
সবুজ মাঠ পেরিয়ে আঁকাবাঁকা জমির আলপথ ধরে সামনে এগিয়েই চোখধাঁধানো সবজির রাজ্য। খেতের পর খেত বিদেশি সবজি—লেটুস পাতা, চায়নিজ পাতা, ক্যাপসিকাম, বিট রুট, ব্রকলি, রেড ক্যাবেজ, স্কোয়াশ, ফ্রেঞ্চ বিন, সুইট কর্ন, বেবি কর্ন, থাই আদা, থাইতুলসী, লেমনগ্র্যাস, স্যালারি পাতা, শিমলা মরিচ, চায়নিজ ক্যাবেজ প্রভৃতি।
বাংলার কৃষকেরা ব্যস্ত বিদেশি সবজি চাষে। কোনো প্রশিক্ষণ লাগেনি। দেশের ভেতরে চাহিদা আছে। তাই নিজেরাই বীজ সংগ্রহ করে নেমে পড়েছেন চাষে। বগুড়ার তিনটি উপজেলা শিবগঞ্জ, গাবতলী ও শাজাহানপুরের বেশ কয়েকটি গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে এই চাষ। এসব গ্রামে বছরে গড়ে ৪০০ মেট্রিক টন (১০ হাজার মণ) বিদেশি সবজি চাষ হচ্ছে বগুড়ার মাটিতে।
শিবগঞ্জ উপজেলার রায়নগর ইউনিয়নের পার টেপাগাড়ি গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে করতোয়া নদী। প্রতিবছর বর্ষায় করতোয়া নদীর পানিতে তলিয়ে যেত ফসলি জমি। বিদেশি সবজি চাষ এই একফসলি জমিগুলোকে বদলে দিয়েছে। পাল্টে গেছে গ্রামের চিরায়ত কৃষিচিত্র।
বগুড়ায় উৎপাদিত এসব বিদেশি সবজি যাচ্ছে রাজধানীর শেরাটন, সোনারগাঁ, ওয়েস্টিনের মতো তারকা হোটেলে। সুপার শপগুলোয় যেসব বিদেশি সবজি থরে থরে সাজানো থাকে, সেগুলোরও বেশির ভাগের উৎস বগুড়ার এসব গ্রাম। তা ছাড়া সারা দেশের নামীদামি চায়নিজ রেস্টুরেন্টগুলোতে সরাসরি সরবরাহ যাচ্ছে এখান থেকে। এসব রেস্টুরেন্টে সবজির জোগান আগে আসত বিদেশ থেকে। এভাবে চাষ বাড়তে থাকলে শিগগিরই সবজি বিদেশেও রপ্তানি হবে বলে আশাবাদী কৃষকেরা।
টেপাগাড়ি গ্রামে এখন সবচেয়ে বড় চাষি মিজানুর রহমান। এই গ্রামে শুরুটা তিনিই করেছিলেন। মিজানুর বলেন, ১৬ বছর আগে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের খামারবাড়িতে নানা জাতের সবজির প্রদর্শনী দেখে রেড ক্যাবেজ, লেটুস পাতা, চায়নিজ পাতা, লেমনগ্র্যাস ও সুইটকর্নের কিছু বীজ কিনে এনেছিলেন তিনি। সবাই পাগল ভেবেছিল। বলেছিল, ‘দ্যাশের মাটিত বিদেশি সবজি হবি ক্যামনে?’ এক এনজিও থেকে ১২ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ৮ শতক জমিতে চাষ হলো কয়েক ধরনের বিদেশি সবজি। ফলনও ভালো হলো। কিন্তু এসব সবজি কিনবে কে? নিজে বগুড়া শহরে বয়ে নিয়ে চায়নিজ রেস্তোরাঁয় বিক্রি করতে শুরু করেন। ১৫ দিন বা এক মাস পর দাম পাওয়া যেত।
ধীরে ধীরে চায়নিজ রেস্তোরাঁ ছাড়াও রাজধানীর তারকা হোটেল, চেইন শপ থেকে সবজির চাহিদা আসতে থাকে। এখন দেশজুড়েই তারকা হোটেল-চেইন শপে যাচ্ছে তাঁর খেতের সবজি। যাচ্ছে পর্যটনের শহর সুদূর কক্সবাজারে।
আট শতক জমি দিয়ে শুরু করে মিজানুর এখন ১৭ বিঘা জমিতে ২৭ জাতের বিদেশি সবজি চাষ করছেন।
‘নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে’
বগুড়া শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে পার টেপাগাড়ি গ্রামে গিয়ে দেখা গেল পার টেপাগাড়ি, ভাগকোলা এবং টেপাগাড়ি খামারপাড়ায় মাঠজুড়ে বিচিত্র ধরনের অচেনা সবজি। খেতের আলপথে বস্তায় ভরা হচ্ছে ক্যাপসিকাম। এগুলো যাবে নওগাঁ ও জয়পুরহাটের চায়নিজ রেস্তোরাঁয়।
বাঁশের মাচায় ঝুলছে অচেনা চেহারার ফ্রেঞ্চ বিন। আরেকটি মাঠে লেমনগ্র্যাস দেখলে ঘাস বলে ভুল হবে। থাই স্যুপে এর দারুণ কদর। করতোয়া নদীর তীরে একটি ক্যাপসিকাম খেতে হলুদ, লাল ও সবুজ তিন ধরনের ক্যাপসিকাম চাষ হচ্ছে। পাশেই একটি জমিতে ফলেছে সুইট কর্ন। আরেকটি খেতে মিষ্টিকুমড়ার মতো দেখতে স্কোয়াশ।
কৃষক মিজানুর বললেন, এখন শীতকালের ছয় মাসই বিদেশি সবজি চাষ হচ্ছে। বর্ষায় এসব খেতেই চাষ হবে ধান।
চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খেতে লাগানোর পর লেটুস পাতা, লেমন পাতা ও চায়নিজ পাতা ৪০ দিনে আর ব্রকলি ৭০ দিনে তোলা যায়। ফ্রেঞ্চ বিন সময় নেয় ৬০ দিন। ব্রকলি, রেড ক্যাবেজ চাষে বিঘাপ্রতি খরচ হয় ২০ হাজার টাকা। বিঘায় খরচ বাদে লাভ হয় গড়ে ৪০ হাজার টাকা।
দুই যুগ আগে শিবগঞ্জ উপজেলার বুজরুক শোকরা গ্রামের ভূমিহীন চাষি আনছার আলীর মাধ্যমেই এই অঞ্চলে বিদেশি সবজির চাষ শুরু। তিনি শুরু করেছিলেন ক্যাপসিকাম চাষ দিয়ে। এখন বিদেশি সবজিচাষি হিসেবে দেশজুড়ে খ্যাতি তাঁর। বর্তমানে প্রায় ৩০ বিঘা জমিতে বিভিন্ন জাতের বিদেশি সবজি চাষ করেছেন। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কৃষকেরা এসে তাঁর কাছ থেকে বিদেশি সবজির বীজ ও চারা সংগ্রহ করছেন। তাঁর হাত ধরে বিদেশি সবজির চাষ ছড়িয়ে পড়ছে দেশজুড়ে। পেয়েছেন সিটি ব্যাংক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পুরস্কার। গড়ে তুলেছেন ‘ওয়েস্টার্ন ভেজিটেবলস প্রোডাকশন কৃষি ফার্ম’ নামে একটি খামার।
আনছার আলী প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এখন একাই বছরে প্রায় ৫ হাজার মণ (২০০ টন) সবজি উৎপাদন করছেন। তিনি বলেন, বগুড়ায় একটা নীবর বিপ্লব ঘটে গেছে। এই সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগাতে এখন এলাকায় দরকার একটি বিশেষায়িত হিমাগার। বিদেশে সবজি রপ্তানির উদ্যোগও নিতে হবে।
ছড়িয়ে পড়েছে জেলাজুড়ে
বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলা থেকে শুরু হওয়া বিদেশি সবজি চাষ ছড়িয়ে পড়ছে অন্য উপজেলায়ও। গাবতলী উপজেলার পাঁচপাইকা গ্রামের মোস্তাফিজার রহমান প্রায় ৩০ বিঘায় গড়েছেন বিদেশি সবজি, বিদেশি মসলা, ভেষজ ও বনস্পতির খামার। মোস্তাফিজার রহমান বলেন, ‘১৩ বছর ধরে বিদেশি সবজি চাষ করছি। মাসে প্রায় লাখ টাকার সবজি রাজধানীর গুলশান, বনানী ও কারওয়ান বাজারে বিক্রি করছি।’
বিদেশি সবজি চাষ করছেন গাবতলী উপজেলার রানীরপাড়া গ্রামের আবদুল হান্নান, শাজাহানপুর উপজেলার ব্রি কুষ্টিয়া গ্রামের আবদুল মান্নানসহ বেশ কয়েকজন চাষি।
আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কীটনাশক ছাড়াই ভেষজ ও জৈব পদ্ধতিতে বিদেশি সবজি চাষ করছেন। এসব সবজি বগুড়ার টাচ অ্যান্ড টেক নামে একটি চেইন শপ কিনে নিচ্ছে।
খবর রাখে না কৃষি বিভাগ
কৃষকের দেওয়া তথ্যমতে, বগুড়ায় বছরে গড়ে ৪০০ মেট্রিক টন বিদেশি সবজি উৎপাদন হচ্ছে। তবে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, জেলায় বিদেশি সবজি উৎপাদন হচ্ছে বছরে ১৫০ মেট্রিক টন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বগুড়ার উপপরিচালক প্রতুল চন্দ্র সরকার প্রথম আলোকে বলেন, জেলায় বিদেশি সবজি চাষে আগ্রহ বাড়লেও এখনো সেভাবে বিদেশি সবজির বাজার তৈরি হয়নি। কৃষি বিভাগ বিদেশি সবজিচাষিদের পরামর্শ ও উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে।