পারভীন হাসান সেন্ট্রাল উইমেন’স ইউনিভার্সিটির উপাচার্য। বিজয়ের এই মাসে তিনি বলেছেন বাঙালির জাতিচেতনার ইতিহাস, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিভিন্ন দিক এবং সমাজকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করার গুরুত্ব নিয়ে। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ।
সাজ্জাদ শরিফ: আগামী বছর মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী। সময়টা নিজেদের দিকে ফিরে তাকানোর বড় এক উপলক্ষ নিয়ে এল। পূর্ববঙ্গের বাঙালি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করল। বাঙালিত্বের ধারণাটিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
পারভীন হাসান: এই উপমহাদেশে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে একটি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে। ধর্ম আর ভাষা—বাংলাদেশ ভূখণ্ডে এই দুটো ছিল আমাদের জাতিবোধের মূল উপাদান। কোনো সময় একটি অগ্রাধিকার পেয়েছে, কোনো সময় অন্যটি। একটি ভুল, আরেকটি নির্ভুল—মোটা দাগ কেটে সেটি বলা যায় না। কথা হলো বাঙালি কে? যে বাংলায় কথা বলে, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্মবোধ করে, সে-ই বাঙালি। তবে ইতিহাসে আমরা দেখেছি, জাতীয়তাবাদ বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এই ধরুন, আধুনিক কালে জীবিকার কারণে বহু বাঙালি অন্য দেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে চলে যান। তাঁদের মনের গভীরে দেশ বলতে কিন্তু বাংলাদেশ থেকে যায়। তাঁরা অনেকেই ভাবেন, একদিন ফিরে আসবেন বাংলাদেশে। পরের প্রজন্মকে তাঁরা বাংলা নাচ-গান শেখান, যাতে কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে একটা যোগসূত্র থাকে। এই যে একটি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থাকার একটি তৃষ্ণা, এটাও তো সত্যি। তিনি অন্য একটি রাষ্ট্রের নাগরিক, কিন্তু তাঁর মন বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত। জাতীয়তাবাদকে আমরা অনেক সময় দেশপ্রেমের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলি। জাতিবোধের ধারণা যত বিস্তৃত করা যায়, ততই তো ভালো।
সাজ্জাদ শরিফ: বাঙালির নামে কবে থেকে এই জনপদের পরিচয় গড়ে উঠল? কবে থেকে এই জনপদের মানুষ নিজেদের বাঙালি বলে চিনতে শুরু করল?
পারভীন হাসান: একেবারে সুনির্দিষ্ট সময় ধরে তো এটা বলা কঠিন। তবে ইতিহাসের যেসব উপাদান আমরা পাই, তাতে সুলতানি আমলকে ধরা যেতে পারে। যে সুলতানরা এখানে শাসন করতেন, তাঁরা ছিলেন বিদেশি, তুর্কি বংশোদ্ভূত। নিজেরা বাংলা বলতেন না, কিন্তু যাঁদের শাসন করতেন, তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন বাঙালি। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষায় অনেক চিরায়ত সাহিত্য প্রথমবারের মতো অনুবাদ করা হলো—যেমন রামায়ণ আর মহাভারত। লেখা হলো মনসামঙ্গলের মতো কাব্য। এসবের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার একটা সৌন্দর্য ও তাৎপর্য আমরা পেলাম। চতুর্দশ শতকে দিল্লির একজন ঐতিহাসিক বাংলার সুলতান ইলিয়াস শাহকে ‘শাহে বাঙ্গালিয়ান’ বলে উল্লেখ করলেন। মানে তাঁর পরিচয় হিসেবে বললেন যে তিনি বাঙালিদের রাজা। এটা হয়তো সে অর্থে জাতির পরিচয় নয়। বাংলা তখন ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত, কিন্তু এতে বাংলার একটা স্বীকৃতি আছে। পঞ্চদশ শতকে বাংলাদেশে আসা চীনা পর্যটক লিখেছেন, দরবারে তিনি কিছু লোককে ফারসি বলতে শুনলেও বেশির ভাগ লোককেই দেখেছেন বাংলা বলতে।
সাজ্জাদ শরিফ: এটা তো বাইরের দিক থেকে এই জনপদের একটা পরিচয়সূত্র। এই জনগোষ্ঠী ইতিহাসের কোন সময় থেকে জাতি হিসেবে নিজেকে বাঙালি বলে ভাবতে শুরু করল?
পারভীন হাসান: সেই সময়টাতে তো জাতিরাষ্ট্রের ধারণা ছিল না। এ ধারণার উন্মেষ উনিশ শতকে। ১৮৭২ সালে বাংলায় প্রথম বিজ্ঞানসম্মত একটা আদমশুমারি করল ইংরেজ শাসকেরা। তার ফল দেখে ওরা ঘাবড়ে গেল। মুঘলদের সুবা বাংলা ওরা বেঙ্গল প্রভিন্স হিসেবে যেভাবে পেয়েছিল, তাতে পুরো বাংলা ছাড়াও ছিল উড়িষ্যা, বিহারের অংশ আর আসাম। দেখা গেল, পূর্বাঞ্চলে মুসলমান জনগোষ্ঠীর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা। এর পরপরই আমরা দেখছি যে লর্ড কার্জন ১৯০৩ সালে তাঁর একটা নোটে লিখছেন, বাঙালিরা নিজেদের একটি জাতি হিসেবে ভাবতে ভালোবাসে, আর তারা স্বপ্ন দেখে একদিন কোনো বাঙালি বাবু এই গভর্নর জেনারেলের গদিতে বসবে। আমার মনে হয়, ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’Õবা ‘বিভক্ত করো আর শাসন করো’ নীতিটা এখান থেকেই শুরু। তারা ভাবল, বাঙালিদের একত্র থাকতে দিলে এরা এত মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে যে ওদের আর সামলানো যাবে না। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন যখন ভাইসরয়, আমরা দেখব তখনই বাংলা ভাগ করা হলো। কেন? বলা হলো, পূর্বের অঞ্চলগুলো পশ্চাৎপদ। পশ্চিমের অঞ্চলগুলোর সমকক্ষ করার জন্য ঢাকাকে রাজধানী রেখে একে আলাদা একটা রাজ্য করা হবে। পশ্চিমবঙ্গের অভিজাত শ্রেণির মাথায় বাজ পড়ল। কারণ, ঢাকা তখন নেহাত একটি মফস্বল শহর। এখানে নীল বা লবণের মতো নানা পণ্য এসে জমা হতো। তারপর কলকাতা হয়ে বিভিন্ন দেশে চলে যেত। কলকাতা তখন সারা ভারতবর্ষের ঝলমলে একটা রাজধানী। সেই রাজ্য অর্ধেক করে এখানে রাজধানী হবে, সেটা তাদের সহ্য হলো না। পূর্ব বাংলার মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠরা কারা? তাঁরা কৃষক, মূলতই রায়ত। পূর্ব বাংলার অভিজাত হিন্দু শ্রেণির লোকেরা কলকাতায় ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। দেশের বাড়িতে কালেভদ্রে আসতেন পুজোর ছুটিতে বা খাজনা তুলতে। তাঁদের নায়েবরা ওই মুসলমান প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা তুলে রাখতেন।
সাজ্জাদ শরিফ: আমরা আবার বাঙালির জাতিচেতনার কাছে ফিরি। ইংরেজের উপনিবেশের মধ্যে বাঙালির জাতিচেতনার উন্মেষ হলো। এই জাতিচেতনার নির্মিতিতে বাঙালি হিন্দুরা অংশ নিলেন, কিন্তু মুসলমানরা নয়। এই বিচ্ছিন্নতার কারণ কী ছিল?
পারভীন হাসান: ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ, আর ১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ—দুটো ঘটনা এ ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। পশ্চিমবঙ্গের বিক্ষুব্ধ শিক্ষিত হিন্দুশ্রেণির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা স্বদেশি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তার একটি অবয়ব গড়ে ওঠে। সে আন্দোলনের ভাষা, চিহ্ন আর প্রতীক ভীষণভাবেই ছিল হিন্দুধর্মসম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। এদের অনেকে কালীপুজো করে মাঠে নামত। এ ছাড়া ধরুন, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম’ স্লোগান জনপ্রিয় হয়ে উঠল। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে এ নিয়ে ছিল বিরূপ প্রতিক্রিয়া। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গমাতার যে ছবি আঁকলেন, তার রূপ দেবীমূর্তির। মুসলমানদের এর সঙ্গে একাত্ম হওয়ার পথ থাকল না।
সাজ্জাদ শরিফ: এ তো গেল রাজনৈতিক বিভাজন। এর আগে কি কোনো সামাজিক বিভাজনও ঘটেছিল, যার কারণে মুসলমানরা বিচ্ছিন্ন বোধ করল? মুসলমানদের মধ্যেও কি কোনো একাত্মতা ঘটেছিল?
পারভীন হাসান: মুসলিম সম্প্রদায়কে আমরা যে রকম এককাট্টা একটা গোষ্ঠী বলে ভাবি, সেটাও কিন্তু ছিল না। তাদের মধ্যেও নানা বিভাজন ছিল। এমনকি ইসলামে বর্ণপ্রথা নিষিদ্ধ হলেও তাদের মধ্যে অনেকটা বর্ণাশ্রমের মতোও ছিল, আশরাফ-আতরাফ ভেদ ছিল। আশরাফ বা অভিজাতদের মধ্যেও অনেক ধাপ ছিল। কারা পশ্চিম থেকে এসেছে, পশ্চিম থেকে সেখানকার মেয়ে বিয়ে করে এসেছে, কে কত পুরুষ ধরে মুসলমান—এ ধরনের বিভাজন ছিল। হিন্দুসমাজের নিম্নবর্ণের মতো সদ্য ধর্মান্তরিত মুসলমানদেরও হেয় গণ্য করা হতো। মুসলিম লীগ কোথায় হলো? ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর বাড়িতে। এই অভিজাত শ্রেণি কি বাংলাদেশের সাধারণ মুসলমানদের প্রতিনিধি? ইংরেজ শাসকেরা কংগ্রেসের বিপরীতে অনেকটা সান্ত্বনার মতো ওদের আরেকটা দল করে দিল।
সাজ্জাদ শরিফ: আবুল হাশিমের স্মৃতিকথায় আছে যে তাঁর রাজনীতির প্রধান একটা সংকল্প হলো মুসলিম লীগকে নবাববাড়ি থেকে বের করে সাধারণ মানুষের কাতারে নিয়ে যাওয়া।
পারভীন হাসান: শায়েস্তা ইকরামুল্লাহর ‘ফ্রম পর্দা টু পার্লামেন্ট’ বইয়েও অভিজাত ও সাধারণ মুসলমানদের বিভাজন সুন্দরভাবে এসেছে। বিশ শতকের প্রথম দিকে যে বাঙালি মুসলমান সমাজের আড়মোড়া ভাঙতে লাগল, তার সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত। যেমন ছাপাখানার সুযোগ। ‘সওগাত’ বা ‘নবনুর’—এ রকম অনেক সাময়িকী তখন বের হলো। মেয়েদের বলা হলো, তোমরা এসো, লেখো। তার মধ্যে রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের তো বিরাট ভূমিকা।
সাজ্জাদ শরিফ: আপনি বললেন যে বঙ্গভঙ্গ এবং এর পরের উত্তেজক রাজনীতি বাঙালির দুই ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে গাঢ় ভেদরেখা এঁকে দিল। বাঙালি মুসলমানের মনে হলো, এই বাঙালিত্ব আমার নয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হলো। কিন্তু ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২—মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে বাঙালি মুসলমানের জাতীয়তাবাদের কেন্দ্র বদলাতে শুরু করল। এত বড় একটা জনগোষ্ঠী কী করে এত দ্রুত জাতিচেতনার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাত্রা শুরু করল?
পারভীন হাসান: ওই যে বঞ্চিত জনগোষ্ঠী, যারা পাকিস্তানের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তাদের ছিল সাংঘাতিক একটা স্বপ্ন। তারা তো ছিল বঞ্চিত কৃষক। তারা স্বপ্ন দেখেছিল, স্বপ্নের দেশ পাকিস্তানে সবকিছু পাল্টে যাবে। জমিদারদের শোষণ থাকবে না। তারা পেট পুরে খেতে পারবে। সেই পরিবর্তন তো এল না। উপরন্তু, পাকিস্তান হওয়ার প্রায় পরপরই পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু মানুষ শুনতে পেল, দেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হতে যাচ্ছে উর্দু। লেখাপড়া জানা বাঙালি মুসলমানের সেটা ছিল প্রথম স্বপ্নভঙ্গ—আমরা এমন কী রাষ্ট্র করলাম, যেখানে নিজের মাতৃভাষাটাও রাষ্ট্রভাষা হবে না। আস্তে আস্তে বেরিয়ে এল যে ধর্মের বন্ধনই একমাত্র বিষয় নয়, সাংস্কৃতিক মুক্তি বা অর্থনৈতিক মুক্তি অসম্ভব জরুরি। এগুলো থেকে বঞ্চিত হলে মানুষ টিকে থাকতে পারে না। এই বঞ্চনার উপলব্ধি আরও গভীর হলো। ১৯৫২ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত উপলব্ধিটা এ রকম একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছাল যে পাকিস্তানের সঙ্গে একত্রে থাকার আর কোনো উপায়ই রইল না। কারণ বাঙালি দেখল, তারা সবদিক দিয়ে শোষিত হচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানও কার্যত একটা উপনিবেশ।
সাজ্জাদ শরিফ: কোনো কোনো তাত্ত্বিক বলতে চান, জাতি একটি কল্পিত জনগোষ্ঠী। একেক গোষ্ঠী একেক কল্পনা দিয়ে নিজেদের একাত্মতা গড়ে তোলে—কেউ ভাষা, কেউ ধর্ম, কেউ হয়তো দীর্ঘ ঐতিহাসিক বা সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা। আবার একই মানুষের যে একসঙ্গে একাধিক আত্মপরিচয় থাকতে পারে, সেটাও সত্য। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, বাঙালি আর মুসলমান—এই দুই পরিচয় কি পরস্পরবিরোধী? নাকি এই দুই পরিচয়ের সহাবস্থান সম্ভব?
পারভীন হাসান: আমি নিজে বিশ্বাস করি, এই দুটি পরিচয়ের মধ্যে সংঘর্ষের কিছু নেই। কারণ, একটা হচ্ছে আমার সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত পরিচয়। আমি কীভাবে জীবন যাপন করি, কীভাবে বাইরের জগতের সঙ্গে আদান-প্রদান করি, সেটা থেকে লোকে আমার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য বুঝতে পারে। আরেকটা আমার ধর্মীয় পরিচয়। এটা একান্ত ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমার এ অধিকারগুলো থাকা আবশ্যক। এ দুটোর সহাবস্থানে তো কোনো সমস্যা নেই। এদের মধ্যে সংঘর্ষ হওয়ারও কোনো কারণ দেখি না। তবু যে হচ্ছে, তার কারণ একেবারে শতভাগ রাজনৈতিক। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা যা কিছুর স্বপ্ন দেখেছিলাম, তার মধ্যে একটি ছিল সেক্যুলারিজম। সাধারণভাবে ইংরেজি এই শব্দটির অর্থ ধরা হয় ইহজাগতিকতা। বাংলাদেশের সংবিধানে সেক্যুলারিজম হয়ে গেল ধর্মনিরপেক্ষতা। দুটো অর্থই আমাদের জন্য প্রযোজ্য। ধর্ম আর রাষ্ট্র আলাদা থাকবে। ধর্ম নিয়ে রাষ্ট্র কিছু করবে না। কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতি ঝুঁকে পড়বে না। নাগরিকেরা নিজের নিজের বিশ্বাস অনুযায়ী যার যার ধর্ম পালন করার অধিকার রাখবে। রাষ্ট্রের এখানে কিছু বলার থাকবে না। আমাদের সেক্যুলারিজম একটা দ্বিধার মধ্যে পড়ে গেছে। একদিকে বলছি, আমরা ধর্মনিরপেক্ষ। আবার বলছি, আমাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। আমাদের নিজেদের মধ্যে এগুলো পরিষ্কার হওয়া দরকার।
সাজ্জাদ শরিফ: বাঙালি শব্দটারও কি আলাদা আলাদা তাৎপর্য হতে পারে। ধরুন, উনিশ শতকের কলকাতার বাঙালি আর মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া পূর্ববঙ্গের বাঙালির জাতিচেতনার ধারণাটা কি এক? কিংবা বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের মানুষের বাঙালির ধারণা কি অভিন্ন?
পারভীন হাসান: দেখুন, বঙ্গভঙ্গের সময় যা ছিল পূর্ববঙ্গ, সেটাই পরে হলো পূর্ব পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ হলো। কোনো দিন এ দাবি ওঠেনি যে দুই বাংলার বাঙালি এক হয়ে যাব। ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের বহু কিছুতে আমাদের অভিন্ন উত্তরাধিকার আছে। আবার অনেক কিছু যে ভিন্ন, সেটাও সত্য। দৈনন্দিন জীবন ও সংস্কৃতির এমন কিছু উপাদান আছে, যেগুলো ধর্মের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। আমরা কী খাই, কী পোশাক পরি, কী ধরনের শব্দ ব্যবহার করে কথা বলি—এসবের ওপরে তার ছায়া পড়ে; তা কোনো মানুষ সে ধর্ম পালন করুক, আর না-ই করুক। জাতিচেতনা গঠনে সংস্কৃতি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস। সংস্কৃতি কেউ জবরদস্তি করে চাপিয়ে দিতে পারে না। এটা একটা বহমান ধারা। এটা নিজে নিজে পাল্টায়, ভেতর থেকে। ২০ বছর আগে আমরা যেমন ছিলাম, এখন সে রকম নেই। দেশে যখন প্রথম ব্যান্ড মিউজিক এল, আমাদের সংস্কৃতিসচেতন মানুষ এটাকে অপসংস্কৃতি বলেছেন। এখন তো এটা আমাদের সংস্কৃতির অংশ। এভাবে ধীরে ধীরে জাতির বৈশিষ্ট্যও পাল্টাতে থাকে।
সাজ্জাদ শরিফ: আপনার কথায় দুটো বিষয় পাচ্ছি। প্রথমত, গণতন্ত্রে রাষ্ট্র আর ধর্ম আলাদা হওয়া জরুরি, তবে বোঝা দরকার যে সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ধর্ম। দ্বিতীয়ত, জাতিচেতনাও ক্রমে বিবর্তিত হতে থাকে। আপনার কি মনে হয় আমাদের সমাজকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করার জন্য আমাদের জাতিচেতনার ধারণা আরও প্রসারিত করা দরকার?
পারভীন হাসান: প্রসারিত করা আবশ্যক, কারণ সংস্কৃতি কালে কালে নানা কারণে নিজে থেকেই বদলাতে থাকে। যেমন দেখুন, পুরুষেরা বহু আগেই লুঙ্গি বাদ দিয়ে শার্ট-প্যান্ট ব্যবহার শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু নারীরা শাড়ি ছেড়ে দেয়নি। পাকিস্তানি আমলে আমরা যখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন বেশির ভাগ ছাত্রী শাড়ি পড়ত, সালোয়ার-কামিজ পরত না। শাড়িই ছিল বাঙালি মেয়েদের স্বাভাবিক পোশাক। সালোয়ার-কামিজ পরত সাধারণত পশ্চিম পাকিস্তানিরা। এখন তো বাংলাদেশে মেয়েরা চলাফেরার স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য সালোয়ার-কামিজই পরছে। নিজে নিজেই ব্যাপারটা পাল্টে গেছে।
সাজ্জাদ শরিফ: বাঙালি ছাড়াও বাংলাদেশে কিছু সংখ্যালঘু জাতিসত্তা আছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রত্যয় কি তাদের নিয়ে জাতিগঠনে কোনো টানাপোড়েন তৈরি করে? এর সমাধান কোথায়?
পারভীন হাসান: সব রাষ্ট্রেই, সব জায়গাতেই সংখ্যাগুরুদের কারণে ভীষণ একটা চাপ থাকে। কিন্তু এটা ভুললে তো চলবে না যে বাঙালি নিজেই একটা মিশ্র জাতি। এ জন্যই জাতীয়তাবাদ শব্দটার মধ্যে একটা শঙ্কা কাজ করে। আগেই বলেছি, আমরা অনেক সময় জাতীয়তাবাদকে দেশপ্রেমের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলি। বাঙালি ছাড়াও এ দেশে বহু রকমের মানুষ আছে। ১৯৭১ সালের পর অনেক উর্দু ভাষাভাষী মানুষ বাংলাদেশে থেকে যায়, পাকিস্তানে যায়নি। আধুনিক গণতন্ত্রে মানুষের যত মিশ্রণ হবে, ততই বৈচিত্র্য, ততই ভালো। একই মণ্ডলে থেকে বৈচিত্র্যহীন একটা সমাজ আমরা কেন চাইব? যত বেশি অন্য রকম লোক থাকবে, অন্য আরও ভাষা ও সংস্কৃতি থাকবে, ততই একটি দেশের সৌন্দর্য বাড়বে। দেশ পরিচালিত হবে তার শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে। সংবিধানে প্রত্যেক নাগরিকের শিক্ষা, চাকরি, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান আর জীবিকার যে অধিকার দেওয়া আছে, রাষ্ট্র তো তার কোনোটাই আমাদের নিশ্চিত করে না। কিন্তু এ অধিকার বাঙালির যতটা, পাহাড়ি মানুষটারও ঠিক ততটাই। দেশে একটা সংবিধান আছে। আমরা এটাকে সংশোধিত করতে করতে আদিরূপ থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। তবু সেখানে যে অধিকারগুলো দেওয়া আছে, সেগুলো অন্তত সবার জন্য নিশ্চিত করা উচিত। সেটুকু তো আমাদের করতেই হবে। আমাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হবে। পাকিস্তানিরা আমাদের সঙ্গে যা করেছে, আমরা কি অন্যদের সঙ্গে তা-ই করব? একেবারেই নয়। বাঙালি মুসলমানরা সংখ্যাগুরু। সবাইকে গ্রহণ করার জন্য তাই আমাদেরই এগিয়ে যেতে হবে। সবাইকে নিয়েই তো আমরা জাতি আর দেশ গঠন করব।