পল্লী বিদ্যুতের খোলা তারের বিদ্যুৎ লাইন সংরক্ষিত বনের গাছগাছালির পাশ দিয়ে গেছে। এক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফ-ঝাঁপ করতে করতে বিদ্যুতের তারে ঝুলল একটি হনুমান। তার বেয়ে হনহনিয়ে একটি হনুমানকে যেতে দেখে আরও তিনটি অনুসরণ করল এটিকে। বিদ্যুতের তারে চারটি হনুমান খানিক খুনসুটিতে মেতে থাকল। এ দৃশ্য সিলেটের খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানের।বন্য প্রাণীর জন্য সংরক্ষিত জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে পল্লী বিদ্যুতের বিদ্যুৎবিহীন লাইনে প্রতিদিন এভাবেই খুনসুটিতে মেতে থাকে হনুমান। বিদ্যুৎ লাইন সচল করার তোড়জোড় শুরু হওয়ায় বিদ্যুৎ লাইনে খেলা করায় অভ্যস্ত হনুমানসহ বন্য প্রাণীর মৃত্যুঝুঁকির আশঙ্কা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।সিলেটের বনাঞ্চলে অনেকটা বিলুপ্ত হয়ে পড়া হনুমানের অবস্থান রয়েছে খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানের বনে। উদ্যানের বড়জান, খাদিম, ছড়াগাঁও এলাকায় হনুমানের বিচরণ দেখা যায়। বন বিভাগের পর্যবেক্ষণে এদের সংখ্যা শতাধিক হলেও স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, এ সংখ্যা দিন দিন কমছে। এখন ৩০ থেকে ৪০টি হনুমানকে বিভিন্নভাবে বিচরণ করতে দেখা যায়।সরেজমিনে গেলে এলাকাবাসী জানান, যেখানে বিদ্যুৎ লাইন রয়েছে, সেসব স্থান ঘিরে সকাল ও বিকেলে হনুমানের বিচরণ বেশি দেখা যায়।খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানে বন্য প্রাণী সংরক্ষণে ‘আইপ্যাক’ প্রকল্পের পর্যবেক্ষণ সূত্রে বেসরকারি সংস্থা সিএনআরএসের প্রকল্প সমন্বয়কারী সমীর চন্দ্র সমদ্দর বলেন, ‘সিলেট জেলার মধ্যে কেবল খাদিমনগর উদ্যানে হনুমানের বিচরণ দেখা যায়। বিদ্যুতের তার ও খুঁটি দীর্ঘদিন বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় রয়েছে। এতে করে তার ও খুঁটিতে খেলা করতে হনুমান অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। কোনো সতর্কতা ছাড়া হঠাৎ বিদ্যুৎ লাইন চালু করা হলে হনুমানগুলো বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে নির্ঘাত মারা পড়বে।’আইপ্যাক প্রকল্পের পৃষ্ঠপোষকতায় এলাকাবাসীকে নিয়ে গঠিত ‘উদ্যান সহব্যবস্থাপনা’ কমিটির সভাপতি মুহিবুল হক জানান, উদ্যানের এসব বিদ্যুৎ খুঁটি ও তারে প্রায় প্রতিদিনই অন্তত ২০ থেকে ২৫টি হনুমানকে খেলা করতে দেখা যায়। বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হলে সবার আগে হনুমান মৃত্যুঝুঁকির মুখে পড়বে, এ আশঙ্কার কথা এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে বিভাগীয় বন কর্মকর্তাকে একটি স্মারকলিপির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। মুহিবুল বলেন, ‘উদ্যানে উন্মুক্ত তার দিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া উচিত হয়নি। বিদ্যুতের খোলা তার অপসারণ করে কনসিনযুক্ত বৈদ্যুতিক তার দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে।’বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বিভাগীয় বন কর্মকর্তার (ডিএফও) তদারকিতে সিলেট সদর উপজেলার খাদিমনগর এলাকায় ‘সংরক্ষিত জাতীয় উদ্যান’ ঘোষণার পর ২০০৫ সালে পল্লী বিদ্যুতের লাইন সম্প্রসারণ করা হয়। জাতীয় উদ্যানসহ খাদিমনগরের ছয়টি চা-বাগানের ওপর দিয়ে বিদ্যুতের এ লাইন সম্প্রসারণ করা হয়েছে খোলা (আচ্ছাদনবিহীন) বৈদ্যুতিক তার দিয়ে।সিলেট-২-এর অধীন পল্লী বিদ্যুতের সম্প্রসারণ করা লাইন সম্পর্কে জানা গেছে, উদ্যান মাড়িয়ে বড়জান, কালাগুল ও ছড়াগাঁও এলাকায় তিনটি ভাগে মোট ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বিদ্যুৎ লাইন সম্প্রসারণ করা হয় ২০০৫ সালের পরিকল্পনায়। কিন্তু পুরো লাইনে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়নি।উদ্যানে উন্মুক্ত তারের বিদ্যুৎ লাইনে সংযোগ দিলেই বন্য প্রাণীর প্রাণহানির আশঙ্কার বিষয়ে পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ অবহিত নয় জানিয়ে পল্লী বিদ্যুৎ-২-এর ব্যবস্থাপনা শাখার কর্মকর্তা (পরিদর্শক) দুর্জয় কুমার দাস বলেন, ‘প্রায় পাঁচ বছর আগে বিদ্যুৎ লাইন টানা হলেও গ্রাহক টাকা পরিশোধ না করায় সংযোগ বন্ধ ছিল। কালাগুল এলাকার গ্রাহকেরা টাকা দেওয়ায় সেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া শুরু হয়েছে।’সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আবুল বাশার মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘উদ্যানের ওপর দিয়ে খোলা তারে বিদ্যুৎ লাইন সম্প্রসারণ বন্য প্রাণীর বিচরণে মারাত্মক ঝুঁকির। পাঁচ বছর আগে কী পরিকল্পনায় উদ্যানের ওপর এ লাইন গেছে, তা আমি জানি না। তবে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে বিষয়টি অবহিত হওয়ায় আগামী সমন্বয় সভায় এ ব্যাপারে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’