
হজরত শাহ জালালসহ (র.) তিনশত ষাট আউলিয়ার পূণ্য স্মৃতি বিজড়িত অগণিত সুফি-সাধক ও কৃতি পুরুষের জন্মভূমি, জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী রত্নগর্ভা এই সিলেট। রূপসী বাংলার অপরূপ অলংকার পূণ্যভুমি সিলেটের নাম উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে চা বাগান, মনোরম টিলা, হাওর, নদী প্রভৃতির কথা মনে পড়ে। সুরমা-কুশিয়ারা-মনু-খোয়াই বিধৌত দুটি পাতা একটি কুড়ি'র সিলেট- ঘন সবুজ সমারোহের বনরাজি ঘেরা মনোরম নি:সগের্র লীলাক্ষেত্র।
প্রায় ৫ হাজার বর্গ মাইলের ২ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশের প্রান্তিক জনপদ বৃহত্তর সিলেট জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে সম্পদ মেধা ও অবদানের নিরিখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পেট্টোল, গ্যাস, পাথরসহ প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর সিলেট। সবার ওপরে রয়েছে চির অভিযাত্রী দু:সাহসী মানব সম্পদ। যাদের বলা হয় বাংলাদেশের কলম্বাস।
এই সিলেটে জন্ম নিয়েছিলেন বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ও আলোকিত মানবিক চিকিৎসক মঈন উদ্দিন। বহু মানবিক গুনের অধিকারী প্রাণবন্ত ও বন্ধু বৎসল ডাক্তার মঈন স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে আছেন। ১৯৯৭ সালের আগস্ট মাসের ৫ তারিখ। রাত জেগে বৃটিশ বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের (বিবিআইএস) সিলেবাস ও রুটিন তৈরী করেছি। ফজর নামাজ শেষে একটু ঘুমাব বলে মসজিদ থেকে দ্রুত বাসায় ফিরছি। পেছন থেকে একটি মায়াময় আওয়াজ শুনলাম। সাংবাদিক সাব অতো তাড়া কিতা? বুঝতে অসুবিধা হয়নি এমন সুন্দর আওয়াজ ডাক্তার মঈনের।
কুশল বিনিময় করে বললেন, আসেন একটু হাটি। আমি যে সারারাত ঘুমাইনি তা আর বলতে পারিনি। পুরো সপ্তাহের স্বল্প ঘুমের ঘাটতি আজ পুরণের কথা ছিল। ভোরের হালকা শীতের আমেজে আমরা ছুটে চলি দর্শন দেউড়ি হয়ে সামনে দিকে। হজরত শাহ জালালের (র.) মাজার পাড়ি দিয়ে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠের প্রান্তে চলে আসি। রাস্তার পাশের চা বিক্রেতা মঈন ভাইয়ের পরিচিত বলে মনে হলো। দূর থেকে ডেকে বললেন, ডাক্তার সাব গরম গরম রুটি আছে। তিনিও কিছু না বলে আমাকে নিয়ে গেলেন সেখানে। তার শারিরিক অবস্থার খবর নিলেন। আমরা ওখানে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতে চা খেলাম।
দোকানদারের কাছে একটা বড় সাইজের টেপ রেকর্ডার ছিল। মঈন ভাই এইটা নিয়ে আমার সাথে নতুন আলোচনার সুত্রপাত করলেন। বললেন এটা কি জিনিস? আমি কায়দা করে বললাম, একটি শব্দ সংরক্ষণ যন্ত্র। আবার বললেন, এটা কে এবং কিভাবে আবিষ্কার করেছে? বললাম, আমেরিকান প্রকৌশলী ওবারলিন স্মিথ ১৮৭৭ সালে টেপ রেকর্ডারের মূল নকশা তৈরি করেন। ১৮৯৮ সালে ডেনিস প্রকৌশলী ভ্লাদিমার পলসন আরেকধাপ উন্নয়ন সাধন করেছেন। তবে এই শব্দ সংরক্ষণ শিল্পের বাণিজ্য করণ ও অধিক ব্যবহার শুরু হয় ১৯৩০ সালে বিএএসএফ (BASF) নামের জার্মান কোম্পানির মাধ্যমে। ১৯৩৫ সালে বার্লিন রেডিও শোতে পূর্ণাঙ্গ টেপ রেকর্ডার প্রদর্শনী হয়।
মঈন ভাই বললেন, আমি জানতাম একটা বৃত্তান্ত আপনার কাছে পাব। আজ বন্ধুদের কাছে এ নিয়ে কথা বলব। একটা নতুন কিছু নিয়ে আলোচনা। তবে আপনার তথ্য স্বীকৃতি অবশ্য দেওয়া হবে। চা পানের সময় চা বিক্রেতা টেপ রেকর্ডারের বোতাম টিপছেন। তখনকার সময়ে খাবারের দোকানে গ্রাহকদের মনোরঞ্জনের জন্য টেপ রেকর্ডারে উচ্চ স্বরে গান বাজানোর রেওয়াজ ছিল। হঠাৎ বেজে ওঠলো একটি গান- দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না/ সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি। /কান্না-হাসির বাঁধন তারা সইল না / সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।
আজ ডাক্তার মঈন না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তবে স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে আছে তার সেই দিনগুলো। জীবনের সব ঘটনাবলী যান্ত্রিক মাধ্যমে রেকর্ড না হলেও স্মৃতির টেপে রেকর্ড হয়ে আছে।
চা খেয়ে আমরা শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের (সদর হাসপাতাল) সামনে চলে আসি। ডাক্তার মঈনকে কিছুটা আনমনা দেখে একটু পুলকিত করবার চেষ্টা করি। সিলেট শহরের চৌহাট্টা এলাকায় অবস্থিত সরকারী আলিয়া মাদ্রাসাকে আমরা মজা করে চৌহাট্টা ইউনিভার্সিটি বলতাম। এ বিষয়ে চৌমুহনীতে দাঁড়িয়ে একটা রসালো স্মৃতি বললাম। মঈন ভাই আবারো প্রাণবন্ত হলেন। একটু পরে জানতে চাইলাম, কিছুক্ষণ আগে অন্য মনস্ক ছিলেন বলে মনে হল? বললেন, টেপ রেকর্ডারের কথাগুলো মাথায় খেলছে। এটা যে আবিস্কার করেছে সে নিশ্চয়ই কোরআন-হাদিস পড়েছে। না হয় কিরামান কাতেবিনের মতো আমল নামা রেকর্ডের আইডিয়া তার মাথায় আসল কিভাবে। তার চিন্তার গভীরতায় মুগ্ধ হলাম।
মঈন উদ্দিন ভাই বললেন, রৌদ্রস্নাত ফুরফুরে সকালে গানটি শুনতে শুনতে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মহান স্রষ্টার অপরিসীম সৃষ্টি রহস্য মনের গহনে চলে এসিছিল। আমরা আল্লাহর কোন নিয়ামতকে অস্বীকার করতে পারি। চলার পথের স্মৃতির ভাঁজে ভাঁজে আজও অমলিন হয়ে আছে আমাদের সেই সব নানা রঙের দিনগুলি।
আজ অনেক খুজে পুরণো ডাইরির পাতাগুলো আবিষ্কার করলাম। সেদিন শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতাল (সদর হাসপাতাল) নিয়ে অনেক কথা বলেছিলেন ডাক্তার মঈন উদ্দীন। শুধু স্মৃতিচারণ নয়, স্বপ্ন চারিতা ছিল। একটা বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান গড়া সম্ভব বলে তার ধারণা ছিল।
মঈন ভাই মনে করতেন, মন্ত্রী-এমপি এবং আমলাদের বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ বন্ধ করতে পারলে দেশীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা মূল লক্ষ্যে পৌছতে দেরী হবেনা। বিলেতের হাজার হাজার মানুষ দ্রুত ও সুলভ মূল্যে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য ভারতে চলে যান। মঈন ভাই মনে করতেন সিলেট এর বিকল্প হতে পারে। প্রবাসী প্রধান এই সিলেটের সদর হাসপাতাল ও সন্নিকটস্থ ওসমানী মেডিকেল কলেজ যুক্ত হয়ে বিশ্বমানের চিকিৎসা সেবা দেওয়া সম্ভব।
মঈন ভাই সাইফুর রহমানের মত একজন সিলেট প্রেমীর অপেক্ষায় ছিলেন। যাকে তার স্বপ্নের কথা বলবেন। যখন সাইফুর রহমান অর্থমন্ত্রী তখন তিনি কিছু বলার মত দায়িত্বশীল অবস্থানে ছিলেন না। ড. এ কে আবদুল মোমেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়্ত্বি পাওয়ার পর এই স্বপ্ন পুরণ হবে বলে মঈন ভাই বেশ আশাবাদী হয়ে ওঠেছিলেন।
একজন মানবিক চিকিৎসক হিসেবে গরীব মানুষের জন্য পাগলপারা ছিলেন মঈন উদ্দীন । শহরে কিংবা গ্রামে সর্বত্র নামমাত্র মূল্যে কিংবা বিনামূল্যে চিকিৎসা দিতেন। সিলেটে ধনী লোকের জন্য একের পর এক প্রাইভেট হাসপাতাল হচ্ছে। কিন্ত গরীব মেহনতি মানুষের জন্য ভাল চিকিৎসার অগ্রগতি হচ্ছে না দেখে তার হৃদয়ে রোদন ছিল। মাঝে মাঝে বিপন্ন মানুষের অসহায়ত্ব দেখে তিনি কাঁদতেন। মনে হতো তার ভাই-বোন কিংবা সন্তান হারানোর বেদনায় তিনি আহাজারি করছেন।
আবেগের যুদ্ধে পরাজিত হলেও ডাক্তার মঈন আমাদের চেতনায় গাঢ় ছাপ রেখে রেছেন। বিস্মৃত হতে চাইলেও হওয়া যাবে না। স্মৃতির মেঠোপথ ধরে যাপিত জীবনের ধূসর মায়াজাল চিন্ন করে চলে গেছেন তিনি। তবে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশী মানুষের হৃদয়ে আকুতি সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন বলেই মনে হয়। আমাদের আবেগগুলো যেন পেছনে পড়ে না যায়। জটিল ও যান্ত্রিক জীবনের অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মব্যস্ততায় আমরা যেন গরীব মানুষের কথা ভুলে না যাই।
সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) দ্রুত নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্বমানের চিকিৎসা সুবিধা ও সর্বাত্তক প্রযুক্তি সম্বলিত নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স থাকতে হবে।
বৈশ্বিক মহামারি করোনা বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মতো বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। ভয়াবহ ঝুঁকিতে রয়েছে প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট। এখানে দ্রুত ও সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারলে কিছুটা হলেও ডাক্তার মঈনের আত্মা শান্তি পাবে।