তিন হাজার টাকা দিয়ে শুরু করা অয়ন এখন স্বাবলম্বী, তাঁর সঙ্গে কাজ করেন দেড় শতাধিক মানুষ
তিন হাজার টাকা দিয়ে শুরু করা অয়ন এখন স্বাবলম্বী, তাঁর সঙ্গে কাজ করেন দেড় শতাধিক মানুষ

কঠিন কিছুই না–১১

তিন হাজার টাকায় শুরু, এখন তাঁর সঙ্গে কাজ করেন দেড় শতাধিক মানুষ

দৃঢ় মনোবল আর প্রচেষ্টা থাকলে কোনো বাধা পেরোনোই কঠিন নয়। দরকার ইচ্ছাশক্তি, আত্মবিশ্বাস আর কঠোর পরিশ্রম। আমাদের আশপাশে এমন অনেকেই আছেন যাঁরা বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নিজেদের জীবনগাথায় লিখে চলেছেন অদম্য জয়ের গল্প। তাঁদের সেই সাফল্য ব্যক্তিগত অর্জনের সীমানা পেরিয়ে সমাজের নানাবিধ প্রতিবন্ধকতাকেও চ্যালেঞ্জ করেছে। তেমনই কয়েকজনের গল্প নিয়ে ধারাবাহিক এ আয়োজন। আজ জানব কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার সমুদ্রতীরের বাসিন্দা আর এম জাবের হোসেন অয়নের জীবন-গল্প।

আমি আর এম জাবের হোসেন অয়ন, কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার সমুদ্রের পাশে আমার বাড়ি। এখানেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ছোটবেলায় মানুষ বড় হয়ে অনেক কিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখে। আমি একটাই স্বপ্ন দেখেছি—ব্যবসা করব, উদ্যোক্তা হব। নিজেকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করব। কিশোর বয়স থেকেই ভাবতাম লেখাপড়ার পাশাপাশি কী করা যায়। কিন্তু কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

এসএসসি পাসের পর ঢাকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু আমার মা-বাবা এত দূর যেতে দেবেন না। আমার মনের কথা দাদুকে খুলে বললাম। দাদু বাবাকে বোঝালেন। বাবা তবু সম্মতি দিচ্ছিলেন না। আমার খরচ জোগাতে পারবে না বলে ঢাকা যেতে বারণ করেন। আমি উল্টো বাবাকে বোঝাই, মাসের খরচ হিসেবে মাত্র তিন হাজার টাকা দিলেই হবে। আমি বাকিটা পার্টটাইম কাজ করে ব্যবস্থা করব। বাবা সম্মতি দেন।

আমি ঢাকায় আসি। বুকভরা স্বপ্ন—কিছু একটা করব। নতুন শহর। রাজধানীর সবাই অনেক ব্যস্ত। আমি শুধু স্বপ্ন দেখি আর নিজেকে প্রস্তুত করার চেষ্টা করি। মিরপুর এলাকায় একটা হোস্টেলে উঠি। ভর্তি হই মিরপুর বাংলা কলেজে। প্রথম দিকে ভাড়া আর খাওয়াতেই সব টাকা শেষ হয়ে যায়। মাসে তিন হাজার টাকায় চলতে ভীষণ কষ্ট হতো। তবুও দমে যাইনি।

বাধ্য হয়ে হোস্টেলের বড় ভাইদের কাজ করে দিতাম। বিনিময়ে আমাকে মাঝেমধ্যে টিপস দিতেন তাঁরা। সেখান থেকে অল্প অল্প করে জমাই। এভাবে চলতে থাকে। একদিন কলেজের এক বড় ভাই একটা কম্পিউটার আর ফটোকপির দোকানে কাজ করতে বলেন। আমি আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ শুরু করি। পাশাপাশি লেখাপড়া চালিয়ে যাই। এভাবে বছর দুয়েক কাজ করে কিছু টাকা সঞ্চয় করি। সেই সঙ্গে কাজটাও ভালোভাবে শিখে ফেলি।

সুযোগ বুঝে কলেজের পাশে ছোট একটা দোকান শুরু করি। শিক্ষার্থীদের নোট ফটোকপি এবং কম্পিউটারের কাজ করি। এই কাজে অনেক পরিশ্রম। সারা দিন বসে কাজ করতে হয়। উপায় না দেখে ব্যবসা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিই।

ইতিমধ্যে কয়েক লাখ টাকা সঞ্চয় হয়। তা দিয়ে ছোট একটা ভাত-মাছের হোটেল দিলাম। কিছুদিন ভালো চলে, কিন্তু ধীরে ধীরে লাভের মুখ দেখা বন্ধ হয়ে যায়। মূলত হোটেল ব্যবসায় সার্বক্ষণিক নজর না রাখলে লোকসান গুনতে হয়। আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ভুল বুঝতে পারি। আবার আশা নিয়ে সুযোগ খুঁজতে থাকি।

রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কৌতূহলী চোখে বিভিন্ন দোকান খুঁজতে থাকি। একটি হোটেলের সন্ধান পাই। আবার হোটেল ব্যবসা শুরু করি, সঙ্গে আমার এক আত্মীয় অংশীদার হন। তিনি সদ্য বিদেশফেরত। নতুন উদ্যমে রেস্টুরেন্টের কার্যক্রম শুরু করি। নিজে বাজার করি। ক্যাশ কাউন্টার সামাল দিই, পাশাপাশি ওয়েটারের কাজও করি। যত রকমভাবে টাকা বাঁচানো যায়, সব চেষ্টা করি। আরেকটা উদ্দেশ্য ছিল, হোটেলের সব ধরনের কাজের অভিজ্ঞতা নেওয়া। এভাবে একসময় আমার হোটেল পরিচালনার কায়দাকানুন শেখা হয়ে যায়।

কয়েক বছর না যেতেই আমার আত্মীয় ব্যবসা থেকে সরে যেতে চান। তাঁকে বিদায় করতে হলে টাকা দরকার। মিরপুরে আমার রেস্টুরেন্ট এলাকায় ছিল ব্র্যাক মাইক্রোফাইন্যান্সের কার্যালয়। সেখানে গিয়ে সব খুলে বললাম। সবকিছু শুনে ব্র্যাক সহযোগিতায় এগিয়ে এল। তারপর অংশীদারের পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে আমি একাই রেস্টুরেন্ট চালাতে শুরু করি। এরপর আমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

স্বপ্নকে বড় করতে চেষ্টা করি। মিরপুরেই শুরু করি ওয়াফেল স্ট্রিট রেস্টুরেন্ট। দারুণ সাড়া মেলে। ধীরে ধীরে সাতটি শাখা খোলা হয়। এরপর আর থেমে থাকিনি। নামও দিলাম—‘পিজ্জাইন’ রেস্টুরেন্ট, ‘ড্রিম ক্যাফে’। এগুলো তরুণদের ভেতর বেশ সাড়া ফেলে। নানা রকম রেস্টুরেন্ট ব্যবসার অভিজ্ঞতা আমাকে আরও সাহসী করে তোলে।

ব্র্যাক থেকে নেওয়া ঋণ শোধ করার পর তাদের আমার সম্পর্কে একটা ইতিবাচক ধারণা হয়। তারা আমাকে আবারও ঋণ দেয়। ফলে নিজের পুঁজি আর ঋণ মিলে অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে চালু করি এক ভিন্নধর্মী রেস্টুরেন্ট ‘হাওয়া রুফটপ রেস্টুরেন্ট’। প্রায় সাড়ে ১২ হাজার বর্গফুটের রেস্টুরেন্ট। ব্যতিক্রমী সাজসজ্জা আর বাহারি খাবারের জন্য সবার নজর কাড়ে। আমার এই রেস্টুরেন্ট এখন অনেক হোটেল উদ্যোক্তাদের কাছে ‘আইকনিক’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

অয়নের গড়া ‘হাওয়া রুফটপ রেস্টুরেন্ট’ এখন অনেক হোটেল উদ্যোক্তাদের কাছে ‘আইকনিক’ হিসেবে পরিচিত

এত কিছুর পরও অগ্রযাত্রা থামাইনি। হাওয়া রেস্টুরেন্টের পাশেই ‘কসমো ক্যাফে অ্যান্ড ফুডকোর্ট’ নামে নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এখানে অনেক তরুণের কর্মসংস্থান হবে। এর মাধ্যমে নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা উপহার দিতে চাই গ্রাহকদের।

আমি এখন ভাবি, তিন হাজার টাকা দিয়ে শুরু করেছিলাম। আজ আমার সঙ্গে দেড় শতাধিক মানুষ কাজ করেন। তাঁদের অনেকেই আমার মতো উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। আমি এমন স্বপ্নবান মানুষদের পছন্দ করি। তাঁদের বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করি। বিশেষ করে আমার এখানে যদি কোনো শিক্ষার্থী লেখাপড়ার পাশাপাশি ইন্টার্ন করতে চান, আমি সাদরে আমন্ত্রণ জানাই। তরুণ বয়সের অর্থের অভাব আমি বুঝি। জীবনে কষ্ট থাকবে, অবহেলা থাকবে কিন্তু স্বপ্নকে ভুলে গেলে চলবে না। কেউ যদি উদ্যোক্তা হতে চান, তাঁকে কঠোর মনোবল নিয়ে কাজটা শিখতে হবে। হেরে গেলে চলবে না। প্রতিদিন চেষ্টা করাই প্রকৃত সাফল্য।