
পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচারহীনতা কোনো বিচ্ছিন্ন বাস্তবতা নয়। এটি রাষ্ট্রীয় কাঠামো, প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক অনীহার সমন্বিত ফল। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সত্ত্বেও পাহাড়ে যে সহিংসতা, ভূমি দখলের সংস্কৃতি অব্যাহত রয়েছে, তা এ বিচারহীনতাকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে।
‘পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় এ কথা বলেন বক্তারা। আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীতে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির শফিকুল কবির মিলনায়তনে এ সভা হয়। এর আয়োজন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন নামের একটি সংগঠন।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক খায়রুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে পাকিস্তান আমলে। সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে স্বাধীনতার পরও।
১৯৭৬ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৬টি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে বলে তথ্য তুলে ধরেন অধ্যাপক খায়রুল। তিনি বলেন, এসব গণহত্যার ফলে এক লাখ লোক পার্শ্ববর্তী ত্রিপুরা রাজ্যে আশ্রয় নেয়। এ সময়ে পার্বত্য অঞ্চলে কত ভূমি দখল হয়েছে তার কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না।
খায়রুল ইসলাম পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি–পরবর্তী সময়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের উপাত্ত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১১ সাল—এই ১৪ বছরে পাহাড়ে নাগরিক ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে ২ হাজার ৬৬৮ জন। ২০১২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এ সংখ্যা ৬ হাজার ৪৯৪ জন। এ ছাড়া ৩ লাখ ৩৪ হাজার ৪৮৮ একর ভূমি জবরদখল, ২ হাজার ৪৮৭টি (১৯৯৮–২০১১) বাড়িতে অগ্নিসংযোগ হয়েছে
এ বিচারহীনতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা দূর করতে তিনি পার্বত্য চুক্তির ধারাগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন, ভূমি কমিশনের পুনঃসক্রিয়করণ ও একটি স্বাধীন মানবাধিকার তদন্ত কমিশন গঠনের আহবান জানান।
‘সদিচ্ছা থাকলে শান্তি সম্ভব’
আলোচনা সভায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আদিবাসীদের অধিকার আন্দোলনকে দেশের সবার অধিকার আন্দোলনে রূপান্তরিত করতে হবে। আদিবাসীরাও এ দেশের মূলধারার মানুষ। তারাও এ দেশের নাগরিক।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন এবং এটা যে হবে না সেটার প্রতিফলন সম্প্রতি দেখা গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে “আদিবাসী” শব্দটা একবার উচ্চারণ করেছিলেন। এরপর কী হয়েছে, সেটা তো আমরা দেখতে পেয়েছি। আগুন জ্বলল। সরকার আদিবাসী শব্দটা টেক্সট বই থেকে সরিয়ে ফেলল। এর পর থেকে সরকার একবারও আদিবাসী শব্দটা উচ্চারণ করল না। আদিবাসী বন্ধুরা প্রতিবাদ করল। তাদের নির্মমভাবে আক্রমণ করা হলো।’
তিনি পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে হলে সেনাবাহিনীর সদিচ্ছা জরুরি বলে মনে করেন।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এই দেশে কোনো সরকারের কোনো এখতিয়ার ছিল না আদিবাসী অধিকার রক্ষা ও পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে। ছিল না, এখনো নাই, ভবিষ্যতেও থাকবে না। কাজেই সরকারের কাছে আমার কোনো চাওয়া নাই আদিবাসী অধিকার নিয়ে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেও চাওয়া নাই। তারা চাইলে কিছু করতে পারবে না। সরকার চাইলে কিছু করতে পারবে না।’
সেনাবাহিনীর কাছে প্রশ্ন রেখে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যদি শান্তি ফেরাতে পারে, তাহলে পার্বত্য অঞ্চলে কেন তারা সে উদাহরণ তৈরি করতে পারবে না। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী একমাত্র শক্তি, তাদের যদি সদিচ্ছা থাকে, তাহলে পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি সম্ভব।
সাবেক নারী সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন হক বলেন, ‘১৯৯৭ সালে চুক্তির পর ভেবেছিলাম একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। চুক্তির কোন অংশ কখন বাস্তবায়ন করা হবে এ রকম সময় নির্ধারণ করা ছিল না। রাষ্ট্র তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি।’
অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠীর যে জীবনধারা, তাদের যে মানবাধিকার, ভূমি অধিকার, সাংস্কৃতিক অধিকার, নাগরিক অধিকারকে আমরা স্বীকার করতে চাই না। গায়ের জোরে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ও স্বৈরতান্ত্রিক ঔদ্ধত্যে আমরা তাদের সে অধিকার অস্বীকার করে আসছি পাকিস্তান আমল থেকে। বিগত স্বৈরাচারের আমলে সে চুক্তি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি পূরণ করা হয়নি।’
কবি ও লেখক সোহরাব হাসান বলেন, শান্তির লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি হয়েছে। শান্তি কি এসেছে? আসেনি। কারণ, চুক্তিতে ছিল আদিবাসীদের পৃথক সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য রক্ষা করতে হবে। বাঙালি আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র সেটি হতে দেয়নি।
দিপায়ন খীসার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন।