বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন ২০২৫ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ‘কীভাবে ভুয়া তথ্য শাসনব্যবস্থার হাতিয়ার হয়ে উঠল’ শীর্ষক আলোচনায় নিউ এজ-এর সম্পাদক নূরুল কবীর। আজ রোববার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে
বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন ২০২৫ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ‘কীভাবে ভুয়া তথ্য শাসনব্যবস্থার হাতিয়ার হয়ে উঠল’ শীর্ষক আলোচনায় নিউ এজ-এর সম্পাদক নূরুল কবীর। আজ রোববার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে

বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন

অপতথ্য রোধে মানুষের আস্থা অর্জন জরুরি

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও প্রযুক্তির বর্তমান সময়ে যেভাবে অপতথ্য ছড়াচ্ছে, তা রোধে মানুষের আস্থা অর্জন সবচেয়ে জরুরি। এ জন্য আইন, নীতি প্রণয়নে অংশীদারদের সতর্ক থাকতে হবে। পাশাপাশি এসব নীতির ক্ষেত্রে মানুষের অধিকার ও সুরক্ষাকে প্রাধান্য দিতে হবে। তাহলেই মানুষের আস্থা আসবে।

আজ রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন ২০২৫ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ‘কীভাবে ভুয়া তথ্য শাসনব্যবস্থার হাতিয়ার হয়ে উঠল’ শীর্ষক আলোচনায় বক্তারা এ কথাগুলো বলেন।

সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলন গত শনিবার শুরু হয়েছে।

ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ-এর সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে। যারা এক যুগের বেশি সময় শাসন করেছে। এই অভ্যুত্থানে যেসব হত্যাকাণ্ড হয়েছে, তা নিয়ে পরাজিত শক্তি বিশ্বে প্রোপাগান্ডা (অপপ্রচার) ছড়াচ্ছে যে আন্দোলনকারীরাই এদের হত্যা করেছে। এ ধরনের বয়ান তৈরি করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব নিয়ে ক্যাম্পেইন (প্রচার) চলছে। বিশ্বের অনেকেই এটা বিশ্বাস করাও শুরু করেছে যে এই অভ্যুত্থান হয়তো একটি ষড়যন্ত্র ছিল।

গণমাধ্যমে ফ্যাক্ট-চেকার থাকা নিয়ে এই সম্পাদক বলেন, একটি গণমাধ্যমের কেন ফ্যাক্ট-চেকার দরকার হবে? কারণ, প্রত্যেক প্রতিবেদক নিজেই একজন ফ্যাক্ট-চেকার। পেশাদার সাংবাদিকতায় এটার দরকার নেই।

নূরুল কবীর বলেন, বাংলাদেশে সামনে নির্বাচন। রাজনৈতিক দলগুলো প্রচারণা শুরু করেছে। একটি রাজনৈতিক দল যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় সক্রিয়ভাবে যুদ্ধের বিপক্ষে অংশ নিয়েছিল এবং গণহত্যায় জড়িত ছিল, সেই দলের একজন নেতা এখন বলছেন, তাঁরাও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। তারা টুইস্ট করছে। কথা হচ্ছে তারা কোন অংশে ছিল? এগুলো বলে তারা অপতথ্য ছড়াচ্ছে।

গণমাধ্যমে ফ্যাক্ট-চেকার থাকা নিয়ে এই সম্পাদক বলেন, একটি গণমাধ্যমের কেন ফ্যাক্ট-চেকার দরকার হবে? কারণ, প্রত্যেক প্রতিবেদক নিজেই একজন ফ্যাক্ট-চেকার। পেশাদার সাংবাদিকতায় এটার দরকার নেই।

কোনো রাষ্ট্রই পুরোপুরি আইন ছাড়া ভুল তথ্য প্রতিরোধ করতে পারে না উল্লেখ করে নূরুল কবীর বলেন, কিন্তু বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় এ ধরনের আইন উল্টো তথ্যপ্রবাহ সীমিত করার কাজে ব্যবহার হচ্ছে। তাই আইন গুরুত্বপূর্ণ হলেও আইন প্রণয়নের সময় জনগণ ও রাজনৈতিক অংশীদারদের সতর্ক থাকা জরুরি। তারা যেন বুঝতে পারে আইনটি সত্যিই তথ্য রক্ষা করছে, নাকি তথ্য নিয়ন্ত্রণ করছে।

ইউএনডিপির লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের আঞ্চলিক ব্যুরোর ডিজিটাল ডেমোক্রেসি অ্যানালিস্ট আলভারো বেলত্রানো উরুতিয়া বলেন, এখন যে অবস্থায় সবাই দাঁড়িয়েছে, তাতে গণতন্ত্রকে ও তথ্যব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে মনোযোগ দিতে হবে। অনেকেই এসব খাতে বিনিয়োগ করছেন, নানা সমাধান তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছেন, কিন্তু সমস্যার মূলটা জানছেন না।

একটি রাজনৈতিক দল যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় সক্রিয়ভাবে যুদ্ধের বিপক্ষে অংশ নিয়েছিল এবং গণহত্যায় জড়িত ছিল, সেই দলের একজন নেতা এখন বলছেন, তাঁরাও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। তারা টুইস্ট করছে। কথা হচ্ছে তারা কোন অংশে ছিল?
নূরুল কবীর, সম্পাদক, নিউ এজ

নির্বাচনের সময় ভুল তথ্যের বিষয়টি শুধু ভোটের দিনের বিষয় নয়, পুরো প্রক্রিয়াই ঝুঁকিতে থাকে উল্লেখ করে ইউএনডিপি বাংলাদেশের ইলেকটোরাল সাপোর্ট প্রজেক্টের প্রধান প্রযুক্তি পরামর্শক অ্যান্দ্রেস দেল কাস্তিও বলেন, নির্বাচন পরিচালনাকারী সংস্থাগুলোর প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে স্বচ্ছতা বজায় রাখা। এতে জন-আস্থা গড়ে ওঠে। নির্বাচন পরিচালনায় স্বচ্ছতা না থাকলে ভুল তথ্য সহজে ছড়িয়ে যায়।

সিঙ্গাপুরের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়নুল আবেদিন রশিদ বলেন, তথ্যব্যবস্থা সঠিকভাবে কাজ না করলে নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যায়। নির্বাচন কার্যকারিতা হারায়। তরুণদের কাছে একটি ভারসাম্যপূর্ণ তথ্য-পরিবেশ তৈরি করা গুরুত্বপূর্ণ। একটি দেশ বা সরকার এই চ্যালেঞ্জগুলোকে কীভাবে মোকাবিলা করে, তার ওপরই নির্ভর করবে—তথ্য খাত কোন দিকে যাবে।

বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন ২০২৫ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ‘কীভাবে ভুয়া তথ্য শাসনব্যবস্থার হাতিয়ার হয়ে উঠল’ শীর্ষক আলোচনায় বক্তারা। আজ রোববার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রসঙ্গে গ্লোবাল নেটওয়ার্ক ইনিশিয়েটিভের জবাবদিহি ও উদ্ভাবন ম্যানেজার মং মিন টু অং বলেন, বিশ্বে এআই নীতির তিনটি মডেল রয়েছে—উদ্ভাবনকে গুরুত্ব দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি যেখানে বিধিনিষেধ কম; নিরাপত্তা ও সুরক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে ইউরোপীয় নীতি এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা চীনের নীতি। এই তিন ধরনের কাঠামোর মধ্যে কোথাও কঠোর আইন, কোথাও নমনীয় নীতিমালা আছে।

এআই নীতিতে মানুষের সুরক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন মং মিন টু অং। তিনি বলেন, এখানে দেখতে হবে ব্যক্তিগত তথ্যের কীভাবে কোথায় ব্যবহৃত হচ্ছে, এআইয়ের বৈষম্যমূলক ব্যবহার রোধ এবং দুর্বল জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষা করা। এসবকে প্রাধান্য না দিলে আস্থা তৈরি হবে না।

অনুষ্ঠানের এই অংশ সঞ্চালনা করেন বেলজিয়ামের ইউরোপিয়ান পার্টনারশিপ ফর ডেমোক্রেসি প্রজেক্ট ডিরেক্টর অ্যানাসটাসিয়া এস উইবায়া।

‘মানুষের আস্থা অর্জন জরুরি’

সম্মেলনে ‘কৃত্রিম বিশ্বাস: এআই যুগে বাঁচা, ভালোবাসা ও মিথ্যা’ শীর্ষক আরেকটি আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নিয়ে গ্লোবাল নেটওয়ার্ক ইনিশিয়েটিভের মং মিন টু অং বলেন, তাঁদের সংস্থা বিভিন্ন দেশের সরকারকে এআই নীতির ক্ষেত্রে নানা ধরনের পরামর্শ দেয়। তিনি বলেন, এসব নীতিতে মানুষের আস্থা অর্জন জরুরি। মানবাধিকারকে গুরুত্ব দিয়ে আইন ও নীতি করা এবং তা বাস্তবায়ন করা। পাশাপাশি অধিকার লঙ্ঘন হলে প্রতিকারের ব্যবস্থা রাখা। কোম্পানির ক্ষেত্রেও একই নীতি থাকা প্রয়োজন।

মং মিন টু অং বলেন, প্রযুক্তিতে মানবাধিকার রক্ষাকে ‘অসম্ভব’ ভাবা হয়। যেন উদ্ভাবন আর অধিকার একসঙ্গে চলতে পারে না। কিন্তু বাস্তবে এটা সম্ভব। প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দায়িত্বশীলতা।

নেপালের অ্যাকাউন্টিবিলিটি ল্যাবের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রধান নারায়ণ অধিকারী বলেন, মানুষ তখনই আস্থা রাখবে, যখন সে নিশ্চিত হবে যে নীতিটি তার বিরুদ্ধে কাজ করবে না। গণতন্ত্র, নাগরিক অংশগ্রহণ, সমতা—সবকিছুই মানুষের এই আস্থা ও বিশ্বাসের ওপর দাঁড়ানো। কিন্তু এখন প্রযুক্তি ও এআই ব্যবহার করে এই বিশ্বাসকে নানাভাবে প্রভাবিত বা বিকৃত করা হচ্ছে। প্রযুক্তির বড় অংশই এমন দেশ থেকে আসে, যাদের প্রেক্ষাপট, ভাষা, মূল্যবোধ বা সামাজিক কাঠামো এ অঞ্চলের মতো নয়। ফলে এই প্রযুক্তি যখন এ সমাজে প্রয়োগ করা হয়, তখন পক্ষপাত, ভুল ব্যাখ্যা, অ্যালগরিদমিক বৈষম্য তৈরি হয়, যা মানুষের প্রকৃত বিশ্বাসকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

সিটি ব্যাংকের সহযোগী রিলেশনশিপ ম্যানেজার তানহা কেট বলেন, এশিয়ায় বাংলাদেশে ঋণ খেলাপির হার সবচেয়ে বেশি। এর প্রধান কারণ, রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ দেওয়া, অযোগ্যভাবে ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া এবং দুর্বল শাসন। এতে ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি মানুষের বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। এখানে এআই বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এআইয়ের সবচেয়ে বড় সুবিধা শনাক্তকরণ সুবিধা। লেনদেনের সব রেকর্ড থাকে। এ ছাড়া মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসীদের অর্থায়ন শনাক্তে এআই অনেক সহায়ক হতে পারে।

অনুষ্ঠানের এই পর্ব সঞ্চালনা করেন নলেজ ফর ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের পরিচালক প্রো চুং।