আগুনে পুড়ে শেষ তোফায়েলের বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন, নূপুর দেখে চেনা গেল দগ্ধ নার্গিসকে

মুঠোফোনে তোফায়েলের ছবি দেখাচ্ছেন তাঁর চাচাতো ভাই শরাফত হোসেন
ছবি: আশীষ–উর–রহমান

বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন তরুণ তোফায়েল আহমদ। বয়স তাঁর ২১ বছর। একটি জনশক্তি রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠানে টাকাও জমা দিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকার হয়েছিল। অপেক্ষায় ছিলেন কাগজপত্র পাওয়ার। এই অপেক্ষার সময়টুকু বেকার বসে না থেকে যোগ দিয়েছিলেন মিরপুরের এক পোশাক কারখানায়। কিন্তু অপেক্ষার কাল তাঁর আর শেষ হলো না। গতকাল মঙ্গলবার মিরপুরের শিয়ালবাড়ির পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয়েছেন তোফায়েল আহমদ।

আজ বুধবার দুপুর সাড়ে বারোটায় মুঠোফোনে তোফায়েল আহমদের পুড়ে যাওয়া মৃতদেহের ছবি নিয়ে মর্গের সামনে অপেক্ষা করছিলেন তাঁর চাচাতো ভাই শরাফাত হোসেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মর্গে মিরপুর শিয়ালবাড়ি অগ্নিকাণ্ডে নিহত ১৬ জনের মরদেহ রাখা হয়েছে। রাতেই মরদেহগুলো এখানে আনা হয়। আগুনে পুড়ে সেগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। রাত থাকেই নিহত ও নিখোঁজদের স্বজনেরা এখানে আসেন। মধ্যরাত পর্যন্ত তাঁরা অপেক্ষা করেন। কেউ কেউ মৃতদের পোশাক-আশাক বা কোনো বিশেষ নিদর্শন দেখে শনাক্ত করেন। তবে রাতে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়নি। আজ সকাল থেকে আবার স্বজনেরা মর্গের সামনে ফিরে আসেন মৃতদেহ পাওয়ার জন্য। তাঁদের বিলাপে পরিবেশ বেদনাবিধুর হয়ে ওঠে।

আগুনে পুড়ে শেষ হলো তোফায়েলের বিদেশ যাওয়া স্বপ্ন

তোফায়েল আহমদের চাচাতো ভাই শরাফত হোসেন জানালেন, তাঁদের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে। তোফায়েল আহমদেরা দুই ভাই-বোন। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। তাঁর বাবা জজ মিয়া কৃষক। তোফায়েল এসএসসি পাস করে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কয়েক মাস আগে তিনি ঢাকায় এসে রূপনগরের একটি মেসে থাকতেন। অপেক্ষার সময়টুকু পোশাক কারখানায় যোগ দিয়েছিলেন। আগুনে পুড়ে শেষ হলো তাঁর বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন। রাতেই তাঁরা মর্গে তোফায়েলের মরদেহের পোশাক দেখে শনাক্ত করেছেন। বাড়িতে খবর পাঠানো হয়েছে। এখানে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের কাজ চলছে। লাশ তিনিই বাড়িতে নিয়ে যাবেন বলে জানালেন শরাফত।

নূপুর দেখে ছোট বোন চিনেছেন নার্গিসকে

নার্গিস আক্তার (১৯) মাত্র দুই সপ্তাহ হলো পোশাক কারখানায় কাজে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর পায়ের নূপুর ও মাথার খোঁপা দেখে তাঁকে শনাক্ত করেছেন ছোট বোন মৌসুমি আক্তার। মর্গের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়ে মৌসুমি জানান, গত বছর নার্গিস আক্তার মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্কুল ও কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন। তাঁর বাবা ওয়াজিউল্লাহ ফলের আড়তে কাজ করেন। তাঁরা চার বোন। নার্গিস ছিলেন দ্বিতীয়। বাবার একার আয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। সে কারণে নার্গিস পোশাক কারখানায় কাজ শুরু করেছিলেন। তাঁর কোনো মুঠোফোন নেই। সন্ধ্যার পরে ওই কারখানার লাইনম্যানের কাছ থেকে ফোন পেয়ে তাঁরা ঘটনাস্থলে যান। রাতেই বাবার সঙ্গে ঢাকা মেডিকেলে এসে নূপুর দেখে বোনের লাশ শনাক্ত করেন। রাতে তাঁদের জানানো হয়, পরদিন (বুধবার) লাশ দেওয়া হবে। রাত একটার দিকে তাঁরা ফিরে যান। তাঁর মা অসুস্থ, মেয়ের মৃত্যুতে আরও ভেঙে পড়েছেন। বাবা পুলিশ রিপোর্ট আনতে গেছেন। আর মর্গের সামনে বসে বসে বোনের শোকে কাঁদছিলেন মৌসুমি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মর্গের সামনে স্বজনদের ভিড়

মাহিরার আয়েই চলত সংসার

রূপনগরের ৯ নম্বর সড়কে মাহিরা আক্তার (১৪) ও সানজিদা আক্তারকে (১৫) নিয়ে থাকেন মা ফাতেমা বেগম। গ্রামের বাড়ি বরগুনা সদরে। স্বামী ফারুক হোসেন প্রয়াত। তিনি নিজেও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। কাজের সামর্থ্য নেই। দুই মেয়ে পোশাক কারখানায় কাজ করে। তাদের আয়েই চলে সংসার। ছোট মেয়ে মাহিরা কাজ করত শিয়ালবাড়ির অগ্নিকাণ্ড কবলিত কারখানার তৃতীয় তলায়। মেয়েকে হারিয়ে মর্গের সামনে বিলাপ করছিলেন ফাতেমা বেগম। কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না। আত্মীয়রা তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। পাশে বসা বড় বোন সানজিদা আক্তার জানাল, সে অন্য একটি কারখানায় কাজ করে। অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে মামা শফিকুল ইসলামকে নিয়ে রাতেই তারা ঘটনাস্থলে গিয়েছিল। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে এসে পোশাক দেখে বোনের মরদেহ শনাক্ত করেছে।

স্বামীর খোঁজে দুই ছেলেকে নিয়ে মর্গে

অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে নজরুল ইসলামের (৪০) কোনো খোঁজ পাচ্ছে না তাঁর পরিবার। আজ বুধবার সকালে মর্গের সামনে স্ত্রী নার্গিস ইসলাম দুই ছেলে মিরাজুল ইসলাম (২০) ও ইয়াসিন আরাফাতকে (১৬) নিয়ে মর্গের সমনে অপেক্ষা করছিলেন। মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনে থাকেন বলে জানান তাঁরা। গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া। নজরুল ইসলাম ওই ভবনের তৃতীয় তলায় পোশাক কারখানার কাজ করতেন। অগ্নিকাণ্ডের পর থেকেই তাঁর মুঠোফোনটি বন্ধ রয়েছে। মর্গে ১৬ জনের মরদেহ আছে। তাঁরা মরদেহ দেখার সুযোগ পাননি। রাতে যাঁরা মর্গে এসেছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ মরদেহ শনাক্ত করতে পেরেছেন। অপেক্ষা করছিলেন পুলিশের অনুমতি নিয়ে মরদেহ দেখার জন্য।

অনেকের স্বজন এখনো নিখোঁজ

অগ্নিকাণ্ডের পর আজ দুপুর পর্যন্ত অনেকের স্বজন নিখোঁজ রয়েছেন। স্বজনের সন্ধানে ছবি নিয়ে তাঁরা ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন রিকশাচালক আবদুল মান্নান। তাঁর মেয়ে মৌসুমি আক্তার (২০) অগ্নিকাণ্ডের পর থেকেই নিখোঁজ। রূপনগর আবাসিক এলাকার ২৬ নম্বর সড়কে তিনি থাকেন। তাঁর তিন মেয়ের মধ্যে মৌসুমি দ্বিতীয়। আগে মৌসুমি অন্য একটি করখানায় কাজ করতেন, এই মাসের শুরুতে এখানে যোগ দিয়েছেন। মৌসুমি আক্তারের কাছে মুঠোফোন ছিল, কিন্তু সেটি এখন বন্ধ।

মুক্তা বেগমের (২০) খোঁজে মর্গে এসেছিলেন তাঁর মামা আবুল দেওয়ান। তিনি জানালেন, মুক্তা শিয়ালবাড়ির ২ নম্বর সড়কে তাঁর খালা রিনা বেগমের সঙ্গে থাকতেন। তাঁদের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়ায়। মা–বাবা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে তাঁর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

মোজাম্মেল হোসেন এসেছিলেন ভাতিজা খালিদ হোসেনের (২৯) খোঁজে। তাঁর গ্রামের বাড়ি বরগুনা সদরে। ঢাকায় মোহাম্মদপুর এলাকায় মেসে থাকেন খালিদ। সম্প্রতি তিনি বিয়ে করেছেন। অগ্নিকাণ্ড কবলিত পোশাক কারখানার চতুর্থ তলায় তিনি কাজ করতেন। অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে ফোন বন্ধ। রাতে কারখানার সামনে গিয়ে খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করে সন্ধান পাননি। সকালে এসেছেন মর্গে। এখানে মরদেহ পাওয়া যাবে কি যাবে না, তা নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত আছেন তিনি।

মেয়ে মৌসুমি আক্তারের ছবি নিয়ে মর্গের সামনে বাবা আবদুল মান্নান

প্রশাসন অনুমতি দিলে মরদেহ হস্তান্তর করা হবে

অগ্নিকাণ্ডে মরদেহ গ্রহণের জন্য স্বজনহারা আত্মীয়রা সকাল থেকেই ভিড় করেছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের মর্গের সামনে। মরদেহ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া সম্পর্কে বেলা সাড়ে ১১টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান তাঁর দপ্তরে সাংবাদিকদের জানান, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা পুলিশ তদন্ত করছে। এটি পুলিশ কেস। সে কারণে জেলা প্রশাসন বা পুলিশের অনুমোদন ছাড়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মরদেহ হস্তান্তর করতে পারে না। মর্গে ১৬টি মরদেহ এসেছে। প্রতিটি মরদেহের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে রাখা হবে। মরদেহগুলো খুবই খারাপভাবে পুড়ে গেছে। এর মধ্যে ৯ জন পুরুষ ও ৭ জন নারী। তাঁদের মধ্যে ১০ জনের মরদেহ আত্মীয়রা শনাক্ত করতে পেরেছেন বলে তাঁকে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে পুলিশ যাচাই করে রিপোর্ট দেবে। পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের অনুমোদন পেলেই আত্মীয়দের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হবে।

ময়নাতদন্ত করা হবে কি না, জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক বলেন, নিয়ম হলো আত্মীয়রা ময়নাতদন্ত করাতে না চাইলে, প্রশাসনকে জানাবে। সে ক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত ছাড়াই মরদেহ হস্তান্তর করা হবে। এ ধরনের বড় দুর্ঘটনায় অতীতে আত্মীয়দের অনুরোধে ময়নাতদন্ত ছাড়াই মরদেহ হস্তান্তরের নজির রয়েছে।