ভূমির ভোগান্তি কমবে কি

দুই ভূমি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে তাদের গ্রেপ্তারের দাবিতে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বগুড়া শহরে মানববন্ধন করে ভুক্তভোগীরা। ফাইল ছবি
দুই ভূমি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে তাদের গ্রেপ্তারের দাবিতে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বগুড়া শহরে মানববন্ধন করে ভুক্তভোগীরা। ফাইল ছবি

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে মানুষ হয়রানি-নিপীড়নের অভিযোগ জানায়। ২০১৭ সালে আসা অভিযোগগুলো বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি বলছে, এককভাবে সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি এসেছে জমিজমা নিয়ে অনিয়ম আর ভোগান্তির কথা।

অনিয়ম-দুর্নীতির খবর সরাসরি জানার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ২০১৭ সালের মাঝামাঝি হটলাইন ‘১০৬’ চালু করেছিল। এ পর্যন্ত এই হটলাইনে ১৯ লাখ অভিযোগ এসেছে। এসব অভিযোগের মধ্যে সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধেই অভিযোগের সংখ্যা বেশি। এগুলোর মধ্যে ভূমি রয়েছে প্রথম দিকে। ভূমি ব্যবস্থাপনা ও সেবাদান নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ এন্তার। ভোগান্তির অভিযোগ আরও বেশি। জমিজমা সংঘাত-সংঘর্ষের বড় উৎস। ভূমিবিরোধ তাই অনেক মামলার জনক।

বিষফোড়ার মতো ঝুলে আছে লক্ষাধিক একরের অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণের বিষয়টি। এতে মূলত ভুগছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজন। দেশের এক-দশমাংশ এলাকা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম। সেখানে রক্তক্ষয়ী অতীতের জের টেনে চলেছে ভূমিবিরোধ। বিরোধ নিষ্পত্তির হাজার হাজার আবেদন পড়ে আছে।

আবার দেশজুড়ে ভূমির ব্যবহার, আগ্রাসন ও অধিগ্রহণ নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংকট আছে। দ্বন্দ্ব মূলত কৃষি বনাম শিল্প ও আবাসনের জন্য জমির ব্যবহার আর পরিবেশের সুরক্ষার প্রশ্নে।

ভোগান্তি-দুর্নীতি ও ডিজিটালকরণ
ভূমি নিয়ে ভোগান্তি আর দুর্নীতি একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। ভূমি কার্যালয় থেকে কাগজপত্র ওঠাতে গিয়ে, নামজারি করতে বা কর দিতে গিয়ে, হয়রানির শিকার হয় মানুষ। সনাতনী পদ্ধতি ভোগান্তি বাড়ায়।

ভূমি অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) উপনির্বাহী পরিচালক রওশন জাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের ভূমির কার্যালয়গুলো মানুষকে সেবার পরিবর্তে ভোগান্তি দেয়। ভূমিসংশ্লিষ্ট প্রতিটি কার্যালয়ই দুর্নীতির আখড়া। ভূমি বিষয়টি জটিল করে ফেলার ক্ষেত্রে এদের ভূমিকা আছে।’

সেবা নিতে গিয়ে হয়রানি ও দুর্নীতির শিকার হওয়ার চিত্র উঠে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বারকাতের এক গবেষণায়। ভূমি প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে ২০১৫ সালে করা এই গবেষণায় দেখা যায়, ভূমি কার্যালয়ে আসা প্রায় ৭০ শতাংশ সেবাগ্রহীতা অসন্তুষ্ট। দুই-তৃতীয়াংশ সেবাগ্রহীতা বলেছেন, ঘুষ দিতে বাধ্য হওয়াই তাঁদের অসন্তোষের কারণ।

দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গত বছরের একটি জরিপ বলছে, দেশের সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ তালিকায় ভূমির অবস্থান পঞ্চমে। জমিজমাসংক্রান্ত কাজ করাতে গিয়ে প্রায় অর্ধেক মানুষকে ঘুষ দিতে হয়।

ভূমি কার্যালয়গুলোতে দলিলপত্র নিতে গিয়ে মানুষ হয়রানির শিকার হয়। ভূমি অধিকার কর্মীরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে জমির মালিকানা বদল হলে সে তথ্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয় না। তখন ভূমি কার্যালয়ের অসাধু চক্রের সাহায্যে দুর্বৃত্তরা নথি জাল করেন।

এসব দুর্নীতি ও হয়রানি বন্ধ করতে ২০০৯ সাল থেকে অনলাইনে মালিকানা নিবন্ধন ও নামজারি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু এখনো তা পুরোপুরি সম্পন্ন করা হয়ে ওঠেনি। ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘এটা সময়সাপেক্ষ। তবে আমরা পথে আছি।’

ভূমি মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, এযাবৎ ৬১ জেলার রেকর্ডকক্ষে থাকা সাড়ে তিন কোটি খতিয়ানের এক-তৃতীয়াংশ অনলাইনে প্রকাশ করা হয়েছে। আর ৬১ হাজার মৌজার মধ্যে ১৮ হাজারের বেশি মৌজা ম্যাপ স্ক্যান করা হয়েছে। এ ছাড়া আটটি জেলায় ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করে জরিপ শুরু হয়েছে।

বিরোধ ও মামলা প্যাঁচ
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে বলেছেন, দেশে বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন মোট মামলার সংখ্যা প্রায় ৩৬ লাখ। এএলআরডির গবেষণা বলছে, দেওয়ানি ও ফৌজদারি মিলিয়ে মোট মামলার অন্তত ৬৫ শতাংশ ভূমিকেন্দ্রিক।

জমিজমা নিয়ে মামলা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে গড়ায়। জড়িত পক্ষগুলোর অনেক টাকা গচ্চা যায়। জমিজমাসংক্রান্ত বিরোধের আর্থসামাজিক ক্ষতি নিয়ে ২০১৪ সালে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) মিলে এক গবেষণা করেছিল। গবেষণায় ১ হাজার ৫০টি পরিবারের তথ্য নিয়ে দেখা যায়, প্রতি পাঁচটিতে একটির ভূমিসংক্রান্ত বিরোধ আছে। যেসব মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, সেগুলোতে গড়ে সাড়ে তিন বছর লেগেছে আর খরচ হয়েছে ৮০ হাজার টাকা। সর্বোচ্চ খরচ হয়েছে ১২ লাখ টাকা। বেশির ভাগ টাকাই গেছে উকিলের পেছনে।

গবেষণাটির পরিচালক পিআরআইয়ের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ৪৫ শতাংশ মালিকের জমির খারিজ বা নামজারি করা ছিল না। ফলে বিরোধ তৈরি হওয়া ছিল সহজ।

 জমির মালিকানা ও অন্যান্য বিরোধের মামলাগুলো দেওয়ানি আদালতে যায়। সে ধরনের মামলাই বেশি। তবে প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও ভূমিসংক্রান্ত কিছু মামলা বা বিরোধ নিষ্পত্তি করেন। এগুলো হচ্ছে খারিজ-নামজারি, জমির মূল্যায়ন, জমির অধিগ্রহণ আর চরের জমির মালিকানাসংক্রান্ত মামলা। নিষ্পত্তি করেন উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে ভূমি কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার (ভূমি) এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি রাজস্ব)।

একই জমির নামজারি করে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ এই কার্যালয়গুলো আর নিবন্ধন করে আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ রেজিস্ট্রি কার্যালয়। দুই কার্যালয়ের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই সমন্বয় নেই। বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন এইডে কর্মরত ভূমি গবেষক শমশের আলী বলছেন, এতে দুর্নীতির সুযোগ বাড়ে। অনেক সময় নামজারির কাগজ যাচাই না করেই নিবন্ধন করে দেওয়া হয়। নিবন্ধন ও নামজারি একই ছাতার নিচে হওয়া দরকার।

শমশের আলী মনে করেন, জেলা পর্যায়ে ভূমিসংক্রান্ত মামলা কালেক্টর (এডিসি-রাজস্ব বা ডিসি) থেকে ভূমি আপিল বোর্ডের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে জট কমবে। ভূমি ক্যাডারও আলাদা করা দরকার।

উপজেলার এসি ল্যান্ড মূলত জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা। সরাসরি একটি ভূমি ক্যাডার হলে দায়িত্বশীলতা বাড়বে বলে মনে করেন ভূমিমন্ত্রী নিজেও। তবে তিনি বলেন, এ নিয়ে শুধু কথাই চালাচালি হচ্ছে।

অর্পিত সম্পত্তি ও পার্বত্য ভূমি
অর্পিত সম্পত্তি আসল মালিককে ফিরিয়ে দেওয়া এই সরকারের বড় নির্বাচনী অঙ্গীকার। হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক মানুষের সম্পত্তি অর্পিত হিসেবে তালিকাভুক্ত থাকায় তাঁরা মালিকানা হারিয়েছেন।

২০০৮ সালেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার জমিগুলো প্রত্যর্পণের উদ্যোগ নেয়। এখন প্রত্যর্পণ বা ফেরতযোগ্য অর্পিত সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় সোয়া দুই লাখ একর। ফেরত পেতে ৬১টি জেলায় সোয়া লাখের কাছাকাছি আবেদন জমা পড়েছে। সাত বছরে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ১৫ হাজার।

তবে প্রত্যর্পণের গতি নিয়ে খুশি নন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, মাত্র ১২ শতাংশ আবেদনের নিষ্পত্তি হয়েছে। এই ধারা চলতে থাকলে আরও ৩০ বছর অপেক্ষা করতে হবে।

এদিকে ২২ বছর হতে চলল, পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার ও স্বায়ত্তশাসনকামী সশস্ত্র দলটির মধ্যে শান্তি চুক্তি হয়েছে। কিন্তু সেখানকার সবচেয়ে বড় সমস্যা পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে ভূমিবিরোধের বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত। চুক্তি অনুযায়ী ভূমি কমিশন গঠনের প্রক্রিয়ায় ও বিতর্কে অনেকটা সময় গেছে। আর ভূমিবিরোধ আইনটি সংশোধন হতে সময় লেগেছে প্রায় ১৬ বছর। বিধিমালা এখনো হয়নি।

ইটভাটার জন্য ফসলি জমি কেটে ফেলা হচ্ছে। ফাইল ছবি

গত বছর কমিশন নতুন করে গঠিত হয়েছে। ইতিমধ্যে কমিশনের কাছে ২২ হাজারের বেশি আবেদন জমা পড়েছে। চাকমা রাজা (সার্কেলপ্রধান) দেবাশীষ রায় কমিশনের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এর সদস্য। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘পাহাড়ের জটিল এবং ভিন্ন ধরনের ভূমি কাঠামোর পরিপ্রেক্ষিতে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে কেন জানি সুরাহার পথে বিঘ্ন দেখা দিচ্ছে।’

পাহাড়ি নেতারা ভূমিবিরোধ নিরসনে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গড়িমসির কথা বলেন। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং বলেন, ‘ঘণ্টায় যে পরিমাণ দৌড়ানো উচিত, তার চেয়ে বেশি এগোচ্ছি।’

 এমনিতে বাংলাদেশে মাথাপিছু ভূমির পরিমাণ বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, এটা শূন্য দশমিক ৬ হেক্টর। তার ওপর সরকারি হিসাবে বছরে কৃষিজমির পরিমাণ কমছে এক শতাংশ হারে। কৃষিজমিতে আগ্রাসী ও অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও আবাসন অথবা খাসজমি দখলের মতো সমস্যা আছে। ভূমি ও পরিবেশের দূষণ এরই অনুষঙ্গী।

 তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যখন শিল্পের দরকার হচ্ছে, তখন চোখ পড়ছে ক্ষমতাহীন মানুষের জমির দিকে। ক্ষমতাবানদের হাতে থাকা দখলের জমি সরকারের দৃষ্টির বাইরে থাকছে।’

শেষ কথা
সব মিলিয়ে জমিজমার কাগজপত্র, জরিপসহ নাগরিককে সেবাদানের কাজটি ডিজিটাল করা গেলে অনেক সমস্যারই সুরাহার পথ তৈরি হতে পারে। সার্বিকভাবে দুর্নীতি কমানোরও সুবিধা হতে পারে। ধীর লয়ের ডিজিটালকরণকে দ্রুত এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে, তাই সরকারের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ। ভূমি ব্যবস্থাপনার ডিজিটালকরণ সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার। পাশাপাশি চাই ভূমি প্রশাসনের সংস্কার এবং মামলার পাহাড় কমানোতে ভূমিকা রাখা।

আরেকটি সার্বিক চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, আইন-নীতি মেনে ভূমির ব্যবহার নিশ্চিত করা। দুটি তাৎপর্যপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, অর্পিত সম্পত্তি আর পার্বত্য চট্টগ্রামে জমির মালিকানাসংক্রান্ত জটিলতা নিরসন।