পঁচিশের নির্বাচিত

স্থিতির জন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলাতে হবে

প্রথম আলোর বয়স মাত্র ২৫ বছর, কিন্তু এর অর্জন অনন্য। প্রথম আলো তার স্বপ্নের পথে এগোতে এগোতে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে অভূতপূর্ব কিছু মাইলফলক স্থাপন করেছে। সাহসী সাংবাদিকতা, উদ্ভাবনী পরিকল্পনা, দেশ ও বিদেশের অগ্রগণ্য মানুষের সম্পৃক্ততা ছিল এর শক্তি। প্রথম আলোর ২৫ বছরের নির্বাচিত ও সংক্ষেপিত বিষয়বস্তু থেকে পাওয়া যাবে এর স্বতন্ত্র পথরেখার নিশানা।

আকবর আলি খান
আকবর আলি খান

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাংলাদেশের ইতিহাসে অভিনব কিছু নয়। ধূসর অতীত থেকে একুশ শতক পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশে বারবার অস্থিতিশীলতার আবির্ভাব ঘটেছে। প্রাচীন বাংলায় চিন্তানায়কেরা এই অস্থিতিশীলতাকে মাৎস্যন্যায় বলে অভিহিত করতেন। আভিধানিক অর্থে মাৎস্যন্যায় হলো মাছের মতো অবস্থা, যেখানে বড় মাছ ছোট মাছকে খেয়ে ফেলে এবং ছোট মাছের বাঁচার কোনো অধিকার নেই। এ জন্যই বাংলাদেশের চিন্তানায়কেরা মাৎস্যন্যায় পরিস্থিতি সম্পর্কে উদ্বিগ্ন ছিলেন।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার বড় কারণ হলো, রাজনৈতিক দলগুলোর দুর্বলতা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কয়েকটি বড় দুর্বলতা রয়েছে।

প্রথমত, যে দুটি জোট বাংলাদেশের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে থাকে, তারা বংশানুক্রমিক রাজনীতি করে। তিন প্রজন্ম ধরে প্রধান দুটি দলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বংশানুক্রমিক। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিরোধ অতীতকেন্দ্রিক,
ভবিষ্যৎ​নির্ভর নয়।

এই রাজনীতির আরেকটি দুর্বলতা হলো, এরা সবাই গণতন্ত্রের কথা বললেও সে অনুযায়ী দল পরিচালনা করে না। কোনো কোনো দলে দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ সম্পাদকের পদ খালি থাকে। কোথাও কোথাও দলের পদাধিকারীরা নির্বাচিত না হয়ে প্রধান নেতা কর্তৃক মনোনীত হন। এতে তৃণমূলের ভূমিকা শূন্য। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই রাজনৈতিক দলে যে কেউ অংশগ্রহণ করতে পারে এবং তাদের বক্তব্য তুলে ধরতে পারে। তৃণমূল সেখানে নেতা পরিবর্তন ও ম্যানিফেস্টো বদলাতে পারে। আমাদের কোনো দলেই এ সুযোগ নেই। ফলে রাজনীতির পরিবর্তনও সম্ভব হচ্ছে না।

অস্থিতিশীলতার আরেকটি কারণ হলো বাংলাদেশের সংবিধান। সংবিধানের ঘন ঘন পরিবর্তন বাঞ্ছনীয় নয়। আমাদের সংবিধানের প্রথম দুর্বলতা হলো, এই সংবিধানে ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে। নির্বাহী বিভাগের সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে। নির্বাহী বিভাগকে আইনসভা নিয়ন্ত্রণ করার সব ক্ষমতা সংবিধানে দেওয়া হয়েছে। অনুরূপভাবে সাংবিধানিকভাবেই বিচার বিভাগের ওপর কর্তৃত্ব করার ক্ষমতাও নির্বাহী বিভাগের ওপর বর্তেছে। আমাদের শাসনব্যবস্থার কোনো স্তর নেই। স্থানীয় সরকার অত্যন্ত দুর্বল এবং কেন্দ্রীয় সরকারের আজ্ঞাবহ। এই পরিস্থিতিতে তৃণমূলের রাজনীতিতে জনসাধারণ আকৃষ্ট হতে চায় না। কাজেই ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ না হলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কমানো সম্ভব হবে না। 

বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় দুর্বলতা হলো নির্বাচনপদ্ধতি। বাংলাদেশে ৩০০টি আসনেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। এর ফলে যে প্রার্থী তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর থেকে এক ভোট বেশি পান, তিনিই জয়ী হন। এর দুটি মারাত্মক ত্রুটি দেখা যায়: (১) এ অবস্থায় ভোটে জাল-জালিয়াতির উৎসাহ বাড়ে। যদি জাল ভোটে কোনো প্রার্থীকে এক ভোট বেশি পাইয়ে দেওয়া যায়, তাহলে তিনিই জয়ী হয়ে সংসদে যান। এই জালিয়াতি বন্ধ করতে হলে নির্বাচনব্যবস্থা বদলাতে হবে। (২) সংসদের আসন ও দলের ভোটসংখ্যার মধ্যে সহগমন দেখা যায় না। অর্থাৎ কম ভোট পেয়েও সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকা সম্ভব।

সংবিধানের তৃতীয় দুর্বলতা হলো, যেভাবেই হোক, কোনো দল একবার সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে পাঁচ বছরের জন্য দেশটার মালিক বনে যায়। তাই তারা কারও কথা শোনে না। এর বিকল্প রেফারেন্ডাম ও রিকলের ব্যবস্থা আছে। সংবিধানে গণভোটের (রেফারেন্ডাম) ও প্রার্থী প্রত্যাহারের (রিকল) ব্যবস্থা এ ধরনের সমস্যা নিরসনে সহায়ক। তবে ঘন ঘন গণভোট ও প্রার্থী প্রত্যাহার করা হলেও অস্থিতিশীলতা আসতে পারে। সুতরাং গণভোট ও প্রার্থী প্রত্যাহারের অবাধ সুযোগ দেওয়া যাবে না। এ সুযোগ দেওয়া হলে যেসব বিষয়ে ধ্বংসাত্মক রাজনীতি হচ্ছে, সেসব বিষয় গণভোটের মাধ্যমেই মীমাংসা করার সুযোগ থাকে। সঠিকভাবে রেফারেন্ডাম হলে ধ্বংসাত্মক ও হরতালের রাজনীতিও হ্রাস পাবে।

সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়া সহজ নয়। কিন্তু যদি স্থিতিশীল রাজনীতি চাই, তাহলে সংবিধান সংশোধন বিষয়ে চিন্তাভাবনা অবশ্যই করতে হবে। কোনো রাজনৈতিক দল এ বিষয়ে বলেছে যে সংবিধান সংশোধনের আলাপ-আলোচনার জন্য যে পরিবেশ দরকার, বাংলাদেশে তা বর্তমানে অনুপস্থিত। দুটি জোটই মনে করে, তারা অপর পক্ষকে নির্মূল করে দেবে। কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই এটা সম্ভব নয়। আমাদের দুটি দলের মধ্যে কোনো সহিষ্ণুতা নেই। তারা রাজনৈতিক
সমাধানে নয়, রাজনৈতিক বিজয়ে বিশ্বাস করে। কাজেই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন। কিন্তু যাঁরা রাজনীতিতে আছেন, এসব নিয়ে তাঁরা উদ্বিগ্ন নন মোটেই। কাজেই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য আমাদের এখন যা করতে হবে তা হলো: 

১. তরুণসমাজকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে হবে। তাদের পক্ষেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলানো সম্ভব। যারা তাদের পূর্বপ্রজন্মের ব্যক্তিত্ব, তাদের পক্ষে নতুন বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়।

২. বাংলাদেশে যদি স্থিতিশীল রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে হয়, তাহলে সংবিধানের নির্বাচনী সমস্যা ও কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে। শুধু নির্বাচন করলেই স্থিতি ফিরবে না।

৩. সংবিধান সংশোধন করে অবিলম্বে রেফারেন্ডামের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। যখন-তখন এটা না করে প্রতি দুই বছর পর তিনটি কি পাঁচটি প্রশ্নে গণভোট আয়োজন করতে হবে।

৪. এমন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেখানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন থাকে, যেখানে বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব থাকবে না।

এ ধরনের পরিবর্তন ছাড়া বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সম্ভব হবে না।

৫. সংসদের ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস করতে হবে এবং স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করতে হবে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজনীয় কিন্তু যথেষ্ট নয়। নির্বাচনের বাইরের সমস্যাগুলোও সমান গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে সব ধরনের সমস্যারই সমাধান বের করতে হবে।

আকবর আলি খান: সাবেক সচিব, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।

৬ নভেম্বর ২০১৪ (সংক্ষেপিত)