টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান

প্রথম আলোর জরিপ নিয়ে অভিমত

মানুষের মধ্যে প্রত্যাশা রয়েছে, সংশয়ও আছে

প্রথম আলোর জনমত জরিপে সার্বিকভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে যে মতামত উঠে এসেছে, তা আমার বিবেচনায় বাস্তবতার প্রতিফলন।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে এখন মানুষের মধ্যে আস্থাহীনতা রয়েছে। নির্বাচিত সরকারের সময়ে তাঁরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির আশা করছেন। পাশাপাশি তাঁরা আশা করছেন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, বিনিয়োগ বাড়ানো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, নারীর চলাফেরায় নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রাখার ক্ষেত্রে নির্বাচিত সরকার সফল হবে।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৬ বছর পর মানুষ ভোট দিতে পারবেন, সেই প্রত্যাশা তো রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে তাঁরা সেভাবে আশা রাখতে পারছেন না। একই সঙ্গে তাঁদের মধ্যে সংশয়ও রয়েছে। তাঁরা দুর্নীতি দমন এবং বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে নির্বাচিত সরকারের ওপর আশাবাদী হতে পারছেন না। ফলে জরিপে মানুষের ভাবনার একধরনের মিশ্র চিত্র উঠে এসেছে।

জরিপে অংশগ্রহণকারীদের প্রায় ৭৩ শতাংশ আশা করছেন, নির্বাচিত সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সফল হবে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলতে যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বোঝায়, তাদের নৈতিকভাবে বড় ধরনের অধঃপতন হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো এ সংকট কাটিয়ে উঠতে পেরেছে বলেও দেখতে পাচ্ছি না। নির্বাচিত সরকার আসার পর চট করে এই বাহিনীর মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে, সেটা ভাবাটা খুব যৌক্তিক মনে করি না। একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পুনর্গঠন হতে হবে।

আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি যেভাবে চলে আসছে, তাতে নির্বাচনের পর যাঁরা ক্ষমতায় আসবেন, তাঁরা এই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা প্রশাসন বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সম্পূর্ণভাবে দলীয় প্রভাবমুক্ত করার মানসিকতা দেখাতে পারবেন, সেই আস্থা বাংলাদেশে গড়ে ওঠেনি।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নির্বাচিত সরকার সফল হবে বলে আশা করছেন ৬৯ শতাংশের বেশি মানুষ। এই আশা করাটা খুব অযৌক্তিক না বলে আমি মনে করি। এই যে দেড় বছর পার হয়ে গেল, এর মধ্যে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ, বাণিজ্যব্যবস্থায় তেমন একটা উন্নতি হয়নি। এটার অন্যতম কারণ, যখন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থাকে, অনিশ্চয়তা থাকে, তখন বাণিজ্য-বিনিয়োগ বাড়ে না। ফলে সবাই আশা করছে যে নির্বাচনের পর পরিস্থিতি স্থিতিশীল হবে। একই ভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলেও ভাবা হচ্ছে।

প্রথম আলো গ্রাফিকস

প্রায় ৬৯ শতাংশ মানুষ মনে করছেন যে নারীর নিশ্চিন্তে চলাফেরা ও নিরাপত্তার পরিবেশ নিশ্চিতের ক্ষেত্রে নির্বাচিত সরকার সফল হবে—সেটাও অযৌক্তিক নয়। নিরাপত্তাহীনতা সব সময়ই ছিল। তবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে এই নিরাপত্তাহীনতা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এর পেছনে অনেক কারণ আছে। বিশেষ করে যে শক্তিগুলো আন্দোলনে বিজয়ী হিসেবে নিজেদের ভাবছে ও পরিচিত হচ্ছে, তাদের মধ্যে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রভাব প্রকট। এ কারণে হয়তো অনেকে মনে করছেন, যে দল ক্ষমতায় আসছে, ধরে নেওয়া হচ্ছে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে, তারা হয়তো ততটা ধর্মভিত্তিক অবস্থান নেবে না।

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশের বিরুদ্ধে একটি গোষ্ঠী অবর্ণনীয় প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে রাষ্ট্র সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এটা খুব হতাশাজনক অভিজ্ঞতা। সরকার এমন সময়ে ব্যর্থ হয়েছে, যে সময়ে নারীর বিষয়ে সরকারের অবস্থান জানানোর জন্য একটি বার্তা দেওয়ার প্রচণ্ড প্রয়োজন ছিল। যে শক্তি বিকশিত হয়েছে, বিজয়ী শক্তি ভাবছে, তাদের মধ্যে আদর্শগত দিক দিয়ে এটা পরিষ্কার হয়েছে ‘এখন এটা আমাদের সময়’। ফলে আমি চট করে আশাবাদী হয়ে যেতে পারি না। আশাবাদী যাঁরা হয়েছেন, তাঁরা ধরে নিয়েছেন যে বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে, তাহলে অন্তত নারীর বিষয়ে পরিস্থিতি এর চেয়ে খারাপ হবে না। আদর্শগত দিক দিয়ে বিএনপি এমনিতেই মধ্যপন্থী।

মতামত প্রকাশে স্বাধীনতা নিশ্চিতে নির্বাচিত সরকার সফল হবে বলে জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৭০ শতাংশ আশাবাদ প্রকাশ করেছেন—স্বল্প মেয়াদে হয়তো বা সে আশা করা যায়। তবে আমাদের রাজনীতির যে অতীত রেকর্ড, সেখানে পরমতসহিষ্ণুতা, ভিন্নমতের স্বাধীনতা এবং সমালোচনা সহ্য করার সৎ সাহস নেই।

জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৪৮ শতাংশ দুর্নীতি দমনে নির্বাচিত সরকার ব্যর্থ হবে বলে মনে করছেন। এ হার আরও বেশি হলেও আমি অবাক হতাম না। আশাবাদী হওয়ার খুব বেশি সম্ভাবনা নেই। যে দলগুলো ক্ষমতায় আসবে, তাদের একটা বড় চ্যালেঞ্জ হবে তাদের অতীত রেকর্ড কাটিয়ে ওঠা।

বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতায় যা দেখা যায়, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়ায় কমপক্ষে ৭ থেকে ১০ বছর লেগে যায়। উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশে যে অর্থ পাচার হয়েছে, তার মাত্র ১ শতাংশ ফেরত আসে। পাচার করা অর্থ ফেরত আনা খুবই কঠিন। তবে হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে পাচার হওয়া টাকা বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে নির্বাচিত সরকার ব্যর্থ হবে বলে মত প্রকাশ করেছেন জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৩৮ শতাংশ। এই ভাবনা বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। উত্তরদাতাদের এমন ভাবার পেছনে কারণও আছে, তাঁরা ভাবছেন, দেড় বছর হয়ে গেল, একটা টাকাও তো ফেরত এল না। আমি এ বিষয়ে কাজ করি, তাই খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি, যে অর্থ পাচার হয়ে গেছে, সেটা আমাদের ব্যর্থতা। আমরা পাচার প্রতিরোধ করতে পারিনি। বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতায় যা দেখা যায়, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়ায় কমপক্ষে ৭ থেকে ১০ বছর লেগে যায়। উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশে যে অর্থ পাচার হয়েছে, তার মাত্র ১ শতাংশ ফেরত আসে। পাচার করা অর্থ ফেরত আনা খুবই কঠিন। তবে হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না। পাশাপাশি আমাদের প্রাধান্য দেওয়া উচিত পাচার প্রতিরোধে।

  • ইফতেখারুজ্জামান নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)

  • মতামত লেখকের নিজস্ব