করোনা-কালের জীবনগাথা-৩৪

তবু ফুল ফুটবে শহরে

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo.com

পৃথিবীর সব শহরের মতো তায়েফ শহরও অবরুদ্ধ। দেশে বার্ষিক ছুটি শেষ করে এ শহরে ফিরেছি দু মাস আগে। তখনো সৌদি আরবে করোনার এত বিস্তার ঘটেনি। ফিরে আসার পর ধীরে ধীরে পুরো চিত্র বদলে গেল।

এবারের ছুটিতে একসঙ্গে অনেক দেশে পা রেখেছিলাম—বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া। ফিরতি পথে আবার ঢাকা হয়ে কর্মস্থল সৌদি আরবে। করোনা বিস্তারের আগে আগে অনেকেই বিভিন্ন দেশে গিয়ে আটকা পড়েছেন। আমার সেই দুর্ভাগ্য হয়নি। ১৪ মার্চ ঢাকা থেকে এসে রিয়াদ বিমানবন্দরে নেমে শুনলাম, সে রাত থেকেই সব দেশের সঙ্গে সৌদি আরবের বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আর এক দিন দেরি করলেই আমাকে দেশে আটকে থাকতে হতো।

বিমানবন্দরে নেমেই হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পেলাম তায়েফ ডেন্টাল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. হাসান আল ইয়ামানির। জানিয়েছেন পরদিন কর্মস্থলে না এসে ১৪ দিন বাসায় বিচ্ছিন্ন থাকতে। সঙ্গনিরোধের এ দিনগুলো ছিল আতঙ্কময়। মনে হতো, এই বুঝি করোনার উপসর্গ দেখা দিল। এ–ও ভাবছিলাম, করোনার উপসর্গ দেখা দিলে কর্মস্থলের সবাই ভাববে, আমি বাংলাদেশ থেকে ভাইরাস নিয়ে এসেছি। প্রার্থনা করছিলাম, আমার দেশের দুর্নাম যেন না হয়। সঙ্গনিরোধের কাল শেষ হওয়ার পরেও কর্মস্থলের লোকেরা আশ্বস্ত হতে পারল না। আমাকে বলল আরও ১০ দিন বাসায় থাকতে। সে সময় পার করে কাজে যোগ দিলাম।

আমাদের হাসপাতালে জরুরি রোগী ছাড়া অন্য রোগী দেখা হচ্ছে না। প্রবেশপথে বসানো হয়েছে ‘ভিজ্যুয়াল ট্রায়াজ’। আগতদের তাপমাত্রা দেখা হচ্ছে। হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে জীবাণুনাশী দ্রবণ। রোগীদের অপেক্ষাগৃহ ফাঁকা। রোগীর আনাগোনায় মুখর হাসপাতালের করিডর নীরব! অপেক্ষাগৃহে দুই চেয়ারের মাঝখানে একটি চেয়ার টেপ দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। শারীরিক দূরত্ব পালনের ব্যবস্থা। আমি আতঙ্ক নিয়ে ক্লিনিকে বসে থাকি। রোগী এলেই আঁতকে উঠি। করোনায় আক্রান্ত হচ্ছি না তো?

বাইরে কোথাও যেতে ভয়। স্থানীয় বাংলাদেশি গ্রোসারি শপে কেনাকাটার জন্য যেতে হয় বাধ্য হয়ে। ওখানে বাংলাদেশিদের ভিড় লেগেই থাকে। সামাজিক দূরত্ব মানছে না বাংলাদেশিরা। মাস্ক পরছে না অনেকেই। কেনাকাটা করে ঘরে ফেরার পর আতঙ্ক—ভাইরাস বয়ে নিয়ে ফিরলাম না তো?

মসজিদের আজান কানে আসে। আজানে নতুন এক বাক্য যুক্ত হয়েছে, যার বাংলা তরজমা করলে দাঁড়ায়, ‘ঘরেই নামাজ পড়ুন।’ করুণ মনে হচ্ছে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠস্বর। হাজার বছরের চেনা সুরে অচেনা ছন্দ।

শহরে শুরু হলো কারফিউ। আমাকে কারফিউ পাস দেওয়া হলো। দায়িত্ব সেরে বাসায় ফেরার পথে দেখি সড়কে সড়কে নিরাপত্তাকর্মী। চারপাশে কেমন যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব! চেনা পথ কেমন অচেনা হয়ে উঠেছে। রোজার মাসে কারফিউ কিছুটা শিথিল করা হলো। দোকানপাট খুলল সীমিত পরিসরে। এক বিকেলে বেরোলাম। পাঁচ মিনিট গাড়ি চালিয়ে গেলাম আল আনুদ সুপারমার্কেটে। উল্টো দিকে আল আনুদ পার্ক। আগে বিকেলবেলায় যে পার্কে মানুষের ভিড় লেগেই থাকত, আজ সেটি ফাঁকা। পার্কের দেয়ালের পাশে এসে দাঁড়ালাম। সারি বাঁধা জারুলগাছে ফুল ফুটেছে। মনে পড়ল, বসন্ত এসেছে।

মে মাসে তায়েফের রুদ্দাফ পার্কে গোলাপ উৎসব। তার দুই মাস পর গ্রীষ্মে মওসম আত তায়েফ বা তায়েফ মৌসুম। স্যুক ওকাজ নামের জায়গায় বসবে তায়েফের লোক–ঐতিহ্য মেলা। কিন্তু কোথায় কী! করোনা নামের দৈত্য আমাদের বোতলবন্দী করে রেখেছে।

কিছু না ঘটুক, প্রকৃতি তবু অবিশ্রান্ত। তায়েফের পাহাড়ি উপত্যকায় ফুটবে বিখ্যাত ওয়ার্দা আত তায়েফ বা তায়েফের গোলাপ। পথপাশের বাগানবিলাস হয়ে উঠবে গোলাপি, পার্কের জারুল আরও নীল।

সিকদার নাজমুল হক, দন্ত বিশেষজ্ঞ, তায়েফ ডেন্টাল হসপিটাল, সৌদি আরব