ভুয়া ‘বীর’, হামলাকারীর ভিন্ন পরিচয়—সিডনির হামলা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ভুল তথ্যের ছড়াছড়ি
অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সমুদ্রসৈকতে ইহুদি উৎসবে গুলির ঘটনায় হতাহতের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেন ভুল ও ভুয়া তথ্যের স্রোত বইছে। বিশেষ করে একজন বন্দুকধারীকে নিরস্ত্র করে প্রশংসায় ভাসা এক ‘নায়কের’ পরিচয় নিয়ে ইলন মাস্কের এআই চ্যাটবট ‘গ্রোকের’ ভুল তথ্য দেওয়ার ঘটনা আলোচনায় উঠে এসেছে।
ঘটনাটি ঘটেছে গত রোববার সন্ধ্যায়। সিডনির বন্ডাই সৈকতে ইহুদিদের হানুক্কেহ উৎসবে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ১৫ জনকে হত্যা করেন বাবা ও ছেলে সাজিদ আকরাম ও নাভিদ আকরাম। পুলিশের পাল্টা গুলিতে নিহত হন ৫০ বছর বয়সী সাজিদ। আর ২৪ বছরের নাভিদ পুলিশি পাহারায় হাসপাতালে আছেন।
এরই মধ্যে হামলাকারীদের পরিচয় নিয়ে নেট মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে নানা ভুল আর ভুয়া খবর। বলা হচ্ছে, ‘ব্রেকিং’ কোনো ঘটনার সময় এআই ব্যবস্থা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে মিথ্যা প্রচারকে আরও বাড়িয়ে তোলার বিষয়ে থাকা উদ্বেগের সর্বশেষ ঢেউ এটি।
সিডনির এ ঘটনায় ৪৪ বছর বয়সী আহমেদ আল আহমেদ নামের এক ব্যক্তি বন্দুকধারীর কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নেন। হামলাকারীকে নিরস্ত্র করে ‘নায়ক’ বনে যান তিনি। যদিও নিজেও হাত ও বাহুতে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এখন তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
কিন্তু এআই চ্যাটবট গ্রোকে অন্য একজনকে ‘এ ঘটনার নায়ক’ হিসেবে দেখানো হয়। ভুয়া একটি সংবাদে বলা হয়েছে, হামলাকারীকে নিরস্ত্র করা ওই ‘নায়কের’ নাম ‘এডওয়ার্ড ক্র্যাবট্রি’। বয়স ৪৭ বছর। তিনি পেশায় আইটি বিশেষজ্ঞ। এমনকি সংবাদটিতে ‘হাসপাতালে আহত অবস্থায় শুয়ে থাকা’ ভুয়া ‘এডওয়ার্ডের’ বানোয়াট মন্তব্য প্রকাশ করা হয়।
‘দ্যডেইলিএইউএস.ওয়ার্ল্ড’ নামের একটি ওয়েবসাইট থেকে ভুয়া সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছিল। রোববারই আইসল্যান্ডে এ ওয়েবসাইট নিবন্ধন করা হয়েছে। জানা গেছে, যুব সংবাদ ওয়েবসাইট ‘দ্য ডেইলি এইউএস’–এর সঙ্গে এই ওয়েবসাইটের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
সিডনিতে জন্ম নেওয়া সাইবার নিরাপত্তাবিশেষজ্ঞ ও ‘বাগক্রাউডের’ প্রতিষ্ঠাতা ক্যাসি এলিসের মতে, এমন পরিস্থিতিতে ভুল তথ্য ছড়ানোর ঝুঁকি বেশি থাকে। হোয়াইট হাউস ও অস্ট্রেলিয়ার গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে পরামর্শ দিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এটা অবিশ্বাস্য, দুঃখজনক ও আবেগময় একটি ঘটনা। এটা লাখো মানুষের মনোভাবকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যেতে পারে।’
এলিসের মতে, এমন ঘটনার (হামলা) পর যখন চারপাশে ‘ধোঁয়াশাপূর্ণ’ পরিস্থিতি থাকে, মানুষ নানা কিছু জানার জন্য বেশ উদ্গ্রীব থাকেন, ঠিক তখনই ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রচুর সুযোগ তৈরি হয়।
রবি ও সোমবার আহমেদ আল আহমেদকে নিয়ে একের পর এক ভুয়া তথ্য দিয়েছে গ্রোক। এতে ব্যবহারকারীরা যখন আহমেদের বন্দুকধারীর সঙ্গে লড়াইয়ের ভিডিওটি চ্যাটবটকে দেখান, তখন সেটি দাবি করে, ফুটেজটি ‘একজন লোকের পামগাছে ওঠার একটি পুরোনো ভাইরাল ভিডিও’।
অন্য আরেকটি ক্ষেত্রে আহত আহমেদের ছবিকে গাজায় ‘হামাসের হাতে আটক এক ইসরায়েলি জিম্মির’ ছবি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
রেডিট, এক্স আর হোয়াটসঅ্যাপের বিভিন্ন গ্রুপ চ্যাটে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই দিয়ে বানানো একটি ছবি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। ছবিতে মেকআপ ও নকল রক্ত লাগানো একজন ব্যক্তিকে দেখা যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, আসল ছবিটি মানবাধিকার আইনজীবী আর্সেন অস্ট্রোভস্কির। রোববারের ওই হামলার সময় তিনি ঘটনাস্থল থেকে রক্তমাখা মুখ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে কথা বলেছিলেন।
এ ছাড়া ঘটনাস্থলে থাকা দুজন নারী পুলিশ সদস্যের ক্রপ বা কাটছাঁট করে ছোট করা ছবি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। পূর্ব ইউরোপভিত্তিক ‘ব্যারন ট্রাম্প’ ফ্যান অ্যাকাউন্ট থেকে এটি পোস্ট করা হয়। এতে দাবি করা হয়, তাঁরা ‘পুরোপুরি নিথর’ বা মারা গেছেন। আরও বলা হয়, ‘বন্দুকধারীরা কোনো বাধা ছাড়াই ২০ মিনিট পর্যন্ত গুলি চালিয়েছে।’
ওই পোস্ট এক লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে। নারী বিদ্বেষমূলক প্রচুর মন্তব্য এসেছে। অথচ আসল ছবিটিতে (ক্রপ না করা) রয়েছে, বন্দুকধারীকে নিরস্ত্র করার পর ওই নারী পুলিশ সদস্যরা বেসামরিক লোকজনকে ঘটনাস্থল থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন।
নিউ সাউথ ওয়েলসে বসবাস করা পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত এক ব্যক্তি দ্য গার্ডিয়ানকে বলেছেন, তাঁর জীবন রীতিমত ‘দুঃস্বপ্নে’ পরিণত হয়েছে। কেননা বন্ডাই সৈকতে ‘সন্দেহভাজন হামলাকারী’ হিসেবে তাঁর একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।
ওই ব্যক্তির নামও নাভিদ আকরাম। বয়স ৩০ বছর। মূলত হামলাকারীর সঙ্গে নামের মিল থাকায় তাঁর ছবি ভাইরাল হয়েছে। ভুল করে তাঁকে ‘হামলাকারী’ ভাবছে অনেকেই। মূলত ভারতভিত্তিক অ্যাকাউন্টগুলো থেকে নাভিদের বিষয়টি ছড়িয়েছে বেশি। সিবিএস নিউজ নির্দোষ নাভিদের বিড়ম্বনা নিয়ে প্রতিবেদন করেছে।
ডোভার হাইটস ও ডাবল বেতে সমন্বিত হামলার মিথ্যা দাবিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে নিউ সাউথ ওয়েলস পুলিশ একটি বিবৃতি দিয়ে বলতে বাধ্য হয়েছে, ডোভার হাইটস এলাকায় এমন কোনো ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। দয়া করে অসমর্থিত তথ্য বা গুজব ছড়াবেন না।
অস্ট্রেলিয়ার ই-সেফটি কমিশনারের দপ্তরে সিডনির হামলা ও হত্যাকাণ্ডের ফুটেজ দেখানোর বিষয়ে একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। কমিশনার নিয়ন্ত্রক প্ল্যাটফর্মগুলোকে মনে করিয়ে দিয়েছে, সংবেদনশীল আধেয়র (কনটেন্ট) ক্ষেত্রে সতর্কতামূলক লেবেল ও ঝাপসা ফিল্টার ব্যবহার করা উচিত।
প্রতিক্রিয়া জানতে এক্সের এআই চ্যাটবটের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। স্বয়ংক্রিয় উত্তর পাওয়া গেছে, ‘প্রথাগত বিদ্যমান সংবাদমাধ্যম মিথ্যা বলে।’