু আমাদের দেশের কোনো দল নেই মেয়েদের এএফসি চ্যাম্পিয়নস লিগে। কিন্তু ভুটানের আছে।
আপনি যেখানে খেলছেন, ভুটানের থিম্পু রয়েল কলেজ ক্লাব, এটা কেমন?
তহুরা: দারুণ ক্লাব। আমি আর ছোট শামসুন্নাহার আছি এই ক্লাবে। কলেজ চত্বরেই আমাদের দুজনকে রাখা হয়েছে। অন্যরা থাকে মাঠ লাগোয়া একটা ভবনে। ক্লাবটা এফসি চ্যাস্পিয়নস লিগেও খেলেছে। এই দলের বেশির ভাগ খেলোয়াড় স্কলারশিপে লেখাপড়া করে। ক্লাবটির মালিক রয়েল থিম্পু কলেজ। সম্ভবত রাজ পরিবারের কেউ যুক্ত আছেন। ভুটানের প্রথম বেসরকারি কলেজ এটি।
ভুটানের কী বেশি ভালো লেগেছে?
তহুরা: ছোট হোক বা বড়, ওরা মানুষকে অনেক সম্মান করে। কেউ রাস্তা পারাপার হতে গেলে গাড়ি দাঁড়িয়ে যায়। দেশটা ছোট, কিন্তু মনটা অনেক বড়। শৃঙ্খলা মেনে চলে সবাই।
দেশের বাইরে খেলতে গেলে সবচেয়ে বেশি কী মিস করেন?
তহুরা: পরিবার, বাড়ি, কলসিন্দুর...সবকিছু। আর মায়ের হাতের রান্না। মায়ের হাতের যেকোনো রান্নাই আমার পছন্দ। মা জানেন, কী খেতে পছন্দ করি আমি।
প্রিয় খাবার কী?
তহুরা: পাঙাশ মাছ ( হাসি)। অনেকে হয়তো এই মাছটা পছন্দ করেন না, কিন্তু আমার অনেক পছন্দ। বাড়িতে গেলে আমার বাবা সব সময় পাঙাশ মাছ নিয়ে আসেন; কারণ, বাড়ির লোকেরা জানেন আমি এটা খাব। আর ভর্তাটর্তা বেশি খাওয়া হয়।
অবসরে ভুটানে কী করেন? শপিং, ঘোরাঘুরি, না রুমে বসে সিনেমা দেখা হয়?
তহুরা: ভুটানে এসে ঘোরাঘুরি করিনি। দূরে কোথাও একবারও যাইনি। রুমেই থাকি। সিনেমা-টিনেমাও দেখি না, ছোটবেলা থেকেই।
তহুরা কি চুপচাপ নাকি মিশুক?
তহুরা: চুপচাপই থাকি। চুপচাপ থাকতেই আমার ভালো লাগে। হইচইয়ের মধ্যে যাই না।
ফুটবল খেলে প্রথম আয় কত ছিল, মনে আছে?
তহুরা: মনে আছে। আমি বঙ্গমাতা প্রাথমিক স্কুল টুর্নামেন্ট দিয়ে শুরু করেছিলাম। ধোবাউড়া না ময়মনসিংহে খেলছিলাম মনে নাই, শুধু মনে আছে আমার খেলা দেখে একটা লোক খুশি হয়ে ম্যাচ শেষে আমাকে ১০ টাকা আর আরেকজন ১০০ টাকা দিয়েছিল। সম্ভবত ২০১২-১৩ সালের কথা।
ওই টাকা দিয়ে কী করেছিলেন?
তহুরা: বাড়ি এসে ১১০ টাকার মধ্যে ১০০ টাকা দিয়েছিলাম মাকে। আমাদের বাড়িতে একটা মুরগি ছিল, যেটা টাকার জন্য বিক্রি করে দেওয়ার কথা ছিল। মাকে ১০০ টাকা দেওয়ার পর মুরগিটা আমার জন্য রেখে দেওয়া হয়। বিক্রি করা হয়নি আর। মা এখনো বলে কথাটা।
বাহ্, এ তো দারুণ স্মৃতি...
তহুরা: হ্যাঁ, এ রকম অনেক স্মৃতি আছে। ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলি, অনেক জায়গায় গেছি। মানুষ আমার খেলা দেখে খুশি হয়ে টাকা দিয়েছে।
বিগত সরকারের সময় কয়েকবার আর্থিক পুরস্কার পেয়েছেন। ফুটবলের আয় দিয়ে কী করলেন?
তহুরা: কিছু জমিটমি রাখছি। একটা জমি কিনছিলাম ছয় লাখ টাকায়। আরেকটা দোকান কিনছি।
ছোটবেলায় যখন খেলতেন, কখনো ভেবেছিলেন জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চড়াবেন?
তহুরা: কার জীবনে কী আছে, বলা কঠিন। আমি খেলা শুরু করেছিলাম খেলার আনন্দে। ছোট ছিলাম, জাতীয় দল কী, এসব বুঝতাম না। ভালো লাগত খেলতাম। একদিন জাতীয় দলে খেলতে হবে, এসব মাথায় ছিল না।
ফুটবলার হওয়ার লড়াইটা কঠিন ছিল?
তহুরা: আমাদের গ্রামে আমার দাদা একটু স্বচ্ছল ছিলেন। তবে আমাদের ছয় ভাইবোনকে পড়াশোনা করানো কঠিন ছিল বাবার জন্য। হিমশিম খেতেন তিনি। আমার বাবা ফিরোজ মিয়া, কৃষক মানুষ, গৃহস্থি কাজ করতেন। কৃষকদের অনেক পরিশ্রম করা লাগে। তবে অনেক পরিবারে খাবারের কষ্ট হয়, এই কষ্টটা আমি পাইনি। খাবারের সমস্যা হয়নি কখনো। এই দিক দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ।
আপনার বাবা কী করেন এখন, ভাইবোনেরা?
তহুরা: এখন তেমন কিছু করেন না। আমাদের জমিটমি আছে, সেগুলো দেখাশোনা করেন। আমরা ৫ বোন ১ ভাই। আমার বড় এক ভাই, এক বোন। ওদের দুজনেরই বিয়ে হয়েছে।
কলসিন্দুর গ্রামের মেয়েরা আজ আপনাকে দেখে অনুপ্রেরণা নেয়। নিজেকে তখন তারকা মনে হয়, নাকি গ্রামের মেয়ের মতোই থাকেন?
তহুরা: নিজেকে নিজে কখনো তারকা মনে করি না। সাধারণ মানুষই ভাবি। ভেতরে তারকা ভাব চলে এলে সমস্যা। সাধারণ থাকার চেষ্টা করি। সবার সঙ্গে কথা বলি, সবাই অনেক খুশি হয়।
ফুটবলার না হলে আপনার জীবনটা কেমন হতো?
তহুরা: আমাদের পরিবারে আমিই শুধুই স্কুলে পড়াশোনা করেছি, অন্যরা পড়েছে মাদ্রাসায়। তাই হয়তো ধার্মিক লাইনে যেতাম।
স্কুলে কেমন ছাত্রী ছিলেন?
তহুরা: ছাত্রী হিসেবে আমি ভালো না (হাসি)। কোনো সাবজেক্টেই ভালো না। খেলা ছাড়া কোনো কিছু পারি না। আমার শুধু খেলার প্রতি নেশা ছিল ছোটবেলা থেকে। খেলাই ছিল ধ্যানজ্ঞান। পরিবারে সবাই পড়ালেখায় ভালো। আমার ভাইবোনেরা মাকে হয়তো অনেক সময় বলত, ও শুধু খেলাধুলা করেই জীবন কাটাবে! পড়াশোনা লাগবে না! অনেক সময় আমার বড় ভাই আর বোন এ নিয়ে কথা শুনাতো মাকে। ঝাড়িটাড়ি মারত।
তারপর মা কী বলতেন?
তহুরা: মা সব সময় আমাকে সহায়তা করতেন। প্র্যাকটিস শেষে এসে ব্যাগ রেখে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়তাম। অনেক সময় রাতেও খেতাম না। মা বলতেন, এক রাত না খেলে শরীর থেকে চড়ুই পাখির সমান মাংস কমে যায়। তাই রাতে খাওয়াতেন মা। তখন আমি খুবই চিকন ছিলাম। আর দিনের বেলা একাই খালবিলে ঘুরতাম।
খালবিলে ঘোরা কেন?
তহুরা: প্রচুর মাছ ধরতাম। পাখি শিকার করতাম। ছোট বেলায় জীবনটা অনেক আনন্দময় ছিল আমার। সবাই বলত রোদবৃষ্টি যা–ই থাকুক, তহুরা ওর মতো ঘুরছে। গ্রামের মানুষ অবাক হয়ে যেত। অনেকে এখনো বলে সারাক্ষণ আমি নাকি বিলে বিলে ঘুরছি। আমার যা ভালো লাগত, সেটাই করতাম। ৫-১০টা ছেলেমেয়ে যেমন আড্ডা মারে, আমি নাকি ও রকম ছিলাম না। আমি আমার মতো পাখি শিকার করতে যেতাম, মাছ ধরতে যেতাম। ঈদের দিনেও মাছ ধরতে গেছি। বাড়িতে মাছ ধরে নিয়ে আসছি।
পড়োশোনা কত দূর করেছেন?
তহুরা: আমি আর ছোট শামসুন্নাহার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছিলাম একসঙ্গে। আসলে খেলার কারণে আমার ২-৩ বার গ্যাপ পড়ে। ইন্টারমিডিয়েটটা শেষ করতে পারিনি।
তহুরা নামটা কে রেখেছিল?
তহুরা: মা, তিনি রেখেছিলেন সারাবান তহুরা। কিন্তু নামটা পাল্টে গেছে। প্রাইমারি স্কুলে ‘তহুরা খাতুন’ দিয়ে দেন স্যারেরা।
ছোটবেলায় কোনো বিদেশি ফুটবলারের ওপর ক্র্যাশ ছিল?
তহুরা: ছোটবেলায় কাউকেই চিনতাম না, এখন চিনি। যদি পছন্দের ফুটবলারের কথা বলেন অবশ্যই মেসি। ক্র্যাশ যদি বলেন, সেটাও মেসি।
মেসির কী ভালো লাগে?
তহুরা: ডিসিপ্লিন, ঠান্ডা মেজাজ। উনি নীরব টাইপের মানুষ। এটাও ভালো লাগে।
আপনাকেও তো ‘বাংলাদেশের মেসি’ বলে অনেকে...
তহুরা: সে রকম কিছু না। শুনলে ভালো লাগে অবশ্যই। কিন্তু ওনার মতো তো আর না আমি। উনি বিশ্ব সেরা হয়েছেন বেশ কয়েকবার। ওনাকে ভালো লাগে অনেক।
একটু অন্য রকম প্রশ্ন। শাড়ি পরে ছবি তুলেছেন কখনো?
তহুরা: নাহ্, শাড়ি কখনোই পরিনি। আমার চুল খাটো তো, তাই শাড়ি পরি না (হাসি)। আর আমি সাজগোজও করি না। সাদামাটা থাকতেই পছন্দ করি।
ঘুরতে যেতে চাইলে কোথায় যেতে মন চায়?
তহুরা: বাড়িতে যেতে মন চায়। কলসিন্দুর স্কুলে গেলে ছোটবেলার স্মৃতিগুলো মনে পড়ে। অনেক স্মৃতি সেখানে। সেখান থেকেই আমি আজকের তহুরা।
আপনার প্রিয় গান বা গায়ক?
তহুরা: গান শুনি। মিক্সড গান বেশি শোনা হয়। তবে ওই রকম প্রিয় গান বা গায়ক নেই কোনো।
জীবনসঙ্গী হিসেবে তহুরার কেমন ছেলে পছন্দ?
তহুরা: ইশ্, আল্লাহ, কী প্রশ্ন করে (হাসি)। জানি না কপালে যা আছে...তা–ই হবে। আমি বলতে পারব না।
জীবনসঙ্গী কী খেলাধুলা জগতের কেউ হবে, নাকি বাইরের কেউ?
তহুরা: এটাও বলতে পারব না। আমার এমন কোনো পছন্দ নেই সত্যি বলতে। বিয়ে-মৃত্যু এসব আল্লাহর হাতে। আসলে আমি বিয়েশাদি নিয়ে কিছুই ভাবছি না, কপালে যা আছে, তা–ই হবে (হাসি)।
মাঠে নামার আগে কোনো বিশেষ রীতি বা কুসংস্কার মানেন?
তহুরা: নাহ্, এমন কিছু নেই। দোয়া–কালাম পড়ি...।
প্রিয় রং কোনটা?
তহুরা: লাল। তবে বিশেষ কোনো কারণ নেই। এমনিই ভালো লাগে।
কোথায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন?
তহুরা: হজ করার খুব ইচ্ছা। তাই সৌদি আরব যাওয়ার স্বপ্ন দেখি।
মাঠে গোল করার পর কীভাবে সেলিব্রেশন করতে ভালো লাগে?
তহুরা: গোল দিতে পারি, কিন্তু সেলিব্রেশনের করতে লজ্জা লাগে। আমরা বাংলাদেশি খেলোয়াড়েরা গোল করে সবাই একসঙ্গে হয়ে যাই। নিজস্ব কোনো সেলিব্রেশন নাই।
সতীর্থদের মধ্যে কাকে সবচেয়ে কাছের মনে হয়?
তহুরা: কলসিন্দুরে যাদের সঙ্গে ছোট থেকে বড় হয়েছি, ওদের সঙ্গে মেলামেশা বেশি হয়। শামসুন্নাহার জুনিয়র-সিনিয়র, মারিয়া, শিউলি ওদের সঙ্গে বেশি মেশা হয়, গল্প হয়।
জীবনে সবচেয়ে কষ্টের স্মৃতি?
তহুরা: বন্ধু সাবিনার মৃত্যু। জ্বরে পড়ে সে অকালে চলে গেছে। সেও ফুটবলার ছিল।
এক দিনের জন্য দেশের প্রধানমন্ত্রী হলে কী করবেন?
তহুরা: ছিন্নমূল মানুষগুলোকে রাস্তা থেকে সরিয়ে তাদের থাকার ব্যবস্থা করব। ছিন্নমূলদের নিয়ে আগে কাজ করব।
১০ বছর পর নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
তহুরা: ১০ বছর বাঁচি না মরি, কে জানে (হাসি)। আগে বেঁচে থাকি তারপর দেখা যাবে। ভবিষ্যৎ নিয়ে অত ভাবার দরকার নেই। বর্তমান নিয়েই ভাবি।