ওজিএসবি চিকিৎসকদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা ছাড়াও সরকারকে নীতি সহায়তা দিচ্ছে। স্বাস্থ্যের অর্জনে তাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশ এবং প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের সংগঠন অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ বা ওজিএসবির বয়স প্রায় সমান। বিশেষজ্ঞ পেশাজীবী চিকিৎসকদের এটিই দেশের সবচেয়ে বড় সংগঠন। দেশের মাতৃস্বাস্থ্য, শিশুস্বাস্থ্য, প্রজনন স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা সেবায় গুরুত্বপূর্ণ অর্জনের পেছনে এই সংগঠন বড় ভূমিকা পালন করেছে।
এই মহামারির সময় ওজিএসবিই প্রথম দাবি তুলেছিল, অন্তঃসত্ত্বা ও স্তন্যদানকারী মায়েদের কোভিড–১৯ টিকার আওতায় আনতে হবে। টিকাবিষয়ক দেশের সর্বোচ্চ কারিগরি কমিটি বিষয়টি পর্যালোচনা করে ওজিএসবির দাবির পক্ষে মত দেয়। তারপর থেকে অন্তঃসত্ত্বা ও স্তন্যদানকারী মায়েরা টিকা পেতে শুরু করেছেন। ওজিএসবি গত ৪৯ বছরে এই ধরনের বহু উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সম্ভ্রম হারানো মা, নির্যাতিত নারী ও কিশোরী, অন্তঃসত্ত্বাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে যে উদ্যোগ সদ্য স্বাধীন দেশের সরকার নিয়েছিল, তাতে শামিল হয়েছিলেন দেশের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা। ১৯৭২ সালেই তাঁরা সংগঠিত হয়ে গড়ে তোলেন ওজিএসবি।
ওজিএসবি গড়ে তোলার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন দেশের বিশিষ্ট স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক টি এ চৌধুরী। তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব। এই প্রবীণ চিকিৎসক প্রথম আলোকে বলেন, ‘সম্মিলিত কাজের মাধ্যমে সরকারকে সহায়তা করা, সরকারকে নীতি বিষয়ে উপদেশ–পরামর্শ দেওয়া, প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করা—এগুলো ছিল ওজিএসবি গড়ে তোলার উদ্দেশ্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের একই ধরনের সংগঠনের সঙ্গে দেশের চিকিৎসকদের সংযোগ ঘটানাও ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য।’
বর্তমানে দেশের ২ হাজার ২৮০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ওজিএসবির সদস্য। সারা দেশে এর শাখা আছে ১৬টি।
স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে যাঁরা শিক্ষা দান করেন, তাঁদের প্রশিক্ষণ দেয় ওজিএসবি। শিক্ষাদান ও চিকিৎসায় দক্ষতা বাড়ানোর জন্য নিয়মিত কর্মশালা, বৈজ্ঞানিক সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করে ওজিএসবি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা এই কাজ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ও বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস (বিসিপিএস)–এর সঙ্গে। প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পাঠ্যসূচি প্রণয়নে ওজিএসবি মত দেয়।
নারী স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরনের সেবার নীতি ও কৌশল প্রণয়নে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরকে সহায়তা করেন সংগঠনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। মাতৃমৃত্যু কমানোর কৌশল হিসেবে বড় ভূমিকা রেখেছে পরিবার পরিকল্পনা সেবা, নিরাপদ প্রসব সেবা ও জরুরি প্রসব সেবা। তিনটি ক্ষেত্রেই সংগঠনটি জড়িত।
সম্মিলিত কাজের মাধ্যমে সরকারকে সহায়তা করা, সরকারকে নীতি বিষয়ে উপদেশ-পরামর্শ দেওয়া, প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করা—এগুলো ছিল ওজিএসবি গড়ে তোলার উদ্দেশ্য।অধ্যাপক টি এ চৌধুরী, প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব, ওজিএসবি
পরিবার পরিকল্পনা সেবার জন্য সরকারকে গবেষণায় সহায়তা করেছে ওজিএসবি। অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও মাঠকর্মীদের প্রশিক্ষণেও জড়িত ছিল ওজিএসবি। প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল তৈরিতেও তাদের একক অবদান অনেক বেশি ছিল। নিরাপদ প্রসবসেবার মূল পরিকল্পনা তৈরি করেছিল ওজিএসবি এবং তা বাস্তবায়নে সরকারকে তারা সহায়তা করেছিল। দেশে মাতৃমৃত্যু কমানোর গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে ‘জরুরি প্রসূতি সেবা’। এই সেবার কর্মকৌশল তৈরিতে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন ওজিএসবির বিশেষজ্ঞরা। এসব সেবার গুণগত মান বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় গবেষণা ও কারিগরি সহায়তাও সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ ওজিএসবির কাছ থেকে পেয়ে থাকে।
এ রকম উদাহরণ আরও আছে। সরকারি হাসপাতালে নারীরা যেন স্বচ্ছন্দে চিকিৎসা নিতে পারেন, সে জন্য ২০০৬ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ‘ওমেন ফ্রেন্ডলি হসপিটাল ইনিশিয়েটিভ’ নামের একটি উদ্যোগ নিয়েছিল। যেসব হাসপাতালে এই উদ্যোগ আছে, সেখানে কর্মসূচিকে সফল করতে সহায়তা করে চলেছে ওজিএসবি।
২০০৮ সালে ওজিএসবি সরকারকে লিখিতভাবে বলে, দেশে অন্তঃসত্ত্বা, প্রসব ও প্রসব–পরবর্তী সেবার জন্য ‘মিডওয়াইফ’ নামে বিশেষ স্বাস্থ্য জনবল গড়ে তোলার প্রয়োজন। তারই ধারাবাহিকতায় মিডওয়াইফ তৈরি হয়েছে, পদ সৃষ্টি হয়েছে, তাঁরা সেবাও দিচ্ছেন।
জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘বিগত কয়েক দশকের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ওজিএসবি আস্থা ও সুনাম অর্জন করেছে। দেশের স্বাস্থ্যসেবার উন্নতিতে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, করে চলেছে। সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তারা যেমন দক্ষতা দেখিয়েছে, তেমনি চিকিৎসকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতেও তারা অবদান রেখেছে। চিকিৎসকদের দাবিদাওয়া পূরণের ব্যাপারেও ওজিএসবি সোচ্চার।’
নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়ন বিষয়ে অনেক কথা–বিতর্ক হলেও নারীর স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা–কথা কম হতে দেখা যায়। ওজিএসবির অনেক সদস্যই মনে করেন, স্বাস্থ্য ভালো থাকলে, স্বাস্থ্য অটুট থাকলে নারীর ক্ষমতায়ন ঘটে। স্বাস্থ্যসেবার মধ্য দিয়েই নারীর ক্ষমতায়ন ঘটানো সম্ভব। নার্স ও চিকিৎসকদের জন্য জেন্ডার বিষয়ে একাধিক কারিকুলাম তৈরি করেছে এই সংগঠন।
স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবায় বৈষম্য দূর করার বেশ কিছু পন্থার উল্লেখ আছে মাতৃস্বাস্থ্য কৌশলপত্র, কৈশোর স্বাস্থ্য কৌশলপত্র এবং সংশ্লিষ্ট কর্মপরিকল্পনায়। এসব দলিল তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন দেশের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা।
প্রশিক্ষণ, নীতি ও কর্মকৌশল প্রণয়ন, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করা ছাড়াও নিয়মিত গবেষণা করাও ওজিএসবির অন্যতম কাজ। এসব গবেষণা দেশি ও বিদেশি চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য সাময়িকীতে ছাপা হয়।
ওজিএসবির নিজস্ব জার্নালও রয়েছে। বাংলাদেশ জার্নাল অব অবস্টেট্রিকস অ্যান্ড গাইনোকোলজি নামের বিশেষায়িত জার্নাল বছরে দুবার বের হয়। ওজিএসবির পক্ষ থেকে নবীন গবেষকদের বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রবন্ধ লেখার কৌশলও শেখানো হয়।
তবে নিজেরা একটি হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট নির্মাণ করে অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছেন প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা। রাজধানীর মিরপুরে ওজিএসবি হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট অব রিপ্রোডাকটিভ অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ গড়ে তুলেছেন তাঁরা। হাসপাতালে প্রসূতিসেবা, নবজাতকের সেবা, কিশোরী স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি ক্যানসার পরীক্ষাও করা হয়।
ওজিএসবির বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম বলেন, ‘ওজিএসবির ঐতিহ্য অনুযায়ী এখন আমরা কোভিড–১৯ মোকাবিলায় সরকারকে সহায়তা করছি। একই সঙ্গে মহামারির সময় জরুরি সেবা অব্যাহত রাখার জন্য সরকারকে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য সরকার তথা স্বাস্থ্য বিভাগকে অনেক কিছু করতে হবে। আমরা সেই কাজে সরকারের পাশে আগের মতোই থাকব।’