বাংলার মিষ্টি

৩৫ জেলার মিষ্টির সমাহার

কাচের বাক্সে ভিন্ন ভিন্ন পাত্রে মিষ্টির নমুনা সাজানো রয়েছে। ছবি: প্রথম আলো
কাচের বাক্সে ভিন্ন ভিন্ন পাত্রে মিষ্টির নমুনা সাজানো রয়েছে।  ছবি: প্রথম আলো

একটি মিষ্টির দোকানের গল্প বলি। অন্য রকম, অনন্য সেই দোকান। কেন অন্য রকম? বলছি সে কথাই।

যাঁরা পাঁচ রাতব্যাপী উচ্চাঙ্গসংগীতের অনুষ্ঠান করেন, দেশ-বিদেশের ওস্তাদদের নিয়ে যাঁরা উচ্চাঙ্গসংগীতের বিদ্যালয় চালান, যাঁদের সংগ্রহে রয়েছে সেরা শিল্পীদের হাজার হাজার চিত্রকর্ম, বইয়ের প্রকাশনা আর সেই সঙ্গে রয়েছে যাঁদের ‘বেঙ্গল বই’ নামের এক অসাধারণ পাঠককেন্দ্র, প্রায় নিয়মিত গানের আসর আর খ্যাতিমান শিল্পীদের সিডি বের করেন যাঁরা, স্থাপত্যকলা আর স্থপতিদের নিয়ে যাঁদের কর্ম-উদ্যোগ অতুলনীয়, তাঁরা যখন মিষ্টির দোকান করেন, বলার অপেক্ষা রাখে না সেটা আর পাঁচটা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মতো নয়।

দোকানের নাম ‘বাংলার মিষ্টি’। মিষ্টির দোকান না বলে মিষ্টিকেন্দ্র বলাই সংগত। কেননা এখানে পাওয়া যাচ্ছে দেশের ৩৫ জেলার মিষ্টি। অন্যান্য জেলার মিষ্টিও পাওয়া যাবে শিগগিরই। দোকানের ভেতরের সাজসজ্জাও অন্য রকম। সাধারণ দোকানের মতো নয়। ঘরজুড়ে রুচির ছাপ স্পষ্ট। লম্বা বিশাল কাচের বাক্সে ভিন্ন ভিন্ন পাত্রে মিষ্টির নমুনা সাজানো রয়েছে। দেয়ালে টাঙানো রয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির নাম।

ভাবনাটি মাথায় এসেছিল প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার আবুল খায়েরের। কথা হলো তাঁর সঙ্গে। বললেন, মিষ্টি বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ। বাঙালির জন্মে মিষ্টি, মৃত্যুতে মিষ্টি, মিলাদে, পূজায় ও সুখবরেও মিষ্টি। মিষ্টির স্রষ্টাদের ময়রা বা কারিগর বলতে আপত্তি তাঁর। বলতে চান শিল্পী। জানালেন, সারা দেশে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ মিষ্টিশিল্পের সঙ্গে যুক্ত। এঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করা দরকার। বিদেশে শুকনো মিষ্টি রপ্তানি করার কথা ভাবছেন তিনি। ভবিষ্যতে বিদেশের বাঙালি অধ্যুষিত শহরে মিষ্টির দোকান করার পরিকল্পনার কথাও জানালেন।

মিষ্টির ইতিহাস আছে, ভূগোল আছে, ঐতিহ্য আছে। মিষ্টি বাঙালির সৃষ্টি। তবে ইতিহাস বলছে, বাঙালিরা ছানা তৈরি করতে জানত না। আগে মিষ্টি বলতে বোঝাত চিনির ঢেলার সন্দেশ। কখনো তার সঙ্গে নারকেলের মিশ্রণ। পশ্চিমবঙ্গের ব্যান্ডেলের ডাচ কারিগরেরা বাঙালি কারিগরদের ছানা তৈরি করতে শিখিয়েছিলেন। কথাসাহিত্যিক শংকর তাঁর বাঙালির খাবার দাবার বইয়ে লিখেছেন, ‘ছানা ও চিনি অনেকটা সাহিত্যের কাগজ ও কলমের মতো—রবীন্দ্রনাথের হাতে পড়লে এক রকম ফল, আর হরিদাস পালের হাতে পড়লে আরেক রকম’। ওপার বাংলার মিষ্টিশিল্পের অনেক রবীন্দ্রনাথ তাঁদের সৃজন প্রতিভার গুণে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। সন্দেশের স্থপতি নকুড় নন্দী, রসগোল্লার কলম্বাস নবীন দাস কিংবা বিশ্ববিদিত ভীম নাগেরা একাধারে ছিলেন মিষ্টির কারিগর ও ব্যবসায়ী। এ কারণেই সম্ভবত এসব মিষ্টির সঙ্গে তাঁদের নাম জড়িয়ে আছে। কিন্তু বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির নাম-পরিচয় ভৌগোলিক। যেমন, রাজবাড়ীর চমচম বা নাটোরের কাঁচাগোল্লা। কারণ এখানকার সেরা কারিগরেরা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক হতে পারেননি, সারা জীবন কর্মচারী থেকে গেছেন। নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টির সঙ্গে যে গয়ানাথের নাম জড়িয়ে আছে, তারও কারণ বুঝি এই যে তিনি একই সঙ্গে কারিগর ও ব্যবসায়ী ছিলেন।

বাংলার মিষ্টির এই কেন্দ্রে সন্দেশ, চমচমের মতো শুকনো মিষ্টি জেলাগুলো থেকে সরাসরি সংগ্রহ করা হয়। রসের মিষ্টির জন্য করা হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। যেসব জায়গায় রসের মিষ্টির সুনাম রয়েছে, সেখান থেকে কারিগর এনে ঢাকার সাভারের নিজস্ব কারখানায় তৈরি করা হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী সেই মিষ্টি।

 বাংলার মিষ্টিতে ঐতিহ্যবাহী যেসব মিষ্টি পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে যশোরের জামতলার রসগোল্লা ও চমচম, খুলনার মিহিদানা লাড্ডু, রাজবাড়ীর চমচম, ফরিদপুরের মালাই সর, বরিশালের গটিয়া সন্দেশ ও আদি রসগোল্লা, দিনাজপুরের গুড় ক্ষীরমোহন, রংপুরের হাবসি হালুয়া, রাজশাহীর রসকদম, চাঁপাইনবাবগঞ্জের কালো তিল কদম, নাটোরের কাঁচাগোল্লা ও ক্ষীর তক্‌তি, পাবনার ইলিশপেটি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছানামুখী, নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি ইত্যাদি।

নববর্ষ আসন্ন। উৎসবের এই দিনে বাঙালির ঘরে মিষ্টির কদর অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি। বোঁদে, নকুলদানা, কদমার মতো গ্রামের মেলার মিষ্টি কিংবা রসগোল্লা, সন্দেশ, রাজভোগ —সব মিষ্টিই এই দিনে আদরণীয়। বৈশাখের আনন্দ-অনুষঙ্গ হোক বাংলার মিষ্টি। ঠিকানা: ৬০ গুলশান অ্যাভিনিউ, গুলশান ১ (লিগাসি ফার্নিচারের নিচে)।