Thank you for trying Sticky AMP!!

একটি টপ সিক্রেট চিঠি পেলাম

প্রয়াত মাহমুদুর রহমান মজুমদার

(স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশে সর্বজ্যেষ্ঠ বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন ব্রিগেডিয়ার মাহমুদুর রহমান মজুমদার। তিনি এ সময় চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারের (ইবিআরসি) কমান্ড্যান্ট ছিলেন। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত সামরিক বাহিনী, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর চাকরিরত ও অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সদস্যদের নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেন এবং সেটা অনুমোদনের জন্য কর্নেল ওসমানীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে পাঠান। তিনি ২৫ মার্চ পর্যন্ত তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন। বঙ্গবন্ধুর অনুমোদন না পাওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। ২৭ মার্চ তাঁকে আটক করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। পুরো নয় মাস পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে দফায় দফায় পৈশাচিক নির্যাতন করে।
২০১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর ব্রিগেডিয়ার মজুমদার মারা যান। তাঁর নিজ হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি ও রেকর্ড করা বক্তব্য অবলম্বন করে তাঁর জবানীতেই ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চের সেই আক্রমণ পরিকল্পনার কথা তিন কিস্তিতে সংক্ষেপে জানাচ্ছেন লুৎফুল হক। (আজ ছাপা হলো প্রথম কিস্তি)

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ছয় দফা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন। শেখ মুজিবের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেন তিনি। ইয়াহিয়া ছয় দফা মেনে নিতে মৌখিকভাবে রাজি হন। করাচি ফেরার পথে ঢাকা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘শেখ মুজিবই পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী।’

পাঞ্জাব রেজিমেন্টে তথা পশ্চিম পাকিস্তানে আমার দীর্ঘ ১৮ বছর চাকরির অভিজ্ঞতা থেকে এ কথা বিশ্বাস করতে পারলাম না। ভাবলাম, ২৩ বছর ধরে বাঙালিদের ওপর প্রত্যক্ষভাবে আধিপত্যকারী পশ্চিম পাকিস্তানি আমলা ও সেনা কর্মকর্তারা খাঁটি বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফাভিত্তিক একচ্ছত্র শাসন কক্ষনো মেনে নেবে না!

করাচি ফিরে ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর আমন্ত্রণে সপারিষদ সিন্ধু প্রদেশের লারকানা শহরে গেলেন। আমার মনে সন্দেহ হলো যে লারকানায় ভুট্টোর রাজকীয় আতিথেয়তার আড়ালে নিশ্চিয়ই বাঙালি ও মুজিববিরোধী কোনো অভিযানের ষড়যন্ত্র হচ্ছে।

লে. কর্নেল (পরে মেজর জেনারেল) খলিলুর রহমান এ সময় জিএইচকিউ ট্রেনিং উইংয়ে জিএসও-১ ছিলেন। উনি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে খুবই আগ্রহী এবং উদ্বিগ্ন ছিলেন। তাঁর সাথে টেলিফোনে প্রায়ই কথাবার্তা হতো। উনি আমাকে বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাধারণত জিএইচকিউতে আসেন না। অথচ লারকানা থেকে ফিরে ইয়াহিয়া খানকে দু-তিন দিন ধরে জিএইচকিউতে দেখতেছি। এখানে জেনারেল হামিদ, পিরজাদা, গুল হাসান এবং ওমরকে নিয়ে রুদ্ধ কামরায় মিটিং করেছেন। নিশ্চয় ওরা কিছু একটা ঘোট পাকাচ্ছে।’

এ অবস্থার মধ্যে একদিন জিএইচকিউ থেকে দীর্ঘ দুই পাতার একটি টপ সিক্রেট চিঠি পেলাম। চিঠি পড়ে মর্মাহত হলাম। চিঠিতে লেখা হয়েছে, আওয়ামী লীগের ছয় দফার ভিত্তিতে প্রতিরক্ষা বাহিনীতে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব মেনে নিলে বাঙালির প্রাধান্যে এটি একটি তৃতীয় শ্রেণীর সেনাবাহিনীতে পরিণত হবে। বিস্তৃতভাবে এসব কথা বর্ণনার পর উপসংহারে লেখা হয়েছে, এমতাবস্থায় শেখ মুজিবকে কিছুতেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে দেওয়া যায় না।

তাহলে আমরা আর পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে থাকব না, আমরা স্বাধীন হব। প্রয়োজনে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনব—এ ছিল আমার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। আমার একান্ত বিশ্বস্ত চিফ ইন্সট্রাক্টর লে. কর্নেল মুজিবর রহমান চৌধুরীকে আমার অফিসে ডেকে পাঠালাম। তাকে চিঠি পড়তে দিলাম। এ নিয়ে দুজনে আলোচনা করলাম। ঠিক হলো, কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানীর মাধ্যমে শেখ মুজিবকে যথাশিগগির বিষয়টি অবহিত করতে হবে।

ওসমানী সাহেবকে টেলিফোনে সিলেটি ভাষায় কিছু ইঙ্গিত দিয়ে যত শিগগির সম্ভব চট্টগ্রাম শহরে লে. কর্নেল রবের বাসায় গোপনে আসতে বলি। পূর্ব পাকিস্তানে তখন পূর্ব পাকিস্তানি ও পশ্চিম পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর শক্তি ও অবস্থানের মৌখিক হিসাব কষতে বসলাম আমরা। দেখা গেল, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, আনসার মিলে তাৎক্ষণিক স্ট্রাইকিং ফোর্স পশ্চিম পাকিস্তানিদের চেয়ে আমাদের সাত-আট গুণ বেশি। অতএব, স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার জন্য অবিলম্বে আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।

দুই দিন পর ওসমানী সাহেব এলেন। তাঁকে আমি জিএইচকিউ থেকে পাওয়া টপ সিক্রেট চিঠির বিষয়বস্তু জানালাম। বললাম, ইয়াহিয়া, মুজিব, ভুট্টো বৈঠক ও কাঁদা ছোড়াছুড়ি করে একে অন্যকে খেপিয়ে সংসদ অধিবেশন বিলম্বিত করার আড়ালে বাঙালিদের সামরিক বাহিনী দিয়ে দমন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে জিএইচকিউ। পশ্চিম পকিস্তান থেকে রিইনফোর্সমেন্ট আনার আগেই অকস্মাৎ আমাদের আক্রমণ করতে হবে।

ওসমানী সাহেব আমাকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, ‘আমি ঢাকায় ফিরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে টপ সিক্রেট চিঠি ও জিএইচকিউর ডিসিশন সম্বন্ধে বিস্তারিত জানাব। সাবধান! বঙ্গবন্ধুর সরাসরি নির্দেশ বা ইঙ্গিত ছাড়া কোনো সামরিক অভিযানে মোটেই যাবেন না।’ আমি তাঁকে বললাম, ‘আপনি শেখ সাহেবকে ভালো করে বোঝাবেন। এ-ও বলবেন যে পাকিস্তানের ব্যাপারে আর্মির ডিসিশনই সব সময় ফাইনাল হয়। আমি মনে করি, আর অপেক্ষা না করে আমাদের অ্যাকশনে যাওয়া উচিত।’ উনি বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি গিয়ে বুঝায়ে বলব। তারপর আপনাকে জানাব।’

আমি ওনাকে বললাম, ‘আমি আপনাকে রিটায়ার্ড বেঙ্গলি পারসনের বয়স অনুযায়ী ঠিকানা দিয়ে লিস্ট পাঠাব। আপনি সেই লিস্ট অনুযায়ী তাদের ডেকে সতর্ক করে দিয়ে বলবেন, যখনই প্রয়োজন হবে তাদের ডাকা হবে। ডাকার সঙ্গে সঙ্গে তারা সবাই চট্টগ্রাম সেন্টারে রিপোর্ট করবে।’ উনি বললেন, ‘ঠিক আছে, পাঠিয়ে দেবেন।’

আমার খুব ইচ্ছা ছিল যে আমি টপ সিক্রেট চিঠিটা ওসমানী সাহেবকে দেখাব। কিন্তু উনি আসার আগে আমাকে খবর দিয়ে আসেন নাই। আসছেন গোপনে। রাতে। অফিস বন্ধ থাকায় কেবিনেট থেকে চিঠিটা আনতে পারলাম না।

উনি চলে যাওয়ার পরে আমি কর্নেল চৌধুরীকে ডেকে বললাম, ‘তাড়াতাড়ি রেকর্ড অফিস থেকে বাঙালি সৈনিকদের লিস্টটা বের করেন। যাদের বয়স ৫০ বছর বা ৫২ বছর পর্যন্ত, তাদের ঠিকানাসহ একটা লিস্ট করেন।’

ওসমানী সাহেবের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হতো। ওনাকে আমি সব সময় বলতাম—আর দেরি করবেন না, আর দেরি করবেন না।

কর্নেল চৌধুরী লিস্ট রেডি করলেন। লিস্টটা অনেক বড় হয়ে গেছে, প্রায় ২৫০০ সৈনিক।

আমি ক্যাপ্টেন আমিন আহাম্মদ চৌধুরীকে ডাকলাম এবং বললাম, ‘এই লিস্ট নিয়ে তুমি ঢাকায় কর্নেল ওসমানীর কাছে যাবে।’ চট্টগ্রামের এসপি শামসুল হককে টেলিফোন করে বললাম, ‘আমাকে একটা সিভিল গাড়ি দিতে হবে। গাড়িটা ঢাকা যাবে, আবার নিয়ে আসবে।’ শামসুল হক গাড়ি দিল। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে আমিনকে দিয়ে লিস্ট পাঠালাম। আমিনকে বললাম, লিস্টটা সরাসরি ওসমানী সাহেবের হাতে দিবা।