
বোমা মেশিনসহ নিষিদ্ধ সব যন্ত্রপাতি দিয়ে অপরিকল্পিতভাবে পাথর উত্তোলনে বিনষ্ট হচ্ছে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংয়ের পরিবেশ-প্রকৃতি। গতিপথ বদলে যাওয়া শুরু করেছে ডাউকি ও পিয়াইন নদের। নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে চা-বাগান, স্কুল ও ঘরবসতি। মাটির তলদেশ থেকে পাথর তুলতে গিয়ে মাটি ধসে প্রাণহানি ঘটছে শ্রমিকের।
প্রকৃতি ও মানুষের এমন ক্ষয়ক্ষতি মাথায় রেখে জাফলংকে প্রতিবেশ-সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করা হয়েছে। ১৮ ফেব্রুয়ারি এ ঘোষণার দুই বছর পূর্ণ হয়। সম্প্রতি জাফলং গিয়ে দেখা গেছে, ঘোষণা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সে অনুযায়ী স্থানীয় প্রশাসন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে জাফলংয়ের দুরবস্থারও কোনো পরিবর্তন নেই। গত রোববারও চুনাপাথর তোলার সময় গর্ত ধসে দুই শ্রমিকের মৃত্যু হওয়ায় ঘোষণা বাস্তবায়ন আবারও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত ২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জাফলংকে ইসিএ ঘোষণা করে। ভারতের ডাউকি নদ ও বাংলাদেশের পিয়াইন নদের মিলনস্থল জাফলং। পাহাড়, নদী, সবুজ প্রকৃতি মিলিয়ে জাফলং দেশে-বিদেশিদের কাছে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র। সারা বছরই এখানে পর্যটকদের ভিড় থাকে।
জেলা প্রশাসনের ভূমি-সংশ্লিষ্ট শাখা সূত্রে জানা গেছে, জাফলংয়ের ১৮৮ দশমিক ৭০ হেক্টর জায়গা পাথরকোয়ারি (পাথর উত্তোলনস্থল) চিহ্নিত করে ইজারা-ব্যবস্থার মাধ্যমে ১৯৮০ সাল থেকে পাথর উত্তোলন শুরু হয়। শুরুতে সনাতনপদ্ধতিতে এ কাজ চললেও প্রায় এক দশক ধরে শুরু হয়েছে যন্ত্র ব্যবহার। এর মধ্যে মাটির গভীর থেকে পাথর উত্তোলনে ব্যবহার করা হচ্ছে বোমা মেশিন। এ যন্ত্র নিষিদ্ধ করা হলেও ব্যবহার বন্ধ হয়নি।
জাফলংয়ের বাসিন্দারা বলেন, সনাতনপদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হতো না। কিন্তু কম সময়ে বেশি পাথর তুলতে অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা ২০০৯ সালের দিকে কোয়ারিতে বোমা মেশিন আমদানি করেন। এ যন্ত্র দিয়ে পাথর তোলায় জাফলংয়ের পরিবেশ নষ্ট হয়ে পড়েছে। ওই বছরই বেলার রিটের ফলে বোমা মেশিন নিষিদ্ধ করেন উচ্চ আদালত। তবে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে এ যন্ত্রের ব্যবহার অবাধে চলতেই থাকে। অবশ্য মাস তিনেক আগে প্রশাসনের তৎপরতায় বোমা মেশিনের ব্যবহার বন্ধ হলেও তা কত দিন টিকবে, তা নিয়ে সংশয় আছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কোনোভাবেই এই মেশিনকে আর কোয়ারিতে ফিরে আসতে দেওয়া হবে না। বোমা মেশিন রুখতে শিগগিরই অভিযান পরিচালনা করা হবে। কোনো অবস্থাতেই জাফলংকে বিনষ্ট হতে দেওয়া হবে না।
বেলা সিলেট অঞ্চলের সমন্বয়ক শাহ শাহেদা আখতার বলেন, ঘোষণার প্রায় এক বছর পর ইসিএ সরকারি গেজেট আকারে প্রকাশ হলে স্থানীয় প্রশাসন জাফলংয়ের পাথর উত্তোলনে ইজারা কার্যক্রম স্থগিত করে। কিন্তু ইসিএ ঘোষিত পদক্ষেপ বাস্তবায়নে গত দুই বছরে কার্যকর কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, পিয়াইন নদের তীরে বোমা মেশিন চলায় জাফলং চা-বাগানের প্রায় ৩০০ একর ভূমি এরই মধ্যে ধসের মুখে পড়েছে। বোমা মেশিন চালানোর ফলে কোয়ারি এলাকায় সৃষ্ট গর্তে পড়ে গত ২ বছরে ১০ জন শ্রমিক মারা গেছেন। এখন বোমা মেশিন না চললেও একধরনের ‘শ্যালো মেশিন’ দিয়ে পাথর উত্তোলন চলছে। এটিও পরিবেশবিধ্বংসী যন্ত্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এদিকে বোমা মেশিনে পাথর উত্তোলন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর পর্যটকদের ভিড় ক্রমেই বাড়ছে। এ সুযোগে নদ দখল করে অন্তত দুই শতাধিক দোকানপাট গড়ে ওঠায় সেখানকার ভূপ্রকৃতি ও পরিবেশ কিছুদিনের মধ্যেই আবার সংকটে পড়বে বলে স্থানীয়দের আশঙ্কা।
ইসিএ ঘোষণার দুই বছরেও জাফলংয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া প্রসঙ্গে সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. রাহাত আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কয়েক দিন আগে সিলেটে যোগদান করেছি। তবে এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে ইউএনওসহ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করেছি। পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষার স্বার্থে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’